ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ৫ম পর্ব

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪২, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ৫ম পর্ব

ভোজন কার্য সম্পাদন করার পর ফিরে গেলাম আমার হোটেলে। পুরনো আমলের বাড়িঘর পার হয়ে, ফুল বাগান আর বাজার পার হওয়া যেন কোনো কল্পনায় ডানা মেলা। সবেমাত্র বিকেল ছয়টা। সাড়ে আটটার আগে দিনের আলো নিভবে না। তাই আশপাশের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো যায়। আমার হোটেলের পাশের গলিতে ঢুকে পড়লাম। এখানেও পুরনো ভবনের আধিক্য।

হাঁটতে হাঁটতে গলির শেষ প্রান্তে চলে গেলাম। ডান দিকে মোড় নিতেই দেখলাম একটা রেস্টুরেন্টের নাম বাংলায় লেখা- মক্কা রেস্টুরেন্ট। কয়েকজন বাঙালি ভাইকেও দেখলাম রাস্তা দিয়ে যেতে। একজনের নাম করিম, পাশের দোকানে কাজ করেন। করিম ভাইয়ের দোকান থেকে দু’একটা জিনিস কিনলাম- চকলেট, শ্যাম্পু এসব আর কি। আর যাই হোক দেশী ভাই আমার! পাশাপাশি অনেকগুলো ভারতীয় আর পাকিস্তানি রেস্তোরাঁ আর দোকান দেখলাম। এদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এতই গাঢ় যে বোঝার উপায় নেই কে ভারতীয় আর কে পাকিস্তানি। কেউ এসেছেন ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে, কেউ বা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ থেকে। ভারত পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব আর ঘৃণা আমরা দেখি শুধু নিজেদের দেশেই, বাইরের যে কোনো দেশে তারা মিলেমিশে থাকে।

এদিক-সেদিক হেঁটে চলে এলাম আমার হোটেল রুমের উল্টোপাশের অর্থোডক্স চার্চের সামনে। বিশালাকৃতির গেইট বন্ধ।  প্রবেশের সুযোগ নেই। কোনো ধরনের কার্যক্রমও চালানো হয় না এখন আঠারোশ শতাব্দীর এই গির্জায়। গির্জার  গলি পেরিয়ে বড় রাস্তা, রাস্তাটি পার হলেই একটি পুরনো মসজিদ, ইব্রাহীম পাশা মাসজিদ, ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। মসজিদের পাশে কবরস্থান। তুরস্কে প্রায় সব পুরনো মসজিদের পাশেই কবরস্থান রয়েছে। পারস্য সংস্কৃতির ধাঁচ এটা। এ কারণেই  বোধহয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-

সুলতান আহমেদ-এর সমাধি

'মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
... আযান শুনতে পাই।’

শুধু কি আযান শোনা? নামাজিরা যখন নামাজ পড়তে আসেন তখন তো দেখেও যান কবরগুলো, আর দোয়া করেন বিদেহী আত্মার জন্য। মসজিদের ভেতরে খোলা মাথায় ঢুকলাম ভয়ে ভয়ে, কারণ মাথা ঢাকার জন্য কিছু আনিনি। ভেতরটা খুব সাধারণ, মাঝারি আকারের মসজিদ। তেমন জৌলুশ নেই। একজন মুসল্লিকে দেখলাম বেরিয়ে যেতে, মসজিদে আর কেউ নেই কয়েকটি চিনার গাছ আর পুরনো কবরগুলো ছাড়া। আসরের ওয়াক্ত পার হয়ে গেছে আগেই। মাগরিবের ওয়াক্ত তো শুরু হয় সাড়ে আটটায়। মাথা খোলা রেখে মসজিদের ভেতর ঘোরাঘুরি করছি দেখে কেউ গালমন্দও করলো না- কি আশ্চর্য! কি শান্ত, ছায়াময় মসজিদ প্রাঙ্গণ! একটা বেঞ্চে বসে সামনের রাস্তা দেখছিলাম। অপূর্ব সুন্দর একজন নারী কালো বোরখা পরে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে পড়লেন মসজিদের দোরগোড়ায়। বসার তো অনেক জায়গা আছে, সেখানে বসলেন কেন? আসলে তিনি ভিক্ষে করতে এসেছেন। কোলের কন্যা সন্তানটির বয়স হবে বছরদেড়েক। ঘুমন্ত দেবশিশু একটা, মাথায় গোলাপী রিবন বাঁধা। আমার প্রচণ্ড বেদনাবোধ হলো- নেহাতই বাচ্চা একটা মেয়ে কি দায়ে যে অমন ফুটফুটে সন্তান নিয়ে পথে বসেছে ভিক্ষে করতে! তুরস্কে সাধারণত ভিক্ষুক দেখতে পাওয়া যায় না।  

ফিরে এলাম নিজের হোটেলে। এত তাড়াতাড়ি নিজের রুমে যাবার প্রশ্নই আসে না। লবিতে ক্যামেরুনের ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে। বসে গেলাম তাদের সাথে। একটু বাদেই আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেল হোটেলের ম্যানেজার ডোগান আর ফেরিদ। ডোগান স্থানীয় আর ফেরিদ কুর্দিশ। জমিয়ে আড্ডা হলো ভারত উপমহাদেশ, আফ্রিকা, তুরস্ক আর কুর্দিশ সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি নিয়ে। ইস্তাম্বুলে আমার তৃতীয় দিন। দিনের শুরু করব সুলেমানিয়ে মসজিদ দিয়ে। আমার হোটেল থেকে হাঁটা দূরত্ব- দশ মিনিট । সুলতান সুলেমান নির্মাণ করেছিলেন এই মসজিদ যা ইস্তাম্বুলের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। প্রথমটা তো গত পরশু দেখে এসেছি- সুলতান আহমেদ মসজিদ। মসজিদকে তুর্কী ভাষায় বলা হয় ‘জামি’।   

১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলেমান রাজ্যের প্রধান স্থপতি মিমার সিনানকে সুলেমানিয়ে মসজিদ নির্মাণের কাজে ন্যস্ত করেন। মসজিদটি নির্মাণে সময় লাগে সাত বছর। সুলতান সুলেমানের নির্দেশ ছিল মসজিদটি যেন আয়া সোফিয়ার স্থাপত্যকলাকে ছাপিয়ে যায়। কারণ আয়া সোফিয়া নির্মাণের পর সম্রাট জাস্টিনিয়ান অহং ভরে হযরত সুলেমান (আঃ) এর নির্মিত মসজিদ আল হারামকে (যা এখন জেরুজালেমে অবস্থিত) তাচ্ছিল্য করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে সুলতান সুলেমান নিজেকে হযরত সুলেমান (আঃ) এর সঙ্গে তুলনা করতেন। আর তার মসজিদ তো শ্রেষ্ঠ হতেই হবে। ১৫৫৭ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। মিমার সিনানের অন্যতম কাজের মধ্যে সুলেমানিয়ে মসজিদ অন্যতম, অটোম্যান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম আর প্রাঙ্গণের আয়তনের তুলনায় বৃহত্তম মসজিদ হয়ে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বসফরাস-এর অপর পাড় থেকে সবার আগে চোখে পড়ে সুলেমানিয়ে মসজিদ। মসজিদে ভিন্নতা আনার জন্য ভেতরের ইযনিক টাইলসের রং বদল করে দেয়া হয়েছিল টকটকে লাল। মসজিদ প্রাঙ্গণে মসজিদ ছাড়াও একটি মাদ্রাসা, একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, একটি গ্রন্থাগার, পাবলিক স্নানঘর ও একটি রসুইঘর ছিল। হাসপাতাল ও রসুইঘর সাম্রাজ্যের দরিদ্রদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। ভবনগুলোর বেশিরভাগই এখন সরকার অন্য কাজে ব্যবহার করছে। 

 

সুলেমানিয়ে মসজিদের ভেতরের কারুকাজ

অন্যান্য অটোম্যান ধাঁচের মসজিদের মতো এই মসজিদে প্রবেশদ্বার পার হলেই মিলবে বিশাল উঠোন আর উঠোনের মাঝখানে পানির ফোয়ারা। মসজিদে মিনারাত চারটি। মসজিদের ভেতরটা অতটা জাকজমকপূর্ণ মনে হলো না সুলতান আহমেদ মসজিদের মতো। কারণ হতে পারে প্রতিষ্ঠা থেকে আজ অবধি মসজিদটি তিনবার বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। প্রথমে ১৬৬০ সালে আগুন লেগে মসজিদটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়, তারপর ১৭৬০ সালে ভূমিকম্পে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হবার কালে গোলাবারুদ বিস্ফোরণে। সর্বশেষ ১৯৫৩ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ভেতরের কারুকাজ বলতে রয়ে গেছে জানালার রঙিন কাচ আর মসজিদের অবকাঠামো। ভেতরের ছাদ এবং জানালার নকশা পুরোই আয়া সোফিয়ার অনুকরণ করা হয়েছে। ছাদের গম্বুজে হালকা গোলাপি, লাল, হলুদ রঙের হাতে আঁকা কারুকাজ আর দেয়ালে আরবীতে সুরা ফাতিহা লেখা। কার্পেটের রঙ লাল যেন বিশাল একটা লাল গোলাপ ধারণ করে আছে মসজিদকে।  মসজিদের ঠিক মাঝখানে বিশাল ঝাড়বাতি নুয়ে পড়েছে মুসল্লিদের আলোকিত করার জন্য। সুলেমানিয়ে মসজিদের পশ্চিম পাশে সুলতান সুলেমান আর তার পরিবারবর্গের সমাধি।

সুলতান সুলেমান (১৪৯৪-১৫৬৬) যাকে আখ্যা দেয়া হয়েছে অটোম্যান সাম্রাজ্যের মহান সম্রাট বা ‘সুলেমান দি ম্যাগনিফিসেন্ট’ নামে।  তিনি অটোম্যান সাম্রাজ্যের দশম দীর্ঘ ক্ষমতাসীন সম্রাট। তার শাসনামলে ইউরোপের বেশ কিছু সাম্রাজ্য অটোম্যানের দখলে আসে। মধ্যপ্রাচ্য, আলজেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা, পারস্য ও ভূমধ্যসাগরীয় বেশ কিছু অঞ্চলে অটোম্যান সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়। তিনি সাম্রাজ্যের গতানুগতিক সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা, কর গ্রহণের নিয়ম, আইনকানুন ইত্যাদির আমূল পরিবর্তন আনেন। সুলতাল সুলেমান ছিলেন একজন কবি, শিল্প সংস্কৃতির অনুরাগী। সুলতান সুলেমানের জন্ম তুরস্কের ট্রাবযোন নামক স্থানে। পিতা সুলতান সেলিম (১), মাতা আলবেনীয় বংশদ্ভূত হাফসা সুলতান। সাত বছর বয়সে সুলতানকে তোপকাপি প্যালেসে পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজকীয় একাডেমিক শিক্ষা ও সমরাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণের জন্য। সতেরো বছর বয়সে সুলতান সুলেমান কাফফা ও মানিসার গভর্নর নিযুক্ত হন। পিতা সম্রাট সেলিমের মৃত্যুর পর সুলতান সুলেমান পঁচিশ বছর বয়সে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার স্ত্রী ছিলেন দুজন। মাহিদেভরান হাতুন এবং হুররেম সুলতান।

সুলতান সুলেমান সে সময়ে নিদর্শন স্থাপন করেন হুররেম সুলতানকে বিয়ে করে। হুররেম ছিলেন সুলতানের রক্ষিতা। রুথেনিয়ার ধর্মযাজকের মেয়ে রুক্সেলানাকে দস্যুরা অপহরণ করে বিক্রি করে দেয় ইস্তাম্বুলে। সেখান থেকে ঠাঁই হয় সুলতানের প্রসাদে। রুক্সেলানার বুদ্ধিমত্তা ও ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুলতান। আর রচিত হয় অটোম্যান সাম্রাজ্যে ইতিহাস, এই প্রথম কোনো রক্ষিতাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন কোনো সম্রাট। রুক্সেলানা ধর্মান্তরিত হয়ে নাম বদলে হয়ে যান হুররেম সুলতান। হুররেম ও মাহিদেভরানের আটজন পুত্র ও তিনজন কন্যা সন্তান ছিল। তাদের মধ্যে শাহজাদা সেলিম (হুররেম সুলতানের পুত্র) পরবর্তীতে সুলতান সুলেমানের মৃত্যুর পর সম্রাট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুলতানের নির্দেশে তাঁর পাঁচজন শাহজাদাকে হত্যা করা হয়েছিল পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে।

 

স্থানীয় বাজার

সুলতান সুলেমান আর হুররেম সুলতানের সমাধি দুটো আলাদা ভবনে। এর বাইরে বিশাল এলাকাজুড়ে সম্রাটের আত্মীয়স্বজনের কবর। সুলতানের সমাধি অষ্টকোণাকৃতি ভবন। ভেতরে সুলতান ও তার ছেলেদের সমাধি। সমাধি ভবনের ভেতরের দেয়াল ইযনিক টাইলস দিয়ে আবৃত যার নকশা দেখতে হুবহু  তোপকাপি প্যালেসের মত, দেয়ালে কোরআনের আয়াত লেখা, তার ওপরে ছাদের চিত্রকলা অটোম্যান ধাঁচের হলুদ রঙের আধিক্যে। হুররেম সুলতানের সমাধি ভবনটিও সুলতানের আকারের এবং নকশার। হুররেম ছিলেন সুলতানের প্রিয়তমা স্ত্রী, যিনি সুলতানের আগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। হুররেমের সমাধিভবনে তার সমাধি ছাড়াও তার মেয়েদের সমাধি রয়েছে। আর ভেতরের দেয়ালের ইযনিক টাইলসের নকশা সবচেয়ে মনোরম, সে নকশা তোপকাপি প্যালেসের রাজমাতার কক্ষের হুবহু অনুকরণে আঁকা। ভবনের বাইরে গোলাপ বাগান পাহারা দেয় তাদের প্রিয় সমাধিদের, হাওয়া দেয়, সুবাস দেয়। দর্শনার্থীদের ভিড় থাকলেও গোলাপ ছাড়া মৃতদের আপন বলতে আর কে বা আছে এখন!

সুলেমানিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে ঠিক করলাম ট্রাম ধরে চলে যাব গালাটা টাওয়ারের দিকে। ট্রাম স্টেশনে বিভিন্ন মানুষের আনাগোনা। পুরুষদের পোশাকে তেমন বৈচিত্র নেই, তবে নারীরা যেমন সুন্দরী তেমন আধুনিক তাদের পোশাক। কেউ ডেনিম, কেউ স্কার্ট পরেছেন, কেউ মাথা ঢেকেছেন খোঁপার মত করে স্কার্ফ দিয়ে পেঁচিয়ে, কেউবা সোনালী, বাদামী, কালো চুলের ঢেউ খেলিয়ে মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরো বেয়াজিত এলাকা।

ট্রামে চড়ার অভিজ্ঞতাও মন্দ নয় আমার। এখানে নারীদের বসবার জন্য আলাদা কোনো আসন নেই। আসন না পেলে নারীরা আরামসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। নিতান্তই বৃদ্ধা না হলে কোনো পুরুষ উঠে বসার জায়গা করে দিচ্ছেন না। এবং গণপরিবহনে কোথাও নারীরা যৌন হয়রানির নামও কোনদিন শোনেন নি। আমার পাশে যে পুরুষটি বসে ছিলেন তিনিও দূরত্ব বজায় রেখে বসেছিলেন। বাইরে অপার বসফরাস মায়া বাড়িয়ে চলছে। ট্রাম লাইনের পুরোটা পথ বসফরাসের কোল, যেন ডাকছে কাছে গিয়ে বসার জন্য। এমন ডাক কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। (চলবে)

**  


ঢাকা/তারা      

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়