ঢাকা     শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১৩ ১৪৩১

এশিয়ার সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৯, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৪:০১, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
এশিয়ার সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার

মোমের ময়ূর

চীনের কুনমিং শহরে ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়ে যাই ২০১৮ সালে। কুনমিং এয়ারপোর্টে প্রথম দিন আমাকে স্বাগত জানান দুই সহকর্মী কান লুথিং ও ইয়ে ছিয়েন ইউয়ান। তাদের হাতে ছিল চমৎকার একটি ফুলের তোড়া। বিদেশে প্রথম দেখায় ফুল দিয়ে স্বাগত জানালে কার না ভালো লাগে? তাদের কাছেই শুনলাম কুনমিং হলো ফুলের শহর।

ইন্টারনেটের বদৌলতে আমার জানা ছিল যে, কুনমিংয়ে রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার। সাবওয়েতে চড়ে যখনই এদিক-ওদিক যাই লক্ষ্য করি যে, দোওনান শনে গাড়ি থামলেই প্রচুরসংখ্যক যাত্রী ফুলের তোড়া, গাছ, ছোট ছোট প্ল্যান্ট পট ইত্যাদি নিয়ে ট্রেনে ওঠেন। এর মধ্যে একদিন উর্দু বিভাগের সহকর্মী জাভারিয়া চুঘতাই লাঞ্চের টেবিলে দোওনান ফ্লাওয়ার মার্কেটের কথা বললেন। তিনি যদিও আমার এক বছর আগেই এখানে এসেছেন, তবু তখন পর্যন্ত ফুলের বাজারে যাননি। আমরা পরিকল্পনা করলাম রোববার ছুটির দিনে ফুলের বাজার দেখতে যাব।

আরো পড়ুন:

হলুদ সূর্যমুখীর সমারোহ

সেই রোববারেই আমি ও জাভারিয়া ফুলের বাজারে অভিযান শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গী হলেন ভারতীয় শিক্ষার্থী সোমাইয়া। বাড়ির কাছেই সাবওয়ে স্টেশন। স্থির হলো সাবওয়ে দিয়েই যাব। তখন বাসরুট তেমন চিনতাম না। এখন অবশ্য জানি যে, বাসে দোওনানে যাওয়া আরও সহজ। ঠিক ফুলের বাজারের সামনেই বাস থামে। যাইহোক, প্রথমবার সাবওয়েতেই রওনা হলাম। দোওনান স্টেশনে এসে ট্রেন থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। ফুলের বাজার কোনদিকে ভাবছি। বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি। দেখি অনেক মানুষের হাতেই ফুলের বুকেট, ছোট তোড়া, গাছ, টব ইত্যাদি। বুঝলাম ওরা যেদিক থেকে আসছে, আমাদের সেদিকেই যেতে হবে। ফুটপাথে উঠে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। পথের দু’পাশে অজস্র গোলাপ ও অন্যান্য ফুল চোখে পড়ছে। রাস্তার মোড়েই বিশাল এক মঞ্চ। সম্পূর্ণ ফুল দিয়ে তৈরি। একটু এগোতেই দেখলাম সারি সারি নার্সারি দোকান। এগুলো ছোট প্ল্যান্ট, ক্যাকটাস ও বনসাইয়ের দোকান। মূল বাজারে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই দোকানগুলো শুরু হয়। প্রায় শ’খানেক দোকান। অজস্র বনসাই! দোকানগুলো সবই গ্রিন হাউজ ও ছোট-বড় নার্সারি।

বড় গাছও রয়েছে বিশাল টবে! সিরামিক টবগুলো দারুণ সুন্দর নকশা করা! একেবারে ছোট ছোট পট আছে। সেগুলোও চমৎকার। কত রকম যে বনসাই আর ক্যকটাস! ছোট ছোট ইনডোর প্ল্যান্ট। বনসাইগুলোর মধ্যে তিন চারশ বছরের পুরনোও রয়েছে। এগুলোর দামও সেরকম। লাখটাকা ছাড়া কথা নেই। নার্সারির দোকান পেরিয়ে বড় দুটি সড়ক ক্রস করে আমরা এগোলাম নতুন ফ্লাওয়ার মার্কেটের দিকে। মার্কেটে ঢোকার মুখেই রয়েছে বিশাল গেট। এবং বড় খোলা চত্বরের মাঝখানে রূপকথার রাজ্যের ছবি ও নানা রকম ফুলের ও পরীর ছবি দেওয়া বিশাল স্থাপনা। থিম পার্কে যেমন থাকে তেমনি। পুরো এলাকা হলো দোওনান ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাওয়ার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। 

বিভিন্ন ফুল গাছের চাড়া এবং ক্যাকটাস

এখানে পরপর কয়েকটি বিশালাকার মেগা শপিং মল। সবগুলোই ফ্লাওয়ার মার্কেট। বিসমিল্লাহ বলে ঢুকে পড়লাম একটিতে। সেকি বিশাল ভবন! একতলায় অসংখ্য ফুল কেনা বেচা হচ্ছে। অগণন দোকান। এই মার্কেটে ২০০ প্রজাতির ৩০০ মিলিয়নের বেশি ফুল প্রতিদিন কেনাবেচা হয়। প্রতিদিন ২.৫ মিলিয়ন আরএমবির(চীনা মুদ্রা) লেনদেন হয় এই মার্কেটে। ইউননান এয়ারলাইন্সের মতো বড় বড় ২০টি এয়ার কোম্পানি প্রতিদিন এই মার্কেট থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ফুল কেনে এবং চীনের অভ্যন্তরে ১০টি বড় শহরে ফুল সরবরাহ করে। বেইজিং, সাংহাইয়ের মতো বড় শহরগুলোতে এখান থেকে ফুল সরবরাহ হয়। এখান থেকে জাপান, সাউথ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এবং ইউরোপের ফুলের বাজারে ফুল যায়। এখানে বড় কয়েকটি মার্কেটে ফুলের নিলাম ডাকা হয়। একটি মার্কেটের নিলাম ঘরেই অন্তত ৫০০ পাইকারি ক্রেতা আছে। কয়েকটি মার্কেটে শুধু স্থানীয় ফুল বিক্রি হয়। গোলাপ, ওয়াটার লিলি, পদ্ম, মথ অর্কিড, ফরগেট-মি-নট, আফ্রিকান ডেইজি, ওপেন হার্ডিং, কারনেশন ফুলের বৈচিত্র্য, রং, সৌরভ আর পরিমাণ দেখে তো চোখ ট্যারা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বিশাল মার্কেটের আরেক দিকে রয়েছে টবের গাছ। এত বেশি গাছ যে মনে হয় একটি অরণ্যের ভেতর ঢুকে পড়েছি। ফুলের বীজও বিক্রি হচ্ছে। আর নানা রকম পট, ছোট বড়, ঝুলানো, স্ট্যান্ডসহ মাটির, সিরামিকের, প্লাস্টিকের টবের ছড়াছড়ি।

এসকেলেটর ব্যবহার করে উপরে উঠলাম। এখানে নানা রকম স্মল প্ল্যান্ট ও ছোট পট বিক্রি হয়। বাগান সাজাবার জন্য হরেক রকম এক্সেসরিজও পাওয়া যায়। তিনটি ছোট পট একসঙ্গে কিনলে দশ ইউয়ান মানে ১৩০ টাকা। দোওনান ফ্লাওয়ার মার্কেটে পরে অনেকবার গিয়েছি। আমি এবং সহকর্মী জাভারিয়া, ছাতুরিকা, রনিবালা ও রুহিমা একবার গিয়েছিলাম এই মার্কেটের পাশের অন্য আরেকটি শপিং মলে। বিশাল শপিং মল। এটি ড্রাই ফ্লাওয়ার এবং আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার শপিং মল। এখানে কি যে সুন্দর করে ফুল, গাছ, বাগানের শোপিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে দেখে মনে হয় নন্দন কানন।

ড্রাই ফ্লাওয়ার মার্কেট

এখানে বিশাল বিশাল ময়ূরের পুতুল রয়েছে। দেখলে জীবন্ত ময়ূর বলে মনে হয়। ইউননানের প্রতীক হলো ময়ূর। আর ময়ূর তো ফুলের বাগানেই থাকে। এই শপিং মলে ফুলের বাগান, ফুলের কুটির, দোলনা, বিশাল সব ফ্লাওয়ার ভাস, পাথরের নানা রকম ভাস্কর্য আছে। আরও আছে ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি নানা রকম সুগন্ধি, হারবাল মেডিসিন, সাবান, ঘরে রাখার জন্য পটপিউরি ইত্যাদি। অসংখ্য শোপিস তো আছেই। এর সঙ্গে সংযুক্ত আরেকটি বিশাল শপিংমলে রয়েছে রাজ্যের যত ট্র্যাডিশনাল পোশাক ও নানা রকম শিল্পসামগ্রী। কাঠের তৈরি কারুকাজ করা নানা রকম আসবাবও। তিব্বতি ও মোঙ্গলিয়ান শিল্পসামগ্রীর দোকানে গেলে মনে হয় সবকিছুই কিনে ফেলি। আরেকটি মার্কেট হলো চায়ের মার্কেট। বিশেষ করে ফুলের চা। হুয়াছা বা ফুলের চা চীনে খুব জনপ্রিয় একটি পানীয়। কত রকম ফুল থেকে যে এখানে চা তৈরি হয়। আরও আছে নানা রকম শিকড় ও ভেষজ সামগ্রী। আর গ্রিন টি ও ব্ল্যাক টি তো আছেই।

আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার মার্কেটটি হলো ফটোশুটের জন্য আইডিয়াল জায়গা। এখানে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনাতে বসে যেমন ছবি তোলা যায়, তেমনি চাঁদের দেশে, পরীর দেশে, পঙ্ক্ষীরাজে চড়েও ছবি তোলা সম্ভব। ফটোশুটের জন্য বিভিন্ন স্পট ঠিক করাই আছে। আমরা পাঁচ সহকর্মী তো রীতিমতো পাগল হয়ে ছবি তুলেছি।

শত বছরের বনসাইও আছে এখানে

এই মার্কেটের পেছনে রয়েছে সবজি ও ফুলের বীজের আরও অনেক মার্কেট। আমি আর শাহিনও(আমার হাজবেন্ড) এই ফুলের বাজারে অনেক ঘুরেছি। আমার উইনডো গার্ডেনের জন্য স্মল প্ল্যান্ট কিনতে হলেই ওখানে চলে যাই। কুনমিং শহর এবং সামগ্রিকভাবেই ইউননান প্রদেশের আবহাওয়া খুবই আরামদায়ক। চির বসন্তের আবহাওয়া। শীতও খুব বেশি নয়, গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই। বিশেষ করে ফুল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কুনমিংয়ের আশপাশের গ্রামগুলোতে অনেক ফুলচাষী আছেন। ফুলের খামার রয়েছে বিশাল বিশাল। আগে দোওনান এলাকাটি ছিল গ্রামের মধ্যে। এখন এটি শহরের ভেতরে চলে এসেছে। তবে দোওনানের কাছাকাছি রয়েছে প্রচুর ফুলের খামার। এইসব খামার থেকে ফুলের বাজারে বেশ সহজেই ফুল আসতে পারে। সে কারণে এখানে ফুলের দামও শহরের অন্যান্য দোকান বা চীনের অন্যান্য শহরের ফুলবাজারের চেয়ে কম। কুনমিং শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে একটু দূরে উপকণ্ঠ ছেংকং-এ ইংবিন এভিনিউতে এই দোওনান বাজার। সিটি হার্ট-এ আরেকটি ফুলের বাজার রয়েছে। সেখানে ফুল ও পাখি বিক্রি হয়। এর আশপাশে রয়েছে পেটশপ। দোওনান ফ্লাওয়ার মার্কেটের সঙ্গেই রয়েছে রেস্টুরেন্ট পাড়া। ঐতিহ্যবাহী, স্থানীয়, ওয়েস্টার্ন সবরকম খাবার পাওয়া যায় এসব রেস্টুরেন্টে। মুসলিম রেস্টুরেন্টও রয়েছে বৈকি।

কুনমিংকে বলা হয় ফুলের শহর। শুধু এই ফুলের বাজারের জন্যই নয়। এই শহরে প্রতিটি রাজপথের পাশে রয়েছে গোলাপ, পিওনি, চেরি ফুলের বাগান। শহরটাই যেন ফুলের বাগান। সারা বছরই কোনো না কোনো রকম ফুল ফুটতেই থাকে। চেরি ফুল ফোটার জন্য তো রয়েছে বিশেষ উৎসব। যারা বাংলাদেশ থেকে ব্যবসার কাজে কুনমিং যান তারা সময় করে দোওনান ফুলের বাজারে উঁকি দিতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন রকম মৌসুমি ফুল এই বাজারে রপ্তানির চিন্তাভাবনাও করতে পারেন।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়