ঢাকা     বুধবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৩ ১৪৩১

হ্যানয়ের পথে বাংলাদেশের রিকশা

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১০, ২৫ মে ২০২১   আপডেট: ১৮:২৩, ২৫ মে ২০২১
হ্যানয়ের পথে বাংলাদেশের রিকশা

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ৯ম পর্ব

লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল বুঝতে পারিনি। পথের উন্মুক্ত দোকানে একাকী বৃদ্ধাকে দেখে আগ্রহ হলো। কোনো খদ্দের নেই, হাঁড়িতে কিছু একটা জ্বাল হচ্ছে। পাশে কাঁচা শাকপাতা ও মশলাপাতি সাজিয়ে রাখা। সামনে প্লাস্টিকের দুটি টুল নিয়ে বসে আছেন, কখন একজন লক্ষ্মী খদ্দের এসে বসবে, তারপর তিনি যত্ন করে খাওয়াবেন!

কয়েক মুহূর্তের পর্যবেক্ষণে সিদ্ধান্ত নেই এ বেলার খাবারটা বৃদ্ধার দোকানেই খাবো। একটা কড়ির বাটিতে বেশখানিকটা নুডুলস, তার উপর কিছু শাকপাতা দিয়ে ঢেলে দিলেন টলটলে সুরুয়া। এরপর যোগ করলেন মাংস আর চর্বির চাকা চাকা কয়েকটা টুকরো এবং মড়মড় শব্দে ভেঙে দিলেন পাঁপড় জাতীয় কিছু একটা। সব শেষে বুঝিয়ে দিলেন সামনে সাজানো মশলাগুলো কোনটা কি পরিমাণ যোগ করতে হবে। তারপর গালে হাত দিয়ে দেখতে থাকলেন আমার খাওয়ার দৃশ্য।

চপস্টিকস দিয়ে তুলে খেতে সামান্য অসুবিধা হচ্ছে দেখে মুচকি হেসে একটা চামচ বাড়িয়ে দিলে আমি তাতে না করলাম। এক হাতে বাটি অন্য হাতে চপস্টিকস। সুতরাং খেতে খুব একটা সুবিধাও করা যাচ্ছে না। স্টিকস থেকে একগুচ্ছ নুডুলস মাটিতে পড়ে গেলে আমার বোকা বনে যাওয়া চেহারা দেখে আবারও একটা মুচকি হাসি দিলেন তিনি। এরপর আমার প্রতি তার মায়া নাকি ভালোবাসা জাগল জানি না। হাঁড়ি থেকে আরও কয়েকটা মাংস ও ভুঁড়ির টুকরো তুলে দিলেন। তাতেও যেন তার সাধ মিটল না। আর এক পাত্রের ঢাকনা তুলে সিদ্ধ টমেটো দেখিয়ে বলল-দেবো? এমন ভালোবাসার আহ্বান ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য কি আমার আছে?

খাবার খেতে বেশ সময় লেগে গেল। পুরোটা সময় ধরেই তিনি যেন আমাকে সঙ্গ দিয়ে গেলেন। পেট ভরে খাওয়া শেষে মূল্য পরিশোধ করতে হলো ত্রিশ হাজার ডং। কথায় কথায় এখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, তবে ডলারে হিসাব করতে গেলে বুকের বাম পাশের টনটন করে ওঠা ব্যথাটা অপসারণ হতে সময় লাগে না। ভিয়েতনামের মূদ্রা ডং, প্রতি ডলারে বিপরীতে তেইশ হাজার!

হ্যানয়ে আমার ভ্রমণ পায়ে হেঁটেই চলছে। গাড়িতে চড়তে হয় এমন কোনো গন্তব্য ঠিক করিনি। এর পরের গন্তব্য হ্রদ। ইংরেজিতে লেক সাইড বলেই পরিচিত। তার আগে হোস্টেলে ফিরে একটু বিশ্রাম করা দরকার। ডরমেটরি জনশূন্য কেবল পর্দা টেনে দেয়া বিছানাটাতে আগের মতোই আলো জ্বলছে। একটুখানি ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ভিতরে লোকটি ল্যাপটপে খুটখাট চলমান। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখি তিনি একইভাবে বালিশে হেলান দিয়ে কাজে ধ্যান রেখেছেন। একটু পর বের হয়ে বাথরুমে চলে গেলেন। বয়স পঞ্চাশের উপরে, মুখে চাপা দাড়ি। কে জানে এখানে কত দিন হলো সংসার পেতেছে? আয়োজন দেখে অনুমান করা যায় দশ-পনেরো দিনের কম নয়। দুইতলা বিছানার নিচতলায় হওয়ায় তার একটা ছাদ মিলে গেছে। ছাদজুড়ে নানান কিছু ঝুলছে। তার মধ্যে পাকা কলার একটা কাঁদিও আছে। ব্যপারটা আমার কৌতূহল সৃষ্টি করলো। কিন্তু সেটা যে মোটেও সমীচীন হচ্ছে না পরক্ষণেই অনুধাবন করার পর বরং নিজের কাজে মনোনিবেশ করলাম।

হ্যানয় ভ্রমণের এই সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারলাম এখানে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ অনেক কিছুই আছে, যা এড়ানো যায় না। ভিয়েতনাম ভ্রমণে আমার প্রধান লক্ষ্য সা পা। সুতরাং ভ্রমণ পূর্ব প্রস্তুতিতে হ্যানয় নিয়ে ভাববার প্রয়োজন বোধ করিনি। এ পর্যায়ে মনে হলো হ্যানয়ের জন্য কমপক্ষে আর একটা দিন বরাদ্দ রাখা যেতো। যাই হোক, পরের দিন সা পা যাত্রা করবো সকাল ছয়টায়, তাই আগেভাগেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম। বিকেলে বের হবো লেকসাইড দেখতে। সেখানে সকালে পরিচয় হওয়া শিক্ষার্থী তরুণীদ্বয়ের সঙ্গে দেখা হবার কথা আছে। হ্যানয়ে আমার মতো তারাও পর্যটক, এসেছে সেই হো চি মিন সিটি থেকে।

ঘোরাঘুরির শেষ পর্যায়ে আলাপচারিতায় যখন বেরিয়ে আসে, আগের দিন হো চি মিন থেকে হ্যানয় আমরা একই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলাম। তখন ব্যপারটাকে একটা কাকতাল বলে মনে হলো। এই ঘটনাই যেন আবারও দেখা হওয়ার জন্য দারুণ একটা সূত্র হয়ে হাজির হলো। ভিয়েতনামে আমার কোনো ফোন নাম্বার নেই। সুতরাং, তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে, যেই আগে পৌঁছি না কেন লেক সাইডের যে জায়গাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দর বা আকর্ষণীয় বলে বিবেচনা করা হয়; বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করবো। এর মধ্যে যদি দেখা হয় তাহলে আর এক দফা আলাপচারিতা এবং ঘোরাঘুরি, আর যদি না হয় তাহলে বিধি বাম বলে ধরে নেয়া হবে।

হ্যানয়ের পথেও বাংলাদেশের মত রিকশা চলে, তবে তার আনুষ্ঠানিকতায় ভিন্নতা আছে। অর্থাৎ, শুধু পর্যটকদের শখ করে চড়ার জন্য। হোস্টেল থেকে বিশ মিনিট হাঁটলেই লেকসাইড এলাকা শুরু। এই পথটুকু হাঁটতে গিয়ে সাক্ষাত হলো এক সারি রিকশার সঙ্গে। রিকশা হলেও নকশায় ঠিক আমাদের দেশের মতো নয় বরং সম্পূর্ণ উল্টো। চালক থাকে পিছনে। একদল পশ্চিমা পর্যটকবাহী দশ-পনেরটা রিকশা এগিয়ে চলেছে শহরের পথে পথে। প্রতিটি রিকশায় একজন করে বসেছে। একটার পিছনে আর একটা লাইন ধরে এগিয়ে চলেছে। দৃশ্যটা খুবই সুন্দর লাগল কিন্ত রিকশায় বসা প্রতিটি যাত্রীকে একেকটা নির্বোধ প্রাণীর মতো মনে হলো। কোনো নড়চড়া নেই, অবুঝ শিশুদের মতো শুধু হাঁ করে তাকিয়ে আছে। একজন তো ঘুমিয়ে পড়েছে। নিকটে গেলে বোধহয় নাক ডাকার শব্দও পাওয়া যেতো। চলতি পথের সমস্ত মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেকটা পথ তাদের সঙ্গেই চললাম।

লেকসাইডের মুখেই একটা প্রাঙ্গণ। এখান থেকে দুদিকে দুটি পথ। আবার মিলিত হয়েছে ঠিক অপর প্রান্তে গিয়ে। আমি বরং ডানের পথ ধরে এগুতে থাকলাম। লেকের প্রাকৃতিক পরিবেশ আটপৌড়ে, তবে চারপাশের সার্বিক আয়োজন উন্নত এবং জাঁকজমকপূর্ণ। লেকের মাঝে একটা ঈষৎ উঁচু ঘাসের চত্বর, তার উপর একটা চারতলাবিশিষ্ট ঘর। দেখে বোঝা যায় পুরনো স্থাপনা। এর বেশি সবিস্তারে কিছু জানতে পারিনি। ধর্মীয় স্থাপনা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যদি তাই হতো তাহলে জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকার কথা না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, হ্যানয়ের রাস্তায় রাস্তায় কম তো ঘোরা হলো না, এখন পর্যন্ত ধর্মালয় দূরের কথা ধর্মীয় ভাবাবেগসম্পন্ন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ল না। মনে পড়ল আগের দিন টীনের সাথে আলাপচারিতার সামান্য কিছু অংশের কথা। কথাপ্রসঙ্গে তার ধর্ম সম্বন্ধে জানতে চাইলে ছোট্ট করে একটা নির্লিপ্ত উত্তর দিয়েছিল- নো রিলিজিয়ন। যেন এর চেয়ে কমদামী জিজ্ঞাসা আর হতেই পারে না।

যে কোনো আলাপচারিতায় এই প্রসঙ্গটা আমার সব থেকে অপ্রিয় এবং অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কিন্তু তার সাথে কথার মাঝে প্রসঙ্গটা কি করে যে চলে এসেছিল বুঝতে পারিনি। তবে টীনের সংক্ষিপ্ত উত্তরের মধ্যে ভিয়েতনামের জনগণের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীর একটা গড়পর্তা পরিচিতি পাওয়া যায়। যাইহোক, লেকটা যথেষ্ট চওড়া এবং দীর্ঘ। পুরোটা এক চক্কর দেয়ার পর মনে হলো, কম করে হলেও দুই বর্গকিলোমিটার হবে। সব ঠিক আছে কিন্তু সমস্ত এলাকা খুঁজে যে জায়গাটা আমার কাছে সুন্দর বলে বিবেচিত হলো সেখানে ঘড়ি ধরে আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর অতিরিক্ত আরও পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম। কে জানে, আমার কাছে যা সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় তাদের কাছে তা নাও হতে পারে। এমনটা যে ঘটতে পারে মনে মনে আগে থেকেই তার একটা প্রস্তুতি ছিল। মাঝখান থেকে যা হলো, তাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অতি সামান্য অথচ চিত্তাকর্ষক একটা জিনিস দেখার সুযোগ ঘটল। স্থানীয় সনাতনি ধূমপানের আয়োজন ও ধরনের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতীসত্তা চাকমাদের পদ্ধতির ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পেলাম। দুই ফুট পরিমাণ একটা বাঁশ এবং তাতে ফুটা করে একটা কলকে যুক্ত করে দেয়া। সেক্ষেত্রে চাকমারা ব্যবহার করে মোটা বাঁশ এবং কলকে সংযুক্ত করে থাকে বাঁশের উপরিভাগে। অর্থাৎ যেখানে মুখ লাগিয়ে ধূমপান করা হয় ঠিক তার কয়েক ইঞ্চি নিচে।

ওদিকে ভিয়েতনামিজরা ব্যবহার করে তুলনামূলক চিকন বাঁশ। আর কলকের মতো অংশটা সংযুক্ত করা থাকে বাঁশের গোড়া থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে। তবে ধূমপানের ধরনে ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে, ভিয়েতনামিজরা কলকেতে তামাক পাতা রেখে দীর্ঘক্ষণ ধরে হুকায় দম নেয়ার মতো করে ধূমপান করে না। বরং তামাকের মিশ্রণটি কলকেতে রেখে আগুন ধরিয়েই জোরসে একটা টান দিয়ে সমস্ত ধোঁয়া টেনে নেয়। (চলবে)

পড়ুন সপ্তম পর্ব: হো চি মিনের সমাধিতে একদিন

 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়