বিশ্বকাপের আগে হারের যন্ত্রণা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যুক্তরাষ্ট্রে উড়াল দেওয়ার তিন দিন আগে হারের যন্ত্রণা পেল বাংলাদেশ। সেটাও যেনতেন কোনো হার নয়। বেশ বিব্রতকর বললেও কম হবে।
জিম্বাবুয়ের জন্য আজকের ম্যাচটা ছিল হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর। পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম চারটি জিতে আগেই সিরিজ জিতে নিয়েছিল বাংলাদেশ। সিরিজ জিতলেও পারফরম্যান্সে ছিল বিশাল ঘাটতি। ব্যাটিং, বোলিং দুই বিভাগেই ছিল আত্মবিশ্বাসের কমতি। শেষ ম্যাচে সেসব শুধরে বিশ্বকাপের পথে এগিয়ে যেতে চেয়েচিল নাজমুল হোসেন শান্তর দল। কিন্তু মিরপুর শের-ই-বাংলায় নিজেদের ডেরায় উল্টো হারের যন্ত্রণা পেতে হলো। জিম্বাবুয়ে তুলে নিয়েছে ৮ উইকেটের বিশাল জয়।
বিশ্বকাপের আগে এই ম্যাচই ছিল আইসিসির পূর্ণ সদস্য দলের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ। বৈশ্বিক মঞ্চে মাঠে নামার আগে সহযোগী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তিন ম্যাচ খেলবে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। কিন্তু পূর্ণ সদস্য জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলতে নেমে নিজেদের অবস্থান আরো তলানিতে নিয়ে গেল বাংলাদেশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আগে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশ ৬ উইকেটে ১৫৭ রান করে। জবাবে জিম্বাবুয়ে ৯ বল আগেই তুলে নেয় দারুণ জয়।
লক্ষ্য তাড়ায় জিম্বাবুয়ের জবাবটা ছিল দারুণ। ৪ ওভারেই বিনা উইকেট হারিয়ে ৩৮ রান তুলে নেয় অতিথিরা। যে কৃতিত্ব যায় বেনেটের দখলে। শুরুর ১৮ বলে ৩৬ রান করেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ৫ চারের সঙ্গে ২টি ছক্কা হাঁকান তিনি।
উইকেটের খোঁজে থাকা বাংলাদেশ সাকিবের বোলিংয়ে পায় সমাধান। নিজের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই সাকিব তুলে নেন মারুমানির উইকেট। এরপর খানিকটা সময় লড়াই করে বাংলাদেশ। পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ওভারে কোনো বাউন্ডারি হজম করেনি। ব্যাটসম্যানদের চাপে রেখে এ সময়ে রান দেয় মাত্র ৭ রান।
এরপরই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় অতিথিরা। সিকান্দার রাজা ও বেনেট পাল্টা আক্রমণে গিয়ে বোলারদের কড়া শাসন করেন। অষ্টম ওভারে সাইফ উদ্দিনকে মিড উইকেটে ছক্কা উড়ানোর পর দারুণ কভার ড্রাইভে চার হাঁকান রাজা। এরপর লেগ স্পিনার রিশাদকে একই ওভারে দুই ছক্কা মারেন রাজা ও বেনেট। রাজা ছাড় দেননি মোস্তাফিজকেও। কাভারের ওপর দিয়ে বল তুলে মেরে আদায় করেন দৃষ্টিনন্দন চার। বেনেট ১৩তম ওভারে রিশাদ হোসেনকে ছক্কা মেরে পেয়ে যান ফিফটির স্বাদ।
তাকে থামানোর পথ খুঁজে পেতে সৌম্যকে বোলিংয়ে আনেন শান্ত। শুরুটা ভালো ছিল না। তার প্রথম বলই লং অফ দিয়ে বিশাল ছক্কা মারেন বেনেট। মনে হচ্ছিল তার ব্যাটে ভর করেই জিম্বাবুয়ে পেয়ে যাবে প্রথম জয়ের স্বাদ। কিন্তু সাইফ উদ্দিন নিজের দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে ফেরান বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানকে।
পানি পানের বিরতির পর প্রথম ওভারেই বেনেট ক্যাচ তোলেন লং অফে। অনেক উচুঁতে উঠা বল সহজেই তালুবন্দি করেন রিশাদ। ৪৯ বলে ৫টি করে চার ও ছক্কায় ৭০ রান করেন বেনেট। ওই সময়ে ২৯ বলে ৪৫ রান দরকার ছিল জিম্বাবুয়ের।
কাজটা কঠিন ছিল না। রাজা ক্রিজে থাকায় জিম্বাবুয়ে ছিল আত্মবিশ্বাসী। অধিনায়কও হতাশ করেননি।
ওই ওভারেই সাইফ উদ্দিনকে দুটি চার মারেন দৃষ্টিনন্দন শটে। পরের ওভারে মোস্তাফিজকে পুল করে চার মেরে ৪১ বলে রাজা তুলে নেন ফিফটি। যা তার ক্যারিয়ারের ১৪তম টি-টোয়েন্টি ফিফটি। পরের ওভারে সাইফ উদ্দিনের স্লোয়ারে মিড উইকেট দিয়ে নিজের দ্বিতীয় ছক্কা তুলে নেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। শেষ দুই বলে আসে আরো ১০ রান। তাতে জয়ের লক্ষ্য চলে আসে সিঙ্গেল ডিজিটে।
মাহেদীর করা ইনিংসের ১৯তম ওভারের তৃতীয় বলে জয় নিশ্চিত হয়ে যায় জিম্বাবুয়ের। ৯ বল হাতে রেখে ৮ উইকেটের দারুণ জয়ে হোয়াইটওয়াশ এড়ায় অতিথিরা। ৪৬ বলে ৬ চার ও ৪ ছক্কায় ৭২ রান কেরন রাজা। পুরো সিরিজে নিষ্প্রভ থাকলেও শেষ ম্যাচে জ্বলে উঠেন তিনি।
বাংলাদেশের ব্যাটিং পুরো সিরিজেই ছিল মাথা ব্যথার কারণ। শেষটাতেও সেই ব্যথা সারেনি। বরং বাড়িয়ে গেছে। এদিন ১৫ রান তুলতেই নেই ৩ উইকেট। তানজিদ হাসান শুরুতে মুজারাবানির শর্ট বল তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন মিড উইকেটে। এরপর স্পিনার বেনেটের পর পর দুই ওভারে সৌম্য ও তাওহীদ উইকেট বিলিয়ে আসেন। উইকেট খানিকটা ধীরগতির ছিল। তবে বাউন্স আদায় করতে পারছিলেন বোলাররা। ওই লাফিয়ে উঠা বাউন্সেই সৌম্য পয়েন্টে ক্যাচ দেন। তাওহীদ আটকে যান উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে।
প্রবল চাপে পড়া বাংলাদেশকে ওই অবস্থান থেকে টেনে তোলার কাজটা সহজ ছিল না। মাহমুদউল্লাহ ও শান্ত চতুর্থ উইকেটে জুটি বেঁধে ৬৯ রান যোগ করেন। মাহমুদউল্লাহ শুরু থেকেই ছিলেন ইতিবাচক মানসিকতায়। শান্ত ছিলেন অনেকটাই স্থির। তবে থিতু হওয়ার পর রানের গতি বাড়ান অধিনায়কও। মাহমুদউল্লাহ ক্রিজে গিয়ে বেনেটের পরপর তিন বলে তিন বাউন্ডারি হাঁকান। শান্ত পরের ওভারে পান জোড়া বাউন্ডারি।
দুজনের জুটির ফিফটি চলে আসে ৩২ বলে। মনে হচ্ছিল তাদের ব্যাটে বাংলাদেশ বড় কিছুই করবে। কিন্তু শান্তর বিদায়ে আবার চাপে পড়ে স্বাগতিকরা। ২৮ বলে ৩৬ রান করে শান্ত মাসাদাকজার বলে আউট হন। বাঁহাতি স্পিনারের শর্ট বল স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন। ৫ চার ও ১ ছক্কা শান্ত ইনিংসটি সাজান। পাঁচ ইনিংস পর শান্তর রান ত্রিশ পেরিয়েছে।
সঙ্গী হারানোর পর মাহমুদউল্লাহর রানের গতিও কিছুটা কমে আসে। বেনেটকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে মিড উইকেটে ছক্কা হাঁকিয়ে চল্লিশের ঘরে প্রবেশ করেন মাহমুদউল্লাহ। সেখান থেকে ক্যারিয়ারের অষ্টম টি-টোয়েন্টি ফিফটিতে পৌঁছতে আরো ১০ বল নেন। চাপে পড়ে আক্রমণ বাড়াতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে আসেন বাংলাদেশের ইনিংসের টপ স্কোরার। ৪৪ বলে ৫৪ রান করে মুজারাবানির বলে ডিপ কাভারে ক্যাচ দেন। ৬ চার ও ১ ছক্কায় মাহমুদউল্লাহ সাজান নিজের ইনিংস।
মাঝে সাকিব নেমে ভালো কিছুর আশা দেখাচ্ছিলেন। আগের ম্যাচে ১ রানে তার ইনিংস থামলেও আজ ১৭ বলে ২১ রান করেন ১ ছক্কায়। লুক জোয়াংগিকে উড়াতে গিয়ে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিলেন সাকিব। দারুণ ডাইভে সেই ক্যাচ নেন ক্যাম্পবেল। দ্রুত উইকেট হারানো বাংলাদেশের রান দেড়শ যাবে কিনা তা নিয়েই ছিল সন্দেহ।
জিম্বাবুয়ের বোলাররা কাজটা সহজ করে দেন। জোয়াংগির ফুলটস বল ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কা উড়ান জাকের আলী। পরের ওভারে মুজারাবানির হাফ ভলি বল লং অফ দিয়ে সীমানা পাড় করান ডানহাতি ব্যাটসম্যান। শেষ দিকে তার এই দুই ছক্কাতেই বাংলাদেশের স্কোরবোর্ড জ্বালানি পায়। তার ১১ বলে ২৪ রানের ইনিংস শেষ দিকে হয়ে উঠে মহামূল্য।
৫ ম্যাচের এই সিরিজে সবকটি ম্যাচ খেলেও বড় ইনিংস আসেনি ব্যাটসম্যানদের ব্যাট থেকে। তানজিদ হাসান দুই ফিফটির পরও ৪০ গড়ে রান করেছেন ১৬০। তাওহীদ করেছেন ২০ রান কম। তার গড় ৪৬.৬৬। এছাড়া ৩ ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে মাহমুদউল্লাহ করেছেন ৮৯। বিশ্বকাপের আগে এ যেন হতাশারই এক দৃশ্যপট।
ব্যাটিংয়ের পর বোলিংয়েও একই চিত্র। বিশ্বকাপের আগে এই যন্ত্রণা ভোগাবে না তো বাংলাদেশকে?
ঢাকা/ইয়াসিন/বিজয়