কুনমিংয়ের ড্রাগন গেট এবং শিশান
তিয়ানশি লেকের তীরে
চীনের কুনমিং শহরের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় পশ্চিম পাহাড় বা ওয়েস্টার্ন হিলসে। যদি কেউ ওয়েস্টার্ন হিলস না দেখে থাকেন তাহলে তিনি কুনমিং দেখেননি, আর যদি ড্রাগন গেট না দেখে থাকেন তাহলে তিনি ওয়েস্টার্ন হিলস দেখেননি- এমন একটা কথা কুনমিং-এ খুব প্রচলিত।
কুনমিং ভ্রমণের সময় যে টুরিস্ট স্পটগুলো দেখা রীতিমতো ফরজ তার মধ্যে রয়েছে ওয়েস্টার্ন হিলস। চীনা ভাষায় এই পাহাড়ের নাম ‘শিশান’। এর চূড়ায় অবস্থিত ড্রাগন গেট মন্দির। কুনমিং ভ্রমণকারীর জন্য যদি এই মন্দির দেখা অত্যাবশ্যক হয় তাহলে কুনমিং বসবাসকারীর জন্য এটা না দেখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। বলা যায়, একরকম বিবেকের তাড়না থেকেই আমরা স্থির করলাম এই শনিবার আমাদের টার্গেট হবে শিশান পার্ক এবং ড্রাগন গেট। আমরা মানে, আমি এবং আমার তিন সহকর্মী- শ্রীলঙ্কার ছাতুরিকা জৈমিনি, পাকিস্তানের জাভারিয়া চুঘতাই এবং ভারতের রনিবালা লাইসরম।
ওয়েস্টার্ন হিলস পাহাড়ে
বিশেষ করে রনিবালার তাড়া ছিল বেশি। কারণ তার পিএইচডি সমাপ্তির পথে। ভারতে ফিরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে অথচ এখনও কুনমিং শহরের বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন হিলস দেখা বাকি রয়ে গেছে- কি লজ্জা! কি লজ্জা! আগের দিন নেট ঘাঁটাঘাঁটি চললো। কোথায় কীভাবে যাবো এ নিয়ে বিস্তর খোঁজখবর করে যা জানলাম, ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। কিন্তু খরচ অনেক বেশি। তারচেয়ে যদি কিছুটা দূর সাবওয়ে দিয়ে গিয়ে তারপর ট্যাক্সি ধরি তাহলে ভালো হবে। আমাদের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কাছেই সাবওয়ে স্টেশন। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হলো।
সাবওয়েতে এক ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো গেল সেই বিশাল পাহাড়ের সানুদেশে। নামে ওয়েস্টার্ন হিলস হলেও এটা রীতিমত মাউন্টেন। শৈলশ্রেণী। এই শৈলশ্রেণীরই একটা বিশেষ চূড়ায় ড্রাগন গেট অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ড্রাগন গেটের উচ্চতা ২,৩০০ মিটার বা প্রায় ৮ হাজার ফুট। নিচে থেকে সেই বিশাল পাহাড়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। এই পাহাড় ভেঙে উঠতে হবে আমাকে? গোবেচারা সমতলবাসিনী বাঙালি মেয়েকে? সঙ্গী আছেন কাশ্মিরীকন্যা জাভারিয়া, মণিপুরী রনিবালা আর শ্রীলঙ্কার ছাতুরিকা। তিনজনেরই বাড়ি পাহাড়ে। এরা সকলেই ছোটবেলা থেকে পাহাড় পর্বতে চড়ে অভ্যস্ত। এখন আমি যদি ভয় পাই তাহলে বাঙালির বদনাম! মুখে ডিমভাজা মার্কা হাসি দিয়ে এমন ভাব করলাম যেন এসব আমার কাছে কোনো ব্যাপারই না। দরকার পড়লে এভারেস্টও জয় করতে পারি।
বিখ্যাত ড্রাগন গেট
সাবওয়ে স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে কিছু দূর পাহাড়ি পথে এগিয়ে পৌঁছানো গেল মূল প্রবেশপথে। সেখান থেকে শুরু হলো পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে চলা। কষ্ট হচ্ছিল বটে, তবে সেটুকু পুষিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ি বন্য প্রকৃতির অসাধারণ শোভায়। লম্বা লম্বা পাহাড়ি গাছ উঠেছে সূর্যের দিকে মুখ করে। শীতের সকালের রোদে স্নান করছে পাহাড়ি বনভূমি। এই বনভূমি মানুষের সৃষ্টি নয়। এখানে স্মরণাতীত কাল থেকে অরণ্যভূমি ছিল এবং আছে। এই পাহাড় অরণ্যের মধ্যে তাও ধর্মের সাধকরা সাধনার স্থান করে নিয়েছিলেন। যেমন হিমালয়ের গুহায় বাস করতেন সন্ন্যাসীরা। তেমনি তাও ধর্মের সন্ন্যাসীরাও অরণ্য প্রকৃতির ভেতরে পাহাড়ের গুহায় নির্জন বাস করতেন। হয়তো কোনো রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হতো মন্দির। যখন আধুনিক সময়ে এসব জায়গায় টুরিস্ট স্পট গড়ে তোলা হয়, তখন পুরনো বনভূমি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। শুধু আগের যুগের তীর্থযাত্রী ও বর্তমানকালের পর্যটকদের সুবিধার্থে তৈরি করা হয়েছে পাথরের সিঁড়ি। কিন্তু পার্বত্য পথে সেই হাজার হাজার ধাপ সরু খাড়া সিঁড়ি ভাঙাটাও কম পরিশ্রমের কাজ নয়। হু হু করে শীতের বাতাস বইছে। পাহাড়ের উপর বাতাসের দাপট আরও বেশি। কিন্তু বাতাসে মিশে আছে নানা রকম বুনো ফুলের সুবাস। একটা সাদা বুনো ফুলের ঝোঁপ পাহাড়ের অনেকটা জায়গাজুড়ে। কিছুটা আমাদের হাসনাহেনার মতো সৌরভ। প্রাণ ভরে যায় সেই সৌরভে, সঙ্গে কাকলি- পাহাড়ি ঘুঘুর ডাক।
এরই ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে আমাদের ফটো সেশন। পাথরের উপর উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে আকাশ। একটা উঁচু পাথরের উপর দাঁড়ালাম। এখান থেকে কুনমিং শহরের উপত্যকা দেখা যায়। আরও দূরে রয়েছে তিয়ানশি লেক।
পাহাড়ের মধ্যে বিশ্রামের স্থান
হঠাৎ ছোট একটি দুর্ঘটনা ঘটলো! জাভারিয়া পাথর থেকে পা ফসকে একটু নিচে গড়িয়ে পড়ে। ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো যদি সে পাহাড়ের ভেতর দিকে না পড়ে, বাইরের দিকের খাড়া ঢালে গড়িয়ে পড়তো! ঠোঁট কেটে রক্ত গড়াচ্ছিল, দাঁতেও বেশ খানিকটা ব্যথা পেয়েছে। হাতে-পায়েও ছড়ে গেছে কিছুটা। এমন দুর্ঘটনার পর আরও এগুনো ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু জাভারিয়া এতদূর এসে ফিরে যাবার পাত্রী নয়। চোখে-মুখে একটু জল ছিটিয়ে সাহস করে আবার রওনা দিলো।
পাহাড়ের গা বেয়ে বুনো পাহাড়ি পথ ধরে একটু একটু করে উঠছি আমরা। চূড়ার কাছাকাছি এসে শুরু হলো ড্রাগন গেটের বিভিন্ন মন্দির। মন্দিরগুলো ঠিক যেন পাহাড়ের গায়ে বারান্দার মতো সাজানো। ভাবতে অবাক লাগে এত উঁচু পাহাড়ের গায়ে কীভাবে এই মন্দিরগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এগুলো তাও ধর্মের বিভিন্ন দেবতার নামে তৈরি। এখানকার প্রধান দেব হলেন শিল্প সাহিত্যের দেবতা। এই নির্জন, অপরূপ পাহাড়ি বনভূমিতে এলে অবশ্য আপনা থেকেই মনটা কাব্যিক হয়ে ওঠে। আমারও ইচ্ছা করছিল কোথাও বসে কবিতা পড়ি। এক জায়গায় রয়েছে একটা সৌভাগ্যের ফটক। সেটা ছুঁলে নাকি মনের ইচ্ছা পূরণ হয়।
শিল্প সাহিত্যের দেবতার মন্দির
এইসব মন্দির অনেক পুরনো। তবে মূল মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। মিং ও ছিং রাজবংশের আমলে। শুধু পাহাড়ের গা বেয়ে নয়, গুহার ভেতর দিয়েও যেতে হয় খানিকটা পথ। সেখানে চলাচলের জন্য রয়েছে সিঁড়ি। সিঁড়ি ও রেলিংগুলো এমন কৌশলে তৈরি, মনে হয় পাথরের ধাপ আর বাঁশের রেলিং। আসলে কিন্তু সিমেন্ট ও ইস্পাতের তৈরি মজবুত গাঁথুনি। প্রাচীন সিরামিকের তৈরি খোদাই করা রেলিং ও সিঁড়িও রয়েছে। মন্দির, পাহাড় সব জায়গাতেই অপূর্ব কারুকাজ আর ভাস্কর্যের খেলা।
চূড়ায় পৌঁছানোর পর পেলাম ড্রাগন গেট। এখান থেকে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত তিয়ানশি লেক। সে যে কি অপরূপ দৃশ্য তা আমার মতো আনাড়ির পক্ষে লিখে প্রকাশ করা কঠিন! নীলজলের বিশাল লেক পাহাড়ের ছবি বুকে করে চঞ্চল হয়ে উঠেছে ঢেউয়ের খেলায়। সেই ঢেউয়ের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে শীতের পাখি আর গাঙচিলের ঝাঁক। পাহাড়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লেকের জলে শেষ বিকেলের সূর্যের আভা দেখা অসীম সৌন্দর্যকে অনুভবের একটা আনন্দময় বেদনা সৃষ্টি করে বুকের ভেতর। নিজেও পাখা মেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পাখি তো নই। দুটি রোগা পা আমার অবলম্বন।
পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট বারান্দা
এবার নামার পালা। এটা আরও কঠিন। খাড়া পাহাড় বেয়ে নামতে গেলে মনে হয় এই বুঝি পা ফসকে পাতালে গেলাম। কিছু দূর নামার পর দেখলাম রোপওয়েতে চড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এই রোপওয়ে পাহাড় থেকে নেমে সোজা চলে গেছে তিয়ানশি লেকের উপর দিয়ে তীরভূমিতে। এই সুযোগ হাতছাড়া করার মানে হয় না। আমরাও চড়ে বসলাম রোপওয়ের ঝুলন্ত বাক্সে। পাহাড়ি বনভূমির উপর দিয়ে, লেকের নীল জলের ওপর দিয়ে ডানা মেলে উড়ে চললাম যেন। রোপওয়ে আমাদের পৌঁছে দিলো তিয়ানশির তীরে।
তিয়ানশি বিশাল লেক। তীর দেখলে মনে হয় বুঝি সমুদ্রের বেলাভূমি। এর আরেক নাম ‘মালভূমির মুক্তা’। তিয়ানশি চীনের অন্যতম বৃহৎ লেক। এর তীরেও রয়েছে পার্ক। এখানে বেড়াতে সূর্যাস্তের অপরূপ শোভা দেখছিলাম। সেই সঙ্গে গাঙচিলেল আনন্দ কলরব। আর শিশুদের হাস্যধ্বনি। কারণ পার্কের একটা অংশ থিম পার্ক। সেখানে শিশুরা বিভিন্ন রাইডে চড়ে আনন্দে মেতে আছে। বড়রাও রয়েছে সঙ্গে। সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। এখন ঘরে ফেরার পালা। অনন্য এক দিনের স্মৃতি নিয়ে ফিরে চললাম আমরা।
ঢাকা/তারা