ঢাকা     শনিবার   ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১

ইন্দোনেশিয়ায় এক সপ্তাহ : ৫ম পর্ব

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  
ইন্দোনেশিয়ায় এক সপ্তাহ : ৫ম পর্ব

ইউটিউবে যোগজাকার্তার যত ভিডিও দেখেছি তাতে মালিওবরো নামে একটা রাস্তার কথা জেনেছি। দারুণ নাকি জনপ্রিয়! সেখানে সস্তায় ইন্দোনেশিয়ান বাটিক কাপড় পাওয়া যায়। ইচ্ছে ছিল প্রথম দিন যাওয়ার। আমাদের কোর্সের কো-অর্ডিনেটর সেরিন বলল, তাড়াহুড়োর দরকার নেই, আমরাই নিয়ে যাব। 

ঠিক পরদিন সেশনের পর সবাইকে বলা হলো আধঘণ্টার মধ্যে হোটেলের লনে চলে আসবে। মালিওবরো যাব। ত্রিশ সিটের দারুণ এসি বাসে করে আমরা ছুটলাম মালিওবরোর দিকে। আট কিলোমিটার রাস্তা। মিনিট কুড়ির মতো লাগল। লম্বা একটা টালির ছাদঅলা মার্কেটের সামনে এসে দাঁড়াল বাস। আমরা টপাটপ নেমে পড়লাম। তারপর সার ধরে রাস্তার মোড় পার হলাম। দারুণ সুন্দর ঝলমলে একটা রাস্তার মুখে এনে দাঁড় করালো গাইড। তারপর হাত তুলে বলল, রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে যাও। রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোতে অনেক জিনিসপত্র পাবে। ফিক্সিড প্রাইস। নিশ্চিন্তে কেনাকাটা করো। 

ফোর লেনের রাস্তা। মধ্যে রোড ডিভাইডার। তাতে গাছ লাগানো। দুই ধাপে গাছ। বেড করে সুন্দর বাহারী পাতার গুল্ম। তার উপর চিরল পাতার গাছ। যাতে রোদ আসতে বাধা না লাগে। গাছের গায়ে ঝোলানো আছে জাভানিয়ান স্টাইলে রামায়নের বিভিন্ন চরিত্রের উপস্থাপনা। দূর থেকে ভেসে আসছে সঙ্গীতের সুর লহরী। রাস্তাটি যেমন সুন্দর তেমনি ফুটপাথ। বেশ চওড়া ফুটপাথ। তাতে ইউরোপী স্টাইলে বসার বেঞ্চ পাতা। আরেকটা সুন্দর জিনিস, রাস্তা ও ফুটপাতের মধ্যে ডিম্বাকৃতির কিছু আসন বসানো। এতে রাস্তার গাড়ি যেমন ফুটপাথে উঠতে পারবে না, তেমনি বসারও জায়গা হলো। 

একটা আধুনিক পর্যটন স্পটে যেসব আনন্দ আয়োজন থাকে, তার সবই আছে এখানে। প্রচুর মানুষের ভিড়। সন্ধ্যের পর এই ওয়ানওয়ে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তাই লোকজন মটর চালিত রিকশা কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে এ রাস্তা পরিভ্রমণ করে। ছোট্ট রাস্তা। গাড়ি-ঘোড়ার প্রয়োজন নেই। আমরা আপনা মনে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

রাস্তার ডান পাশে বিশাল বিশাল সব বাটিকের দোকান। অভিজাত হোটেল আর রাজবাড়ি। ইন্দোনেশিয়ার একমাত্র রাজতন্ত্র এই যোগজাকার্তায় রয়েছে। তাই একে যোগজাকার্তা স্পেশাল রিজন বলা হয়। এটি কোনো প্রদেশ কিংবা প্রশাসনিক ইউনিটের অধীনে নেই। আর এই রাজবাড়ির জন্য বিখ্যাত হয়ে গেছে এ রাস্তা। মালিওবরো শব্দটা আসলে সংস্কৃত মাল্যবর থেকে এসেছে। যুদ্ধজয়ী রাজাকে মালা দিয়ে বরণ করে নেয়া থেকে এমনতর নাম। 

আগেই বলেছি আগ্নেয়গিরির কথা। কিন্তু এটা যে এতো কাছে জানা ছিল না। মেরাপি নামে একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে এখান থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার দূরে। ৫০০ বছর আগে এখান থেকে নিয়মিত অগ্ন্যুৎপাত হতো। আসলে এই মালিওবরো জানাল বা রাস্তা মাউন্ট মেরাপিকে উদ্দেশ্য করেই তৈরি করা হয়েছিল।

দোকানগুলোতে প্রচুর কাপড়। তুলনামূলকভাবে সস্তা। কিন্তু সত্যিকারের বাটিকের দাম খুব বেশি। কারণ একটি বাটিকের কাপড় তৈরি করতে ৩০ ধাপ অতিক্রম করে আসতে হয়। বাটিকের রং করার প্রক্রিয়া বেশ কষ্টকর। প্রথমে মোম দিয়ে ড্রইং করে নেয়া হয়। তারপর রঙে চুবিয়ে রাখা হয়। একটা ওয়াশ হয়ে গেলে নকশা অনুসারে আবার মোম দিয়ে কিছু অংশ ঢেকে দিয়ে বাকিটা রং করা হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে রং দিতে দিতে ঝলমলে রঙের পোশাক তৈরি হয়। ইন্দোনেশিয়ার বাটিকের কাপড়ের রং ও নকশা ইউনিক। তাই এটা পশ্চিমাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। 

সস্তায় যেসব কাপড় মেলে তা মূলত প্রিন্টের। ফেব্রিক্স হয় সিনথেটিকের। ইন্দোনেশিয়ায় শার্ট ইন করার চল নেই। তাই শার্ট টানটান করার জন্য শার্টের নিচে একটা ফলস দেয়। ফলে সিনথেটিক কাপড় হলে গরমে শার্ট পরা যায় না। তাই সস্তার কাপড় থেকে সাবধান। কিন্তু জেনেশুনে বিষ পান করতেই আমরা অভ্যস্ত। তাই এক গাদা কাপড়চোপড় কিনে নিলাম। কিন্তু শপিং-এর নেশায় গানবাজনার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। রাস্তায় আসতে দেখি একটু পরপর ছোট ছোট জটলায় গান চলছে। সাউন্ড বক্স আর লাইটিং সিস্টেম নিয়ে ছোট ছোট দল গান করছে। আর লোকজন ভিড় করে শুনছে। একটু যেতেই দেখি রাস্তার উপর বিরাট প্যান্ডেল বানিয়ে নাটক দেখানো হচ্ছে। লোকজন ভিড় করে দেখছে। নাটক ঠিক না, অনেকটা ছায়াবাজি আর পাপেট শোর মিশ্রণ। যা বুঝলাম রামায়ণের কাহিনি উপস্থাপন করা হচ্ছে নাটকে। লোকজন হনুমান আর রাক্ষসের লড়াইয়ে খিলখিল করে হাসছে। ভাবলাম দুর্গাপূজার নবমী চলছে, তাই বোধহয় এ আয়োজন। আরেক মন বলে উঠল, তা তো হওয়ার নয়। এখানে তো হিন্দু জনগোষ্ঠী নেই। ফেরার তাড়া ছিল। তাই কেএফসিতে ঢুকে পেট ভরে খেয়ে নিলাম।

ইচ্ছে ছিল রাজবাড়ি দেখে যাওয়ার। কিন্তু সন্ধ্যের পর রাজদুয়ারে তালা পড়ে। তাই দূর থেকে দেখে এলাম। পুরোটাই ইউরোপীয় স্টাইল। মনে হবে হল্যান্ডের কোন খামার বাড়ি। তারা রাজবাড়িকে ক্রেটন বলে। সাড়ে তিন একর জায়গার ছোট্ট রাজবাড়িটি আসলে রাজা সুলতানের রাজ্যের সীমানাও নির্দেশ করে। মাত্র তিন হাজার বর্গ কিলোমিটারের একটা সলতানাত। এরকম হাজার হাজার রাজ্য ছিল একসময় সাড়ে ১৭ হাজার দ্বীপপুঞ্জে। কীভাবে সেটা একটা জাতিতে পরিণত হলো সেটা বেশ মজার গল্প। 

ভারতবর্ষকে এক করার পেছনে যেমন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবদান আছে, তেমনি আজকের ইন্দোনেশিয়াকে একত্রিত করেছে মাজাপাহিট রাজবংশ। এই রাজবংশের উত্থানের গল্প বেশ মজার। জাভা ধান চাষের জন্য খুব ঊর্বর ভূমি ছিল। এখানে প্রচুর ধান হতো। পার্শ্ববর্তী দ্বীপ থেকে বিভিন্ন মশলা নিয়ে আসা হতো ধান কেনার জন্য। আবার ভারত ও আরব থেকে বণিকরা এখানে আসত মশলা কিনে নেয়ার জন্য। তাই জাভা প্রাচীনকাল থেকে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। তাই বহিঃশক্তির দৃষ্টি ছিল এ সাম্রাজ্যের দিকে।

১২৮৯ সালে মোগল সম্রাট কুবলাই খাঁ তার সৈন্যবাহিনী পাঠান রাজা কেত্রানাগারার কাছে আনুগত্য স্বীকারের জন্য। রাজা আনুগত্য স্বীকার না করে উল্টো সৈন্যদের মাথা কেটে পাঠিয়ে দেন। এতে কুবলাই খান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তিন বছর পর ১ হাজার জাহাজ ভর্তি ২০ হাজার সৈন্য পাঠান। কিন্তু ততদিনে রাজা কেত্রানাগারা খুন হয়েছেন। অন্য একজন রাজা মসনদে বসেছেন। এক রাজপুত্র, নাম রাধেন বিজয়, দেখলেন সুবর্ণ সুযোগ ক্ষমতায় যাওয়ায়। তিনি কুবলাই খানের সৈন্যদলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজাকে পরাজিত করে ক্ষমতায় যান। কিন্তু ক্ষমতায় বসেই মোগলদের উপর চড়াও হন। তাদের তিনি জাভা ছাড়া করেন। 

১২৯৪ সালে তিনি মাজাপাহিট রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব জাভার ট্রোউলানে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জাভার ছোট ছোট রাজত্বগুলোকে এক করে তার রাজত্বের সীমানা বিস্তৃত করতে থাকেন। তবে বর্তমান মানচিত্রের রূপটি দিয়েছিলেন মাজাপাহিট সাম্রাজ্যের এক উজির। তার নাম গজ মাডা। গজ মাডা নাকি শপথ নিয়েছিলেন যতদিন পর্যন্ত আশেপাশের দ্বীপগুলোকে তিনি তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন না ততদিন তিনি মশলা খাবেন না। অবশ্য করেছিলেন তার চেয়েও অধিক। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে মাজাপাহিট সাম্রাজ্য পাপুয়া নিউগিনি থেকে মালয় দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। 

এই মাজাপাহিট রাজারা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে এক ছত্রতলে নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছেন। এখনও সেই জাতিগঠনের কাজ চলছে।

ফেরার পথে দেখি সেই নাটকের মঞ্চে চলছে রক সঙ্গীত। তরুণ তরুণীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে। প্রায় সব মেয়ের মাথায় স্কার্ফ। কিন্তু আনন্দ প্রকাশে কমতি নেই। বড় রস্তার মোড়ে আসতেই দেখি আরেক কাণ্ড। দলে দলে যুবকরা মটোর বাইক নিয়ে হৈ-হল্লা করে ছুটছে। ঘটনা কী? আমাদের গাইড জানালেন আগামী তিন দিন ধরে যোগজাকার্তা শহরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হবে। তার জন্য আজ থেকে আনন্দ মিছিল শুরু হয়ে গেছে।

ঘাড় ফেরাতেই দেখি মরিশাসের দুই প্রতিনিধি বিশাল কাপড়ের পোটলা নিয়ে ছুটছে গাড়ির দিকে। হোটেলে ফেরার পর তাদের জিজ্ঞেস করলাম, এই গোগ্রাসে কেনাকাটার অর্থ কী! তারা জানাল মজার তথ্য। তাদের যদিও ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত, কিন্তু বড় কোন জাহাজ তাদের বন্দরে ভিড়ে না। কারণ ছোট দেশ। চাহিদা কম। তাই পাশ কাটিয়ে সরাসরি চলে যায় কলম্বো কিংবা অন্য কোন পোর্টে। সেখান থেকে মাল আনতে অনেক টাকা জাহাজ খরচ পড়ে যায়। তাই প্রতিটি পণ্যের দাম বেশি।কাপড়ের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যত সস্তায় পারো কিনে নাও। এই অভিযান আরো কয়েকদিন ধরে চলবে তারা জানিয়ে দিলো। 

পড়ুন: ইন্দোনেশিয়ায় এক সপ্তাহ : ৪র্থ পর্ব

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়