ঢাকা     শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১

মাথিনের কূপ: বিরহী প্রেমের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন

আঁখি সিদ্দিকা  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১  
মাথিনের কূপ: বিরহী প্রেমের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন

কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে ...

কিন্তু ১৯৩০ সালে লাহোরের ইউনিক পাবলিকেশন্স থেকে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ প্রকাশ করে ধীরাজ ভট্টাচার্য নিজেই বিপত্তি ঘটিয়েছিলেন, তার বেদনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সব প্রেমিকের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়েছিলেন, ইতিহাস তৈরি করেছিলেন, অমর করেছিলেন তার প্রেম। ধীরাজ-মাথিনের বিয়োগান্তক প্রেমের গল্প লিখেছেন তিনি।

শত বছর আগের এই গল্পটি সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানা—অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশির পাশেই এক পাতকুয়াকে কেন্দ্র করে এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল। অবারিত জলরাশি থাকলে কি হবে সমুদ্রের জল তো পান করা যায় না। তাই টেকনাফ থানার পক্ষ থেকে তৈরি করা হয় স্থানীয়দের জন্য একটি পাতকুয়া। সেই কুয়ার নামই আজকের মাথিনের কূপ। কিন্তু কী করে একটি কূপ ঐতিহাসিক হয়ে উঠলো; কী ছিল ‘যখন আমি পুলিশ ছিলাম’ বইয়ে। যা পাঠ করে ১৯৮৪ সালে প্রায় ৭৫ বছর পরে কোনো এক তরুণের মনে হয় কূপটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

টেকনাফে মাথিনের কূপের উৎস সন্ধানকারী সেই তরুণের নাম আবদুল কুদ্দুস রানা। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি সত্য প্রেমের এক বেদনার্ত অধ্যায়। এই অধ্যায় তুলে ধরতে ১৯৮৪ সালে একটি সাইন বোর্ড টাঙিয়ে আমি মাথিনের কূপটি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।’ কূপটি সংরক্ষণের ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, ‘আমি তখন স্কুল ছাত্র। কলকাতা থেকে কিছু সাংবাদিক টেকনাফ এসেছিল। তখন তারা সঙ্গে করে কিছু বই নিয়ে এসেছিল। ওই বইটির নাম ছিল: ‘যখন পুলিশ ছিলাম’। বইয়ের কভার ছিল না। বইটির ভেতরে তিন-চার পৃষ্ঠায় ধীরাজের লেখা একটি চিঠি ছিল। ঐতিহাসিক মাথিনের কূপের এই কাহিনি জানার পরে আমি তখন কূপটিতে ১৭৫ টাকা খরচ করে একটি টিনের সাইন বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ লাখ পর্যটক মাথিনের কূপ দেখতে আসেন। টেকনাফ মানে মাথিনের কূপ, মাথিনের কূপ মানে টেকনাফ। 

পরবর্তীকালে তাঁদের অমর প্রেমের আত্মত্যাগের নিদর্শন হিসেবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জায়গাটি সংরক্ষণ করে। ২০০৬ সালে ধীরাজ-মাথিনের মর্মান্তিক প্রেম কাহিনির প্রায় ৮০ বছর পর টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালেদ হোসেন, সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস রানাকে সাথে নিয়ে এ কূপটির সংস্কার কার্যক্রম সমাপণ করেন। এরপর থেকে এটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে সর্বত্র পরিচিতি পায়।

১৯২৩-১৯২৪ সালের দিকে টেকনাফে বদলি হয়ে আসেন অবয়বে সুদর্শন যুবক ধীরাজ। দস্যুতা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে এবং ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য টেকনাফে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। সেই ফাঁড়িরই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আসেন তিনি। থানায় ধীরাজ ভট্টাচার্যের খুব একটা বেশি কাজের চাপ ছিল না। বেশির ভাগ সময় এখানে-সেখানে ঘুরে-ফিরে কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে।

তখন টেকনাফে সুপেয় পানির খুব অভাব ছিল। সমগ্র টেকনাফের মধ্যে থানা কম্পাউন্ডে তখন একমাত্র বিশাল একটি পানির কূপ ছিল। এই কূপেই সুপেয় পানির জন্য রোজ ভিড় জমাত স্থানীয়রা। আশপাশের রাখাইন তরুণীরাই বেশি আসত পানি নিতে। হঠাৎ একদিন স্থানীয় জমিদার ওয়াং থিনের একমাত্র রূপবতী কন্যা মাথিনকে  দেখে তিনি অবাক হন। রাখাইন কিন্তু অবিকল বাঙালির মতো দেখতে। রাখাইন পোষাকে কানে জবাফুল গুজে আসা মেয়েটির প্রেমে পরে যান ধীরাজ। মুগ্ধ ধীরাজ  এরপর থেকে প্রতিদিন ভোরবেলা থানার বারান্দায় বসে মাথিনের আসা-যাওয়া দেখতেন। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক।

প্রণয়কে পাকা করতে এক সময় নিজেরা বিয়ের জন্যও প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সমাজের আচারের বাইরে যেতে রাজি ছিলেন না মাথিন। বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েই নিজস্ব রীতিতে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন তারা। বিয়ের কথা পাকাও হয়। যখন সব ঠিকঠাক, বাকি নেই বেশি দিন, তখনই অযাচিত বাধা আসে। বিষয়টি থানার ব্রিটিশ ওসির নজরে পড়ে যায়। তিনি গোপনে খবরটি ধীরাজের বাবাকে জানান।

কলকাতা থেকে একদিন দারোগা ধীরাজের কাছে ব্রাহ্মণ পিতার জরুরি টেলিবার্তা আসে। যেখানে তার বাবা লিখেছিলেন খুব জরুরি তাকে কলকাতা যেতে হবে। বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ধীরাজ। তবে যাওয়ার আগে দ্রুত ফিরে এসে মাথিনকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। কিন্তু পরে ধীরাজ আর ফিরে আসেননি। ওদিকে মাথিন বিয়ে না করে ধীরাজের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। অনাহার-অনিদ্রায় মৃত্যুদূতের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেন মাথিন। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন, প্রেম মানে নিবেদিত প্রাণের সাধনা। সে কারণেই হয়তো মাথিনের প্রেম-কাহিনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বলেন, ‘বিষাদ আর বেদনাবিধুর এক অমর প্রেমের গল্প ধরে রাখতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাথিনের কূপের পাশে ধীরাজের আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের পাশাপাশি স্মৃতি সংরক্ষণেও নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ইতোমধ্যে মাথিনের কূপটি নানাভাবে সংস্কারের আওতায় নিয়ে এসে পর্যটকদের তীর্থস্থান হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে।’

ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে এই কূপটির সীমানা প্রাচীর পুনঃনির্মাণ, ফুলের বাগান, সৌন্দর্য বর্ধিত রাস্তা নির্মাণ, চেরাংঘর মেরামত ও কূপের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। রঙিন সাজে সাজানো হয়েছে কূপটি। এতে করে পর্যটকরা আরও বেশি মুগ্ধ হচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন।

 

উল্লেখ্য, টেকনাফ ত্যাগের পর পুলিশের চাকরি ছেড়ে ১৯২৫ সালে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি দুটি আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থ রচনা করেন। একটির নাম ‘যখন পুলিশ ছিলাম’, আরেকটি হলো ‘যখন নায়ক ছিলাম’।

তবে টেকনাফে মাথিনের নামে কূপ তৈরি হলেও মাথিনের কোনো আবক্ষ মূর্তি নেই। এ বিষয়ে থানা থেকে জানা গেল যে, ধীরাজ ভট্টাচার্য পুলিশ হওয়ায় তার একটি ছবি পাওয়া যায় এবং সেই আলোকে আবক্ষ তৈরি করা হয়। কিন্ত মাথিনের কোনো ছবি বা তার পরিবাররের কাউকে না পাওয়ায় আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা যায়নি। তবে ধীরাজ ভট্টাচার্যের আবক্ষের পাশে একটি একাকী জন্ম নেয়া গাছ চোখে পড়লে বিস্মিত হই এই ভেবে যে, মাথিন এই গাছ হয়ে এখনও ধীরাজের পাশেই আছেন। আর ধীরাজ যেনো কূপের দিকে তাকিয়ে বলছেন- তোমরা শব্দ করো না, মাথিনের ঘুম ভেঙে যাবে। প্রেমের এমন অনুভব পেতে হলে আপনাকে আসতে হবে মাথিনের কূপে। 

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফ যাওয়া যায় সড়কপথে। এ পথে চলাচলকারী এসি বাস হলো সেন্টমার্টিন সার্ভিস। এ ছাড়া শ্যামলী পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস, হানিফ এন্টারপ্রাইজের নন-এসি বাস চলে এই পথে। কক্সবাজার থেকে বাস ও মাইক্রোবাসে টেকনাফ যাওয়া যায়। বাস ভাড়া পড়বে ৮০ থেকে ১২০ টাকা। আর মাইক্রোবাসে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের বাস ছাড়ে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে আর মাইক্রোবাস ছাড়ে শহরের কলাতলী এবং টেকনাফ বাইপাস মোড় থেকে। টেকনাফ পৌঁছে হেঁটে অথবা রিকশায় টেকনাফ থানায় যেতে হবে। থানার ভেতরেই মাথিনের কূপ। এছাড়া কক্সবাজার থেকে যেতে চাইলে বাসে যেতে পারেন। 

কোথায় থাকবেন

টেকনাফে থাকার জন্য আছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেল। মোটেলটি টেকনাফ শহরের প্রায় আট কিলোমিটার আগে। ঢাকার পর্যটন কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় থেকে মোটেল বুকিং করতে পারবেন। তবে যদি টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের একেবারে কাছাকাছি থাকতে চান তাহলে আছে সেন্ট্রাল রিসোর্ট। এ ছাড়া এখানে সাগরকন্যা, মেঘ বালিকা ও নীলাচল নামে তিনটি কটেজ আছে। প্রতিটি কটেজে আছে দুটি করে রুম। ঢাকা থেকেও এই রিসোর্টে আগাম বুকিং দিতে পারবেন।

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়