ইন্দোনেশিয়ায় এক সপ্তাহ: ৩য় পর্ব
হোটেলটার প্রবেশমুখ অনেকটা রিসোর্টের মতো। চারদিকে গাছপালার বুনট অন্ধকার। তার মধ্যে গার্ডন লাইটগুলো যেন আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল পর্চে। সেখানে চমৎকার ইন্দোনেশিয়ান বাটিকের কাপড় পরা ছেলে ও মেয়েরা আমাদের বেলি ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিল।
একটা লম্বা ছাউনির মধ্য দিয়ে মূল হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম। দুপাশে স্বচ্ছ জল। তাতে ছোটাছুটি করছে লাল রঙের অসংখ্য মাছ। আর একটু দূরে ট্র্যাডিশনাল মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস সাজানো। ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা আওয়াজে বাদ্যযন্ত্র বাজছে। চারদিকে ফুলের গন্ধ। একটু দূরে দূরে বিভিন্ন আর্টিক্র্যাফটস। মনে হয় বাস্তব নয়, স্বপ্নের জগতে আছি। হোটেলের লাউঞ্জে ঢুকে চোখ ঝলসে গেলো আলো আর রঙের খেলায়। কী যে অভিজাত সজ্জা ভেতরকার! চারদিকে পেইন্টিং আর ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম। অল্প সময়ের মধ্যে চেক ইন শেষ করে চারতলায় নিজের ঘরে গেলাম। কিং সাইজের একটা বেড দেওয়া হয়েছে। একটা ফাইভ স্টার হোটেলের কক্ষে যেসব সুবিধা থাকার কথা সবই আছে, বাংলাদেশের তুলনায় ভাড়াও তেমন একটা বেশি নয়। মাত্র ৬৮ ডলার। সঙ্গে ব্রেকফাস্ট ফ্রি। সকাল সকাল নাস্তা সেরে ছুটলাম বল রুমের দিকে। ফাইভ স্টার হোটেলের ব্রেকফাস্ট ছেড়ে কে উঠতে চায় বলুন।
হায়াত রিজেন্সি যোগজাকার্তার লনে দাঁড়িয়ে লেখক
ওয়ার্কশপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন ইন্দোনেশিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক ড. রাচমাডি উইডডিহাত্তো, টিচার এন্ড এডুকেশনাল পার্সোনেলের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. নুনুক সুরয়ানি, বোর্ড অফ স্ট্যান্ডার্ড, কারিকুলাম এন্ড এডুকেশনের প্রধান ড. অনিন্দিত আদিতিম। এছাড়া ইউনেস্কো, আরিগাতো ইন্টারন্যাশনাল, KAICIID ও Guerrand-Hermès Foundation-এর কর্মকর্তাগণ। রাচমাডি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তাগণ পঞ্চশীল নীতির ভিত্তিতে গৃহীত শিক্ষানীতি দিয়ে তারা কীভাবে জাতীয় সংহতি ও ঐক্য ধরে রাখছে তার বর্ণনা দেন। ইন্দোনেশিয়ার পঞ্চশীলের ৫ টি নীতি হচ্ছে: ১. ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস ২. ন্যায় ও সভ্য মানবতা ৩. ইন্দোনেশিয়ার ঐক্য ৪.প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার ফলে উদ্ভূত ঐক্যমতে অভ্যন্তরীণ প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত গণতন্ত্র ৫. ইন্দোনেশিয়ার সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার। এই পঞ্চশীলের আলোকে তারা শিক্ষার্থীদের জন্য ৬টি যোগ্যতা অর্জন স্থির করেছে। সেগুলো হলো- ১. বৈশ্বিক বৈচিত্র্য ২. সহযোগিতা ৩. সৃজনশীলতা ৪. ক্রিটিক্যাল রিজনিং ৫. স্বাধীনতা ৬. স্রষ্টার প্রতি ভীতি।
৭ দিনের এ কর্মশালায় ৬টি দেশের ২৯ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। বাংলাদেশের ৫ জন ছাড়াও, কেনিয়ার ৫ জন, মারিশাসের ২ জন, নেপালের ৫ জন, সেলিশাসের ৫ জন ও ইন্দোনেশিয়ার ৭ জন প্রতিনিধি অংশ নিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় শ্লোগান হচ্ছে: নেকা তুনগাল একা। অর্থাৎ ইউনাইটেড ইন ডাইভারসিটি। বৈচিত্রে ঐক্য। এই আপ্তবাক্যটি তারা অর্জন করেছে ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন সুতসোমা থেকে। ৭০০ বছর আগে মাজাপাহিট সাম্রাজ্য কালে এটা লেখা হয়েছিল। সুতসোমা ছিলেন এক ভারতীয় রাজকুমার। তাঁর রাজ্য শাসনে কোন আগ্রহ ছিল না। তিনি দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। এভাবে পরিভ্রমণ করতে করতে তিনি একটি রাজ্যে এসে হাজির হন। সেখানকার রাজা পুরুষাডা সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে জিইয়ে রাখত। এর প্রতিবিধান করতে সুতসোমা চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি গৌতম বুদ্ধের পুনর্জন্মের জন্য আত্মদানের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে পুরুষাডা শরণাপন্ন হন হিন্দু দেবতা শিবের। এমন সময় এক ধর্মযাজক তাদের মধ্যস্ততায় এগিয়ে আসেন। সবার জ্ঞান চক্ষু উন্মোচিত হয়। সবাই দেখতে পায় শিব বুদ্ধ একই। ভিন্ন কোন সত্তা নয়। ভূর্জপত্রের সেই পুরাণেই গল্পের শেষে লেখা ছিল ‘নেকা তুনগাল একা’।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে দারুণ নৃত্যগীতির আয়োজন করা হয়। মজার ব্যাপার মেয়েরা হিজাব পরে নেচেছে। দারুণ নাচ। নাচে যদিও ভারতীয় প্রভাব বেশি, গানের সুরে কিন্তু আরবীয় প্রভাব স্পষ্ট। যন্ত্রসঙ্গীতে আবার চৈনিক। দারুণ একটা সংস্কৃতির মেলবন্ধন দেখতে পেলাম। প্রথম দিনের সেশন শুরু হলো একটা খেলার মধ্য দিয়ে। কুমির তোর জলে নেমেছি টাইপের খেলা। এ খেলার মাধ্যমে সুপার পাওয়ারগুলোর অনৈতিক আচরণ তুলে ধরা হয়। সবাই মিলে সে নিয়ে আলোচনা করল। হোটেলের ভেতরেই সব। তাই আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই খেতে-বসতে গিয়ে পরিচয় হলো সবার সঙ্গে।
ওয়ার্কশপে লেখক
এসব আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সবচেয়ে বড়ো আনন্দ হলো, বিভিন্ন দেশের মানুষ ও ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। যেমন মারিশাসের কথা বলা যায়। মারিশাস থেকে এসেছে রাজিব ও জয়। রাজিবের মা ও বাবা দুজনেই ভারতীয়। জয়ের বাবা পর্তুগীজ মা ভারতীয়। তারা দেখলাম আমাদের দেশ নিয়ে বেশ ওয়াকিবহাল। ওদের দেশ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট দেশে ১২ লক্ষ মানুষ বাস করে। এর তিনভাগের দুই ভাগই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তার উপর আছে মাদাগাস্কারের লোক, আফ্রিকার লোক, ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ। আর ভারতীয় বলে মামলা খালাস করা যাবে না। তামিলদের সাথে গুজরাটিদের সাংস্কৃতিক মিল নেই। একই দশা ভোজপুরি ও অন্যান্য ভারতীয় কমিউনিটির ক্ষেত্রে। ফলে অল্প জনসংখ্যার দেশে রয়েছে বিপুল সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র। সবাইকে এক করতে তারা ইংরেজি ও ফ্রেন্সকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা ক্যামব্রিজের সিলেবাসে স্কুলে পড়ায়। তারা প্রতিটি নাগরিককে জনশক্তিতে পরিণত করতে চায়। কারণ তাদের ভূমি কম, সম্পদ আরো কম। এখন তাদের আয়ের বড়ো উৎস আইসিটি ও কনসালটেন্সি। তারা শিক্ষাকে জাতীয় সংহতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। এবং এ ক্ষেত্রে তারা বেশ সফল। একমাত্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন থেকে এসেছে জয়। সে তার ক্যাম্পাস দেখালো। এরকম একটা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ করতে পারল না, আফসোস।
কেনিয়া থেকে এসেছে ৫ জন শিক্ষক, তাদের সমস্যা জাতিগত। ঠিক জাতিগতও না। গোত্রে গোত্রে সংঘাত। আর এই সংঘাত আর দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে রাজনীতিবিদরা লুটপাট করে যাচ্ছে দেশের সম্পদ।
সেলিসাসের সমস্যা একেবারে ভিন্ন। ৮০ হাজার জনসংখ্যার ছোট্ট দেশটিতে সবখানেই মেয়েরা। স্কুলে ৫ জন ছাত্রীর বিপরীতে ২ জন ছেলে। ছেলেরা বড়ো হয় দেশ ছেড়ে চলে যায়। অথবা অন্য দেশ থেকে মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসে। ফলে এখানকার মেয়েরা বিয়ে করার জন্য ছেলে পাচ্ছে না। সেলিসাস থেকে ৫ জন এসেছিল, সবাই নারী। এরা ভয়ঙ্কররকম নারীবাদী।
যাবার আগে পর্যটন কর্পোরেশন ও বোর্ড থেকে এক গাদা লিফলেট ও পোস্টার নিয়ে গিয়েছিলাম। সেসব টেবিলে টেবিলে দিয়ে এলাম। অনেকেরই বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা নেই। আমাদের দেশের আয়তন ও জনসংখ্যা শুনে তাদের হা হতোস্মি দশা। কীভাবে এতো বড়ো একটা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে সেটা জানতে চাইল অনেকে। তবে আমাদের চেয়েও বেশি জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া। সতের হাজারেরও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। তারা যে মডেলে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করছে তা আসলেই অনুকরণীয়। ছোট্ট একটা এ্যাপসকে কেন্দ্র করে শিক্ষার সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের দেশে ২৩ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও, আমাদের চেয়ে ৫ কোটি বেশি জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় স্কুলের সংখ্যা মাত্র ২০ হাজার। প্রতিটি ছাত্র নতুন শ্রেণিতে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে সরকার ১ মিলিয়ন ইন্দোনেশিয়ান রুপি স্কুলের তহবিলে জমা দেয়। ফলে স্কুলগুলোর আর্থিক সংকট নেই বললেই চলে। সংকট যা শিক্ষকের। এর দুটো কারণ। এক. তাদের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ ও জটিল। দুর্নীতির বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আর দুই. বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়ার সুযোগ কম। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সায়েন্সের টিচারের খুব সংকট। তারা স্কুল ফান্ডের টাকা দিয়ে পার্ট টাইম শিক্ষক নিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়।
তারা//