ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি: ২য় পর্ব 

হোমায়েদ ইসহাক মুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ১৬ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৪:১৯, ১৬ জুন ২০২৩
বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি: ২য় পর্ব 

শ্রী অরুবিন্দু আশ্রম এখানকার আরো একটি মূল আকর্ষণ। ১৯২৬ সালে কলকাতার এই সাধক এখানে এসে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আসতে পারে। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। ভেতরটা ফুলের বাগান দিয়ে সাজানো। বাহারি ফুলের বেশ কড়া সুভাস শরীর-মনে প্রশান্তি এনে দিলো। শ্রী অরুবিন্দু আর মাতা মিরা আলফাসার সমাধির সামনে ভক্তরা বসে ধ্যান করছে, কেউ কেউ মাথা ঠুকছে। সব আশ্রমেই একই কাহিনী বিরাজমান।

ফরাসি কলোনি ঘেরা পন্ডিচেরিতে নান্দনিক এই বাড়িগুলোই মুলত প্রধান আকর্ষণ। ফরাসিরা এখানে আসা শুরু করে সতেরশ শতাব্দীর দিকে। কলনিয়াল পিরিয়ড শুরু হয় তারো আগে, পর্তুগীজদের  হাতে ১৯০৫ সালে। প্রথম পর্তুগীজ যিনি ভাতরের মাটিতে পা দিয়েছিলেন তিনি ভাস্কো দ্যা গামা, আর সময়টা ছিল ৮ জুলাই ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ। সময় গড়ায়, ফরাসিরা পন্ডিচেরির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, এবং টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ করতে এদিকে আসতে শুরু করে। পন্ডিচেরিকে এখন কাগজে কলমে ‘পদুচেরি’ বলা হয়। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের এই পন্ডিচেরি শহর ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ফরাসি উপনিবেশদের হাতে ছিল। ডাচ, পর্তুগীজ, ব্রিটিশ এবং ফরাসি ব্যবসায়ীদের আগমনের পরই পন্ডিচেরির ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়। পদুকে বা পদুচা হচ্ছে একটি বাণিজ্যকেন্দ্র যা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে রোমান বাণিজ্যের গন্তব্য। ১৬৭৪ সালে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পন্ডিচেরিতে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে এবং তা শেষ পর্যন্ত ভারতে প্রধান ফরাসি বসতিতে পরিণত হয়। 

ভালো করে ঘুরে দেখার আগেই খুব জলদি সূর্য অস্তমিত হলো। তারুণের কল পেলাম, কেশর দুদ আর তামিল ভাষায় গুন্তাপোঙানালু খেলাম, যা চালের পিঠার মতো দেখতে। তামিলনাড়ুতে কেউ হিন্দি বলা পছন্দ করে না, বেশিরভাগই জানে না। যারা তামিলনাড়ুর বাইরে কাজ করতে যায় তারা কিছুটা শিখে নেয় তাদের সুবিধার জন্য। ইংরেজি আর তামিল এই দুই ভাষার প্রচলন এখানে। আমি অল্প কিছু তাদের থেকে শিখে নিলাম। নান্ত্রি মানে ধন্যবাদ। কালাই ভানাক্কাম মানে শুভ সকাল। ইপাডি ইরুকিঙ্গা মানে কেমন আছেন। কত দাম- ইব্বালুবু রুবাই। কঠিন তাদের উচ্চারণ। সুতরাং তামিল ভাষার কেউ আশেপাশে থাকলে চলতে বেশ সুবিধাই হয়। তারুণদের পেয়ে বেশ ভালোই হলো। তারাও প্রথমবার এসেছে। ওদের সাথে বাইক আছে। আমরা সেরিনিটি বিচের দিকে যাবো বলে ঠিক করলাম। প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। 

প্রথম কয়েক কিলোমিটার মার্কেট এলাকা, বেশ ট্রাফিক আছে এই রাস্তায়। গণেশকে চালাতে বললাম এই রাস্তাটুকু। সেরিনিটি বিচ নামের সাথে মিল আছে, বেশ নিরিবিলি। মাছ ধরার নৌকা সারি বেঁধে সাজানো। তারুণ পানির বোতলটা বিচে ফেলে দিতে চাইলে তাকে বললাম, কিভাবে আমরা প্লাস্টিক দিয়ে সমুদ্রের ক্ষতি করছি। অন্তত আমরা যারা একটু শিক্ষার আলো পেয়েছি বা সচেতন তারা ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে যত্নশীল হলে প্রকৃতিমাতাকে রক্ষা করতে পারবো। বিচের পাড়ে তিনজন মিলে বিয়ার আর আড্ডা হলো অনেকক্ষণ। এদের সাথে কেবলই পরিচয়, একে অন্যকে আমরা ভালোভাবে চিনিও না। তারপরও এই অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের নানা বিষয়ে গল্প জমে গেলো। মানুষ, সে যে-দেশের মানুষই হোক না কেন আমাকে যত আকৃষ্ট করে, তাদের সঙ্গে যত একাত্নতা বোধ করি; তেমন কোনো বাড়ি ঘর স্মৃতিসৌধ কিছুর সঙ্গেই করিনি। ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞা নেই। কিন্তু অতীত ইতিহাসের চেয়ে বর্তমানের একজন সাধারণ অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। মানুষের চেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং মনুমেন্ট অথবা জীবজন্তু আমার আজও চোখে পড়েনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি আমি অচেনা মানুষদের মধ্যে। তারা যত সহজে আমাকে আপন করে নিতে পারে অথবা আমি তাদের; সেটা খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। 

বুদ্ধদেব গুহর একটি লিখায় পড়েছিলাম, তিনি তাঁর বাবার উক্তি দিয়ে বলেছিলেন –‘পৃথিবীতে কোন লোকই খারাপ নয়। খারাপ বলে কিছু নেই দুনিয়ায়। যা খারাপতম, অন্ধকারতম যা; তারও একটা ভালো অথবা আলোকিত দিক থাকে। বলতেন, সব সময় সেই আলোকিত দিকটার দিকে তাকিয়ে থেকো- অন্ধকার দিকটাকে উপেক্ষা কোরো, তবেই বুঝতে পারবে এ পৃথিবীতে খারাপ মানুষ কেউই নেই। খারাপ ব্যাপারও বেশি কিছু নেই।’

গল্পগুজব শেষ করে পন্ডিচেরির খুব পপুলার 'টাকা পিজ্জা' খেতে গেলাম। এ আবার আমাদের দেশের কারেন্সি টাকা নয়, পিজ্জা দোকানের নাম টাকা পিজ্জা। থিন ক্রাস্টের টপিং ভরা চিকেন টাকা পিজ্জা। এরপর হোস্টেলে পরিচয় হলো আনভিতা আর বইসনবির সাথে। এরা সবাই আমার মুন নামটা বেশ আনকমন আর ইন্টারেস্টিং হিসেবে দেখলো। মাঝরাত অব্দি আড্ডা জমলো। পরদিন ভোর বেলা নান্দনিক স্থাপত্যকলার ছবি তুলতে বেরোতে হবে। 

ভোরে ঘুম ভেঙে জানালার দিকে তাকালাম। সঙ্গে লাগোয়া একটা গাছের মাথায় ছোট্ট একটা কাঠবিড়ালি নিশ্চিন্ত মনে ফল খাচ্ছিল; টের পায়নি আমায়। দেখতে ভারি সুন্দর, আজকের সকালটার মতো। বেড়িয়ে পড়তে হবে জলদি। তারুণ আর গণেশকে ডাক দিলাম দুইবার৷ এত রাতে ঘুমিয়ে তারা ভোরে উঠতে পারবে না জানা ছিল। এখন বেড়িয়ে না পড়লে সোনাঝরা রোদটাও মিস করতে হবে। 

বাইক নিয়ে চলে গেলাম হোয়াইট টাউনে। লম্বা গলি ধরে ফেন্স কলোনির সাদা রঙের দোতলা বাড়িগুলো সারি বেধে দাঁড়ানো। সবাই এই এলাকাকে হোয়াইট টাউন নামে চেনে। প্রতিটা বাড়ির সাথে ফুলের বাগান, কোথাও বিশাল বাহারি রঙের বাগানবোলিয়ার ঝুলন্ত কান্ড বা বড় গাছের মিশেলে এক অনন্য নান্দনিকতা যে কারো মন ছুঁয়ে দেবে। সকালবেলা কেউ হেঁটে যাচ্ছে বা সাইকেল চালিয়ে কাজে যাচ্ছে। হোয়াইট টাউনের রাস্তা ধরে এমন কালারফুল কম্বিনেশন, ক্যামেরার ফ্রেম ঠিক করে স্মৃতিতে তুলে রাখলাম। এই বাড়িগুলো এখন মূলত নানা সরকারি অফিস, অ্যাম্বেসি বা নান্দনিক ক্যাফেতে রুপান্তর হয়েছে। আলিয়ান্স ফ্রান্সের পন্ডিচেরি শাখাও চোখে পড়লো একটা গলিতে। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য খুব সুন্দর করে সাজানো সব। ফ্রেন্স বেকারির বেশ ভালো কিছু দোকান চোখে পড়লো। আমরা ফ্রেন্স ব্রেকফাস্ট করার জন্য 'দেজ' নামে এমন একটা পুরাতন বাড়ির ক্যাফেতে গেলাম। এন্টিক কালেকশনে ভরপুর সেই বাড়ি। ফ্রেন্স মিউজিক চলছে, আগতরা আলাপচারিতায় মুখর। তারুণদের অপেক্ষায় আমি এর মধ্যে কয়েকটা ক্যাফে ঘুরে ফিরে দেখে নিলাম। ব্রেকফাস্টে ছিল তিনটা ডিমের কুসুম একসাথে ফ্রাইড এগ, ফ্রেঞ্চ টোস্, বাটার, আলুর শামি কাবাব আর কালারফুল গ্রিন সালাদ। শেষে ঘন দুধের চা। এখানে খুব ভালো ভালো বইয়ের  কালেকশন আছে। নাস্তা কফি নিয়ে বই পড়তে পড়তে সারাদিন কাটিয়ে দেয়া যাবে খুব সহজেই। তবে ক্যাফের মালিক খুব সাবধানী, সে কাউকে ভেতরে ছবি তুলতে দেবে না। মেগা পিক্সেল সমেত ফোন হাতে থাকলে লোকে কি আর তা মানবে।

ফ্রেন্স বেকারির গুণগান বিশ্বজুড়ে। কয়েকটা বেকারি অ্যান্ড পেস্ট্রি শপে ঢু মারলাম। খুবই মুখোরচক আর উপাদেয়। বেশকিছু বেকারির দোকানে ভারতীয়দেরও দেখলাম দিব্বি ফরাসি ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে। আগামাথা কিছুই বুজলাম না। হোস্টেল থেকে চেক আউট হতে হবে ১১টার মধ্যে। আমি আরুভেলির পথে রওনা হবো। গাণেশ বাড়ি চলে যাবে, তারুণ আর মেয়েরা আজকে এখানটাতেই থাকবে। আগামীকাল আমরা একসঙ্গে বাসে চেন্নাই শহরে যাবো। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে আমি বেড়িয়ে পড়লাম। 

পড়ুন প্রথম পর্ব : পন্ডিচেরি: বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি  

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়