ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৯ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৫ ১৪৩১

খসে পড়া তারার গল্প

ক্রীড়া ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ৬ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ০১:৪০, ৬ জুলাই ২০২৪
খসে পড়া তারার গল্প

দাবা খেলা, ঘুঁটি নিয়ে চালাচালি। সাদা-কালো ৬৪ ঘরে চলে সৈন্য, নৌকা, ঘোড়া, হাতি, মন্ত্রী, রাজার লড়াই। চেক মেটে রাজাকে ‘খেতে’ পারলেই ম্যাচের ফয়সালা। বলা হয়, দাবা শুধু কোনো খেলা নয়, বুদ্ধির চর্চা। খেলাটা খেলতে পারেন এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু মানুষই। যারা খেলাটাকে শুধু খেলা নয়, জীবনধারণের সঙ্গে মিলিয়ে নেন। আর তাদের সঙ্গে মিলে যান অসীম হৃদয়ের কিছু মানুষ।

বুদ্ধিদীপ্ত এই খেলাটার উপর একটা পরিবারের প্রেম, ভালোবাসা কতটা থাকলে তিন প্রজন্ম নিজেদের পথ খুঁজে নেয় এই ৮x৮ মাপের বোর্ডে।

পয়গাম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের দাঁবাড়ু। ১৯৮৪ সালে জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। তার হাত ধরেই মাত্র ১০ বছর বয়সে দাবায় হাতেখড়ি জিয়াউর রহমানের। যিনি ২০০২ সালে দেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার হন।

জিয়াউরের স্ত্রী তাসমিন সুলতানাও ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়। ২২তম বিসিএসে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৪তম ও নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সাবেক এই ছাত্রী জিয়াউরের সঙ্গে থাকবেন বলে বিসিএসের চাকরি ছেড়ে দেন। তার জন্য দাঁবাড়ু জিয়াউর হয়ে যান পৃথিবী। তাদের দম্পতির একমাত্র সন্তান তাহসিন তাজওয়ার জিয়াও এখন ফিদে মাস্টার। মোট কথা পুরো পরিবারটাই দাবার প্রেমে মত্ত। অথচ সেই দাবা খেলতে গিয়ে পরিবারটিতে এখন শোকের ছায়া।

ইভেন্ট থাকুক আর নাই থাকুক দাবা ফেডারেশনে রোজকার জিয়াউর রহমান একটু ঢুঁ মারবেনই। এখন তো চলছে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের ১২তম রাউন্ড। খেলা চলছিল দুই গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ও এনামুল হোসেন রাজীবের মধ্যে। শুক্রবার ৩টায় শুরু হওয়া খেলা প্রায় তিন ঘণ্টা অতিক্রমের পথে ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতার মঞ্চে ঘটে যায় ভয়ংকর দুর্ঘটনা।

খেলতে খেলতে হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জিয়াউর। সতীর্থ ও ফেডারেশনের কর্মকর্তারা দ্রুত তাকে নিয়ে যান হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার। চিরবিদায় দাবার এক নক্ষত্রের। পঞ্চাশেই থেমে গেল জীবন যাত্রা।

দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার পরিবারটি ছিল একেবারেই সীমিত কয়েকজনের। ১৯৮৭ সালে নিয়াজ মোরশেদ যখন উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন, গোটা এশিয়ায়ই তখন গ্র্যান্ডমাস্টার হাতে গোনা। ভারত পায় পরের বছর ১৯৮৮ সালে। চীন ১৯৯০ সালে। ১২ বছর পর বাংলাদেশ পায় জিয়াউর রহমানকে। এরপর  রিফাত বিন সাত্তার (২০০৬), আবদুল্লাহ আল রাকিব (২০০৭) আর এনামুল হোসেন রাজিবকে (২০০৮) পায় বাংলাদেশ। ছোট সেই পরিবারের এক নক্ষত্রের পতন হলো আজ।

জিয়াউরকে টেবিলের অপরপ্রান্ত থেকে পুরোটা সময় দেখেছেন রাজিব। সচরাচর ম্যাচের আগের দিন বা ম্যাচের দিনও দাঁবাড়ুদের মধ্যে কথা হয়, যোগাযোগ হয়। কিন্তু আজকের ম্যাচের আগে জিয়াউরের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি রাজিবের। কথা না বলার কোনো কারণ ছিল না। নানা ব্যস্ততায় হয়নি। সেই আক্ষেপ আজীবন থেকে যাবে রাজিবের, ‘আমার সামনে হুট করেই ঘটনা ঘটে গেল। আমি কল্পনাও আনতে পারিনি জিয়া ভাই পড়ে যাবে আর আমরা তাকে হারিয়ে ফেলব। একটু সময়ও দিলেন না আমাদের। এতো কিসের জলদি ছিল তার…।’ - মুঠোফোনে রাইজিংবিডির প্রতিবেদককে বলছিলেন রাজিব।

‘আমাদের খেলা প্রায় আড়াই ঘণ্টা অতিক্রম হচ্ছিল। আমরা বেশ উপভোগ করছিলাম। কিন্তু কিসের মধ্যে কি হয়ে গেল। একটু নিচু হতে হতেই উনি পড়ে গেলেন। আমি তো নির্বিকার। উনাকে টেনে তুলতে তুলতে উনি একেবারে সব ছেড়ে দিলেন। আমরা হাসপাতালে নিলাম। কিন্তু তার আগেই সব শেষ।’ - বলতে থাকেন রাজিব।

জিয়াউরের আদর্শ ছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। দেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। দুজনের প্রথম মুখোমুখি লড়াই হয় কলকাতার জিএম ওপেন টুর্নামেন্টে। যেখানে জিয়াউর নিয়াজের সঙ্গে ড্র করে চমকে দেন সবাইকে। ১৯৯৭ সালে তাকে প্রথম হারান ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স দাবায়। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধাপে ধাপে এগিয়ে তার নামের পাশে বসে যায় গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব। 

প্রিয় ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন নিয়াজ মোরশেদও। চোখে পানি ছিল তারও। গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে শোনা যায়, ‘প্রিয় একজন মানুষকে হারালাম। মেধাবী একজন দাবাড়ুকে হারালাম। আমি স্তব্ধ। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন একজন নক্ষত্রকে হারালো। আমি সত্যিই খুব ব্যথিত। ছোট ভাইয়ের মতোই সব সময় ওকে দেখতাম। ওর খেলার ভক্ত ছিলাম। এখন ও আমার সামনে এভাবে শুয়ে আছে আমি কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছি না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করা জিয়াউর রহমান ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন দাবাকে। জিয়ার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ রেটিং ছিল ২৫৭০। যেটা পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে। যা এখনো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। লম্বা ক্যারিয়ারে অনেক অর্জন জিয়াউরের। ১৯৯৯ সালে পান প্রথম জিএম নর্ম। ২০০১ সালে পূর্ণ হয় দ্বিতীয় নর্মটা। ২০০৫ সালে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ পয়েন্ট যখন পান তখন দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন।

কিন্তু অর্থাভাব সব সময়ই লেগে ছিল। এজন্য প্রচুর টুর্নামেন্টে অংশ নিতেন । তাতে অনুশীলনের সময় খুব একটা পেতেন না। সঙ্গে ভালো কোচের অধীনেও থাকার সুযোগ মেলেনি। ২০১০ সালে নিজেই কোচিংয়ে যোগ দেন। তখন থেকে রেটিং কমে যাওয়া শুরু করে যা এখন ২৪০০-এর ঘরে। তবুও ২০১২ সালে নাগপুরে আন্তর্জাতিক ওপেনে চ্যাম্পিয়ন, ২০১৮ সালে নয়াদিল্লিতে ১৮তম ওপেন আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ড মাস্টার দাবায় হন রানার্স-আপ।

এছাড়া বাংলাদেশ গেমসেও হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ছিলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। দেশের চার গ্র্যান্ডমাস্টার যেখানে সম্মিলিতভাবে ১৬বার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। সেখানে জিয়াউর একাই জিতেছেন ১৪ বার।

নানা চড়াই উৎরাই পাড় করে মধ্য বয়সে ক্যারিয়ার গুছিয়ে আনন্দে দিন কাটছিল জিয়াউরের। ছেলে তাহসিনের সঙ্গে দাবাতেই মেতে থাকতেন তিনি। ২০১৬ সালে জাতীয় দাবায় উত্তীর্ণ হন তাহসিন। আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রাণী হামিদকেও হারিয়েছেন। প্রতিযোগিতামূলক খেলায় তার বাবার সাথে ড্র করার রেকর্ডও রয়েছে। তার রেটিং এখন ১৮০০ ছাড়িয়েছে। একদিন হয়তো বাবাকেও ছাড়িয়ে যাবেন তাহসিন। কিন্তু সেই দিনটা দেখা হবে না জিয়াউরের।  

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউরের চিরকালীন স্বপ্ন ছিল সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার। সেই আক্ষেপ নিয়েই আজ জীবন নদীর ওপারে পাড়ি জমালেন। দাবায় জীবন উৎসর্গ করা এই তারা ধ্রুবতারা হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। 

ইয়াসিন/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়