ঢাকা     মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫ ||  বৈশাখ ৯ ১৪৩২

বাধার দেয়াল ভেঙে সম্ভাবনার দুয়ারে আদিবাসী ক্রিকেটার অনিকেত

ক্রীড়া প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৭, ১৭ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১৯:১৭, ১৭ আগস্ট ২০২৪
বাধার দেয়াল ভেঙে সম্ভাবনার দুয়ারে আদিবাসী ক্রিকেটার অনিকেত

বেশ লম্বা ও লিকলিকে এক তরুণ জোরে বল করে নজর কেড়ে নিলেন সবার। হইহই রইরই রব পড়ে গেল! কে এই তরুণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নাম তার অনিকেত দেব বর্মন। আরও গভীরে গিয়ে জানা গেল, সিলেটের শ্রীমঙ্গলের এই তরুণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা ক্রিকেটার। যুব ক্রিকেট লিগ দিয়ে নজর কাড়ার পর বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রাথমিক জায়গা পেয়েছেন অনিকেত।

এর আগে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কোনো ক্রিকেটার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেননি। অনিকেত নিজের মেধা ও সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে সেই দুয়ার খুলেছেন। সামনে ভালো করলে ইতিহাসের পাতায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবেন। কিভাবে উঠে এলেন অনিকেত। মিরপুর শের-ই-বাংলার সবুজ গালিচায় সেই গল্প শোনালেন, ‘ছোট বেলায় খেলাধুলা ভালো লাগতো। আমি বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম। তখন হাত ভেঙে বোলিং করতাম।’

‘ক্লাস ফাইভে ওঠার পর পড়াশোনার জন্য শহরে (শ্রীমঙ্গলে) চলে আসি। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি খেলাধুলা করতাম। তখন একটা একাডেমিতে ক্রিকেট বলে অনুশীলন করতাম। মৌলভীবাজারের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ দলে ট্রায়াল দিয়েছিলাম। ট্রায়ালে টিকেছিলাম কিন্তু স্কোয়াডে সুযোগ পাইনি। একই সঙ্গে আমি লিগে অংশ নেই। সেখানে স্যাররা আমার বোলিংয়ের প্রশংসা করেন।’

আরো পড়ুন:

‘আমি তখন বয়সভিত্তিক দলে নাম দেই। হবিগঞ্জ দলের হয়ে অংশ নেই। সেখানে আমি ভালো করি। এরপর বিভাগীয় দলে আমি সুযোগ পাই। সেখানে ভালো করায় আমি যুব ক্রিকেট লিগে সুযোগ পাই। সেখানেও আমার বোলিং ভালো হওয়ায় আমাকে এখানে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার খালুগুচিয়া গ্রামের ছেলে অনিকেত। আদিবাসীদের গ্রাম। পিছিয়ে থাকা সেই জনপদের মানুষের খেলাধুলার আগ্রহ বলতে কেবলই ছিল ফুটবল। ক্রিকেট সেখানে যেন বিলাসিতা। অথচ ছোটবেলা থেকে ঘরে থাকা সাদা কালো টিভিতে শোয়েব আক্তার, ব্রেট লি আর তাসকিন আহমেদদের বোলিং দেখে অনিকেতের পেসার হওয়ার উড়াল দেওয়ার শুরু। শুরুতে পরিবারকে পাশে পাননি। এখন পরিবারই তার অনুপ্রেরণার নাম।

‘আমি সব সময়ই পেসার ছিলাম। পরিবার থেকে কোনো সাপোর্ট পাইনি। আমি তখন পালিয়ে পালিয়ে খেলতাম। আমাকে বাসা থেকে এসে নিয়ে যেত (পাড়ার বন্ধুরা)। বাবা খেলতে না করতেন। বলতো, খেলে কি করবে? বকা দিত। আমাকে মারতোও। এখন বলে আগে খেলে আসো। আমি যখন বিভাগীয় দলে খেলছি তখন থেকে আমার পরিবার সাপোর্ট করা শুরু করেছে।’

অনিকেত শৈশবের গল্পও শোনালেন, ‘ছোট বেলায় আমার বাসায় সাদা কালো টিভি ছিল। টিভিতে ক্রিকেট খেলাই বেশি দেখা হতো।ভারতের খেলাই বেশি দেখা হতো। মোটামুটি সব খেলোয়াড়ের নাম জানতাম। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। তখন থেকেই বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম। আমার আইডল বাংলাদেশের তাসকিন আহমেদ। পাকিস্তানের শোয়েব আক্তার ও ব্রেট লি।’

খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন অনিকেত। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ থেকে। তিনটির পর পরীক্ষা দিতে পারেননি। সামনে পরীক্ষা চালু হলে ক্যাম্প ছেড়ে যেতে হবে তাকে। পরীক্ষার পর আবার পূর্ণ মনোযোগে যোগ দেবেন ক্যাম্পে।

আধুনিক ক্রিকেটে ক্রিকেটারদের বুট বাধ্যতামূলক। অথচ খেলা শুরুর দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও অনিকেতের ছিল না কোনো বুট। নিজেই জানিয়েছেন, বুট যে লাগত সেই খবরও তিনি জানতেন না। বিভাগীয় দলে খেলার সুযোগ পেলে বন্ধুর পুরোনো বুট কিনে নেন। এরপর অনেক কষ্টে বাবার থেকে পেয়েছেন এক জোড়া বুট। এখন সেই বুট পায়ে দিয়ে মিরপুরের ২২ গজে বল ছোড়েন দ্রুতগতির এই বোলার।

‘প্রথম যখন খেলতে নেমেছিলাম তখন জানতাম না যে পেসারদের বুট লাগে। এক দুই বছর পর জেনেছি। তখন বিভাগীয় এক দলের ক্রিকেটারের থেকে একটা বুট কিনেছিলাম। পরে বাবা এক জোড়া বুট কিনে দিয়েছিল। শুরুতে অতো ভালো বুট ব্যবহার করতে পারিনি। টাকা দিতে পারিনি। পরে বাবা দিয়েছে।’ - বলতে থাকেন অনিকেত।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) অনিকেতের উঠে আসাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বড় পাওয়া হিসেবে দেখছে। বিসিবির গণমাধ্যম বিভাগের ম্যানেজার জাহিদ চৌধুরী বলেছেন, ‘অনিকেত দেব আমাদের জন্য বড় পাওয়া। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের যেই প্রাথমিক স্কোয়াড আছে সেখানে আছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে সেভাবে আমাদের ক্রিকেটার উঠে আসে না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এটা ভালো দিক।’

অনেক চড়াই উতড়াই পেরিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসা অনিকেতের স্বপ্ন এখন একটাই, ‘আমি একদিন বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলব।’

ঢাকা/ইয়াসিন/বিজয়

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়