ঢাকা     রোববার   ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ||  ফাল্গুন ১০ ১৪৩১

‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ সিলেটে বেড়ানোর আদ্যোপান্ত

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:৪৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১
‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ সিলেটে বেড়ানোর আদ্যোপান্ত

ডিবির হাওর

১৯১৯ সালের ৭ নভেম্বর সিলেট মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজে বক্তৃতা দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা মুগ্ধ করেছিল উপস্থিত শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে একজন পরে এ নিয়ে চিঠি লেখেন কবিকে। এই শিক্ষার্থীর নাম সৈয়দ মুজতবা আলী। এমসি কলেজে বক্তৃতা দেয়ার দুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ আসেন সিলেটে। যা তখন ‘শ্রীহট্ট’ নামে খ্যাত ছিল। কবিগুরু ভালোবেসে এর নাম দিলেন ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’।  করোনাকাল পেড়িয়ে এখন অনেকের মন ছটফট করছে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়ার জন্য। এ সময় যারা সিলেটে যেতে চান তাদের জন্যই এই লেখা।

জুগিরকান্দি মায়াবন

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এটি একটি জলারবন। গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নে জুগিরকান্দি হাওরে অবস্থিত এ নয়নাভিরাম বনের নাম স্থানীয়ভাবে দেয়া হয়েছে ‘মায়াবন’। প্রায় এক হাজার একর ভূমিজুড়ে বিস্তির্ণ এই বন তার রূপের মায়াবী ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পর্যটকদের মন আকৃষ্ট করে। মায়াবনের চারদিকের অথৈ পানিতে সারি সারি গাছের বিশাল এক জঙ্গল।

আরো পড়ুন:

জলারবনের নিবিড় প্রকৃতি মনকে নিয়ে যায় রূপকথার দেশে। যেখানে প্রবেশ করলে আর ফিরে আসতে মন চায় না। ডাহুক, ঘুঘু, সারি, দোয়েল-শ্যামাসহ নাম না জানা অসংখ্য প্রজাতির পাখির কূজনে বিমোহিত প্রাণ বনের গভীর থেকে গভীরে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা যোগায়। স্বচ্ছ-স্নিগ্ধ পানির উপরে পতিত বৃক্ষের জল ছবিতে পানসির দোলানো ছোট ছোট ঢেউ যেন চতুর্দর্শী নর্তকির নৃত্যাভিনয়। এই মায়াবনের উত্তরে রয়েছে সারি ও পিয়াইন নদীর মিলনস্থল। অদূরে রয়েছে ভারতের মেঘালয়। 
জুগিরকান্দি মায়াবনে আছে মাছরাঙা, বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, ফিঙে, বালিহাঁস, পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির পাখি। বন্যপ্রাণীর মধ্যে আছে বানর, উদবিড়াল, কাঠবিড়ালি, মেছোবাঘ ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রজাতির গুঁইসাপ ও নানা ধরনের সাপের অভয়াশ্রম এই বন। নিঃশব্দে ঘুরলে পানির ভেতর অবস্থিত এই বনে ঘুঘুর ডাক, বানরের লাফালাফি দেখা যায়। এটাই মায়াবনের সৌন্দর্য।

ডিবির হাওর

সিলেটের জৈন্তাপুরে জৈন্তরাজ্যের রাজা রাম সিংহের স্মৃতিবিজড়িত ডিবির হাওর মূলত ইয়াম, হরফকাটা কেন্দ্রীবিলসহ চারটি বিলের সমষ্টি। বিলগুলোকে কেন্দ্র করেই নাম রাখা হয়েছে ডিবির হাওর। চারটি বিলের অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে। বিলগুলো শাপলার সময়ে শাপলার রাজ্যে রূপ নেয়। লতা-পাতা-গুল্মে ভরা বিলের পানিতে শত-হাজারো লাল শাপলা হার মানায় ভোরের সূর্যের আলোকেও। সবুজ পাতার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশি। ভোরের আলোয় শাপলার হাসি আরও আলোকিত করে বিলগুলোকে।

বেড়াতে আসা যে কোনো ভ্রমণপিপাসুর মনের দুয়ার খুলে দেবে এই শাপলা বিল। একটি ধ্বংসপ্রায় মন্দির আছে ডিবির হাওরের মাঝখানে। যে কেউ চাইলে মন্দিরটি ঘুরে দেখতে পারেন। জৈন্তা রাজ্যের এক রাজাকে এই হাওরে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। সেই স্মৃতিতেই নির্মিত দুইশ বছরের পুরাতন এ মন্দির এখন জীর্ণ-শীর্ণ। প্রাচীন রাজার স্মৃতিবিজড়িত এ হাওরে শীতকালে থাকে পাখিদের রাজত্ব। বিশাল হাওর শুকিয়ে যেটুকু জলাশয় তার ওপরই পাখিদের বিচরণ বেশি। বালিহাঁস, পাতিসরালি,পানকৌড়ি, সাদাবক ও জল ময়ুরীর মতো অতিথি পাখির ডানা ঝাপটায় অন্যরূপে সাঁজে এ হাওর। সিলেট শহর থেকে ৪২ কিলোমিটারের যাত্রাপথ। শাপলার পূর্ণ রূপ দেখতে ভ্রমণপিপাসুদের পৌঁছাতে হবে ভোরে। সূর্যের আলো ফোটার আগেই ফুটন্ত শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। বিলের পাশে মেঘালয়, পাহাড়ের নিচে খাসিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস। হরফকাটা ও ডিবি বিলের মধ্যে রয়েছে রাজা রাম সিংহের সমাধিস্থল। দূর পাহাড়ে দেখা মিলবে খাসিয়াদের পান-সুপারির বাগান। প্রকৃতির বুকে শিল্পীর তুলিতে আঁকা এ যেন এক নকশিকাঁথা।

খাদিম ফরেস্ট 

সিলেট শহর থেকে জাফলং রোড ধরে ১০ কি.মি. এগুলেই শাহপরাণ মাজার গেট পেরুনোর পরপরই খাদিম চৌমুহনা। এখান থেকে হাতের ডানদিকে চলে গেছে রাস্তা। রাস্তা ধরে সামনে গেলে খাদিমনগর চা বাগানের শুরু। বাগানের রাস্তা ধরে আরেকটু সামনে গেলে একটা কালভার্ট। কালভার্ট পেরিয়ে বামের রাস্তা না ধরে পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকলে আরো চা বাগান। চা বাগানের পর প্রাকৃতিক বনের হাতছানি। মূল সড়ক থেকে উত্তরের দিকে পাকা, কাঁচা ও ইট বিছানো পাঁচ কি.মি. পথ পেরুনোর পর খাদিমনগর রেইন ফরেস্টের শুরু। পূর্বে ছড়াগাঙ্গ ও হাবিবনগর, পশ্চিমে বরজান ও কালাগুল, উত্তরে গুলনি, দক্ষিণে খাদিমনগর এই ছয়টি চা বাগানের মাঝখানে ১৬৭৩ একর পাহাড় ও প্রাকৃতিক বনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই রেইন ফরেস্ট জাতীয় উদ্যান বলে সরকারী স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ইউএসএইড-এর সহায়তায় এর ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে।

খাদিমনগর ন্যাশনাল পার্কে হাঁটার জন্য ৪৫ মিনিট ও দুই ঘণ্টার দুটো ট্রেইল আছে। বনবিভাগের বিট অফিসের সামনে ট্রেইল দুটোর মানচিত্র দেয়া আছে, এ ছাড়া স্থানীয় কাউকে গাইড হিসাবেও সঙ্গে নেয়া যেতে পারে। রেইন ফরেস্টের সামনে দিয়ে উত্তর দিকে যে রাস্তা চলে গেছে, সে দিক দিয়ে এগিয়ে গেলে এয়ারপোর্ট-হরিপুর সড়কে ওঠা যায়, সেখান থেকে আবার রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে সহজেই যাওয়া সম্ভব। কোনো পর্যটক যদি একদিনের জন্য সিলেট ঘুরতে চান সে ক্ষেত্রে এই পথটি ব্যবহার করে চা-বাগান, রেইন ফরেস্ট, সোয়াম ফরেস্ট দেখে যেতে পারেন।এই পথের অধিকাংশ কাঁচা ও ইট বিছানো হলে ও গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। তবে বৃষ্টি থাকলে সে ক্ষেত্রে সিএনজি নিয়ে যাওয়া ভালো। খাদিম চৌমুহনাতে ভাড়ায় সিএনজি পাওয়া যায়।

যাবেন কীভাবে, থাকবেন কোথায়

দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে প্রথমে আসতে হবে সিলেট শহরে। সিলেট শহর থেকে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক হয়ে ৩৭ কিলোমিটার অতিক্রম করার পর সারিঘাট নামক স্থান থেকে সারিঘাট-গোয়াইনঘাট সড়কে দিয়ে আরও ৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে বেখরা ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে থামতে হবে। এখান থেকে ছোট নৌকা ভাড়া করে বেখরা খাল হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। খালের দুই তীরজুড়ে শ্যামল চাদরে আবৃত লোকায়ত বাংলার রূপ দেখতে দেখতে মিনিট দশেকের মাথায় প্রবেশ করতে পারবেন মায়াবন।

জুগিরকান্দি মায়াবনের আশেপাশে থাকার কোনো হোটেল নেই। সিলেট শহরে এসে থাকতে হবে। তবে চাইলে  তামাবিল, জৈন্তাপুরের দিকে জৈন্তিয়া হিল রিসোর্ট  আছে সেখানে থাকতে পারেন। মোবাইল নাম্বার:  ০১৭১১৩২৪১৭৩

সিলেট থেকে সরাসরি সিলেট-তামাবিল সড়কপথে বাস, লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা অথবা প্রাইভেট কারে আসতে হবে জৈন্তাপুরে। জৈন্তাপুর বাজার থেকে কিছ দূর গেলেই সড়কের ডান দিকে দেখা যাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ডিবির হাওর বিশেষ ক্যাম্প। ক্যাম্পের পাশ দিয়ে কাঁচা সড়কে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন শাপলা বিলে। নৌকার ভাড়া নেবে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। সারা দিনের জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নেবে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা। কাছাকাছি কোনো রেস্টুরেন্ট  না থাকায় সঙ্গে শুকনো খাবার রাখতে পারেন। 

ডিবির বিলের আশেপাশে আবাসিক হোটেল নেই। চাইলে কিছু দূরে জৈন্তিয়া হিল রিসোর্টে রাত্রিযাপন করতে পারেন।

সিলেটে থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় যাওয়া যায় খাদিমনগর ন্যাশনাল পার্কে। সিলেট শহর থেকে জাফলং রোড ধরে ১০ কি.মি. এগুলেই শাহপরাণ মাজার গেট পেরুনোর পরপরই খাদিম ফরেস্ট । খাদিম ফরেস্টে আছে শুকতারা রিসোর্ট। সেখানে থাকা যাবে। মোবাইল নাম্বার: ০১৭৬৪৫৪৩৫৩৫  (চলবে)

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়