ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

জীবনের রঙ, রঙের ছবি

ক্রীড়া ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১ জুন ২০২৪   আপডেট: ১২:০৫, ১ জুন ২০২৪
জীবনের রঙ, রঙের ছবি

মাইকেল জর্ডানের উক্তিটি কী মনে আছে? ‘আমি আমার জীবনে বারবার ব্যর্থ হয়েছি এবং সে কারণেই আমি সফল হই।’ এটা হয়তো ভুলে গেছেন! কিন্তু কথা সাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের এই উক্তি তো ভুলবার নয়, ‘সমুদ্রের জীবনে যেমন জোয়ার-ভাটা আছে, মানুষের জীবনেও আছে।’

মোদ্দাকথা, অন্ধকারের পর আলো আসবেই। ব্যর্থতার পর সফলতা আসবে। পরিশ্রমের ফল মিলবেই। মানুষের জীবনটাই এমন। কখনো ক্যানভাসে রংধনুর সাত রং ছড়িয়ে দেবে। কখনো ক্যনভাস বিবর্ণ করে দেবে। ওই ক্যানভাসটা কেমন হতে পারে সেই নিয়ন্ত্রণ কিন্তু মানুষের হাতেই থাকে। তুলির আচঁড় দেওয়ার ক্ষমতা ওই মানুষের নিয়ন্ত্রণে।

জীবন কতটা সুন্দর সেই ব্যাখ্যা যদি রিয়াল মাদ্রিদের জোসেলুর কাছে চাওয়া হয় তাহলে হয়তো আসল সংজ্ঞা পাওয়া যাবে। কেননা শূন্য থেকে শৃঙ্গে উঠার তার যে রোলারকোস্টার সফর, জীবনের প্রতিটি বাঁক তাকে কত কিছু শিখিয়েছে, কত পরীক্ষায় ফেলেছে, কত অপেক্ষায় রেখেছে… তা এক সমুদ্র সমান।

আরো পড়ুন:

‘যা হয়ে গেলো...আমার সুন্দর স্বপ্নটিও এত মধুর হয় না।’ - রিয়াল মাদ্রিদকে আরেকটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তোলার পর এভাবেই জোসেলু নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। ডন কোচ কার্লো আনচেলত্তির শেষ দান হিসেবে শেষ সময়ে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। ৯ মিনিট মাঠে কাটানোর পর ৩ মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোল স্পেনের ৩৪ বছর বয়সী জোসেলুর জার্সিতে।

চ্যাম্পিয়নস লিগের পনেরতম শিরোপার মিশনে থাকা রিয়াল মাদ্রিদের ওয়েম্বিলর টিকিট নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষবার মানে, ২০২২ সালে রিয়াল মাদ্রিদ শেষ যখন চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলেছিল তখন জোসেলু কোথায় ছিলেন জানলেও অবাক হবেন!

রিয়াল মাদ্রিদ প্যারিসে লিভারপুলকে ১-০ গোলে হারিয়ে জেতে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। রিয়াল মাদ্রিদকে সাপোর্ট করতে সেবার প্যারিসের রাস্তায় খেলা দেখেছিলেন জোসেলু। জানিয়ে রাখা ভালো, ফাইনালের টিকিট সংগ্রহ করতে না পারা জোসেলু বাবাকে নিয়ে ঘুরেছিলেন প্যারিসের বিভিন্ন রাস্তায়। খেলা দেখেছেন জায়ান্ট স্ক্রিনে। শিরোপা জেতার পর দুজনের এক ছবি পোস্ট করেছিলেন যা এখন ভাইরাল।

সেই জোসেলু এখন রিয়াল মাদ্রিদের ফাইনালে তোলার নায়ক। আজ যখন ওয়েম্বলিতে জোসেলু মাঠে নামবেন তখন কি প্যারিসের সেই রাস্তায় ঘোরাফেরার কথা ভুলতে পারবেন? ৩৬০ ডিগ্রির মতো তার জীবনে যে বাঁক খেল সেই গল্পটা জানা যাক।

স্টুটগার্টে জন্মগ্রহণ করেন জোসেলু এবং গ্যালিসিয়াতে বেড়ে ওঠেন। ১১ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়া জোসেলু সেল্টা ডি ভিগোর হয়ে ক্যারিয়ার শুরুর আগে যোগ দিয়েছিলেন মাদ্রিদের একাডেমি। ২০১১ সালে রিয়াল মাদ্রিদে অভিষেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পাস থেকে গোল করেছিলেন। কিন্তু রিয়ালের জার্সিতে পরের ম্যাচ খেলার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় ১২ বছর। এ সময়ে তিন দেশে আটটি ক্লাবে খেলেন জোসেলু।

রিয়াল তখন তারকায় ঠাঁসা। এ কারণে তাকে ছাড়তে হয় ক্লাব। ১২ বছর পর তার ক্লাবে ফেরার গল্পটাও চমকপ্রদ। বেনজেমা ও মারিয়ানো দিয়াজ চলে যাওয়ার পর একজন স্ট্রাইকারের প্রয়োজন বোধ করছিল মাদ্রিদ ক্লাব। রদ্রিগো ও ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের সঙ্গে আক্রমণভাগে প্রয়োজন আরও একজনকে। জুদে বেলিংহ্যাম থাকলেও বিকল্প রাখতে হবে বড় ক্লাবগুলো। এ যেন চিরায়িত নিয়ম।

২০২৩ সালে ১৯তম স্থানে লা লিগা শেষ করেছিল এস্পানিওল। তারা ছিটকে যায় স্পেনের শীর্ষ ফুটবল প্রতিযোগিতা থেকে। কিন্তু এস্পানিওলের হয়ে লিগ দারুণ কেটেছিল জোসেলুর। মৌসুমে ১৬ গোল করে লিগের তৃতীয় শীর্ষ গোলদাতা ছিলেন। তার ওপরে কেবল ছিলেন রবার্ট লেভানডোভস্কি ও করিম বেনজেমা। রিয়াল পুরোনো সৈনিককে দলে ভেড়াতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি। তাকে এক মৌসুমের জন্য ধারে নিয়ে নেয়। ক্লজে জানিয়ে রাখে, স্থায়ী চুক্তিও হতে পারে যে কোনো সময়।

রিয়ালে যোগদানের পর জোসেলুর ডাক পড়ে স্পেন দলেও। তার ৩৩তম জন্মদিনের দুদিন আগে অভিষেক হয় প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের। ম্যাচে সাড়ে তিন মিনিটে দুই গোল করে চলে আসেন লাইমলাইটে।

অথচ মাঝের সময়টায় জার্মানির হফেনহেইম, আইন্ত্রাখত ফ্রাঙ্কফুর্ট, হ্যানোভার ৯৬, স্টোক সিটি, দেপোর্তিবো লা করুনা, নিউ ক্যাসেল ইউনাইটেড ও আলাভেসে খেলে জোসেলু তেমন আলোই কাড়তে পারেননি। সব পাওয়া, জীবনের সমীকরণ মিলে যায় লস ব্লাঙ্কোসের জার্সিতে।

জীবনে এতো উত্থান-পতন, এতো নাটকীয়তা, এতো বাঁক বদল…তবুও নুন্যতম কোনো অভিযোগ নেই জোসেলুর। বরং ৩৪-এও এসে সব সুযোগগুলোকে দুই হাত ভরে গ্রহণ করছেন। গত এপ্রিলে দ্য গার্ডিয়ান-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জোসেলু বলেছেন— 
‘যখন আমার স্পেনের হয়ে অভিষেক হয়, তখন আমার স্ত্রী আনন্দে কেঁদেছিলেন। কারণ, আমরা যা কিছুর মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। এ অবস্থানে আসতে বেশি সময় নেওয়ায় প্রশংসাও বেশি হয়েছে। আমি এখন ২০ বছরে নেই। লম্বা ক্যারিয়ার পেছনে ফেলে এসেছি। যেখানে ঠাণ্ডা পেয়েছি। তুষার পেয়েছি। বৃষ্টিও পেয়েছি। এখানে (মাদ্রিদ) এখন আমাদের বাড়ি আছে। আমার স্ত্রী আছে। যা আমাদের কখনো ছিল না।’

রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এরই মধ্যে লা লিগা জিতেছেন জোসেলু। আজ ওয়েম্বলিতে স্বপ্নের রাত কাটালে প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফিতে চুমু খাবেন ৩৪ এ পা দেওয়া এ ফরোয়ার্ড। বয়স বাড়লেও জোসেলু বিশ্বাস করেন সামনে অনেক কিছু দেওয়ার আছে। এখান থেকেও নতুন শুরু হতে পারে এমন কথা বলতেও দ্বিধা করেন না।

‘শারীরিকভাবে আমি আমার ক্যারিয়ারের সেরা মুহুর্তগুলির মধ্যে আছি। আমি সবেমাত্র ৩৪ বছর বয়সী হয়েছি কিন্তু আমি এটা অনুভব করি না। পনের বছর আগে, ৩৪ বছর বয়সী কাউকে সাইন করতেন না কিন্তু এখন আপনি করেন। ৩০-৪০ মিলিয়ন ইউরোতে দুই বছরের চুক্তি…। ৩৩-৩৪ এ এখানে পৌঁছানো সহজ নয়। আমি এখন থামার পরিকল্পনা করছি না। আমার মধ্যে অনেক ফুটবল বাকি আছে।’

আচমকাই আড়াল থেকে নায়ক হওয়ায় জোসেলুকে নিয়ে ফুটবল দুনিয়ায় হৈচৈ পড়ে গেছে। হয়ে গেছে রিয়ালের নয়নের মণি। ক্যামেরার লেন্স খুঁজে নেয় তাকেও। জীবন সত্যিই এভাবেই পাল্টে যায়। সফলদের ঠিকানা খুঁজে নেয়।

একেকজনের জীবনের রঙ একেকরকম, তাই সেই রঙের ছবিও ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু একজন জোসেলু দেখিয়ে দিয়েছেন জীবনের রঙে তুলির আঁচড় ছড়ানোর নিয়ন্ত্রণ থাকলে ক্যানভাসটা রঙিনও করা যায়।

ইয়াসিন/আমিনুল


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়