ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

তোমারে দেখিতে মনে চায়, দেখা দাও আমায় 

হোমায়েদ ইসহাক মুন  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৭:৪৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
তোমারে দেখিতে মনে চায়, দেখা দাও আমায় 

মুনিবদের নিয়ে মিন্টু নদী পার হচ্ছে, ছবি: লেখক 

কর্ণফুলীর ছলাত ছলাত জল। জোয়ার ভাটায় বাড়ে-কমে। উজানে দেখা যায় দুধ-সাদা মেঘের মিতালি, বরিষা ধারা তার সঙ্গী হয়। চারপাশ সবুজের চাদরে ঢাকা, মাঝখান দিয়ে বহমান কর্ণফুলী। স্রোতের টানে সেই নদীতে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। ডিঙি ভাসালে নিমিষেই কোথায় যে নিয়ে যাবে ইয়ত্তা নাই। সেই ডিঙির হাল ধরে এই অঞ্চলের মাঝিরা। নৌকার আগাকে ঢেউয়ের দিকে সোজা রেখে শক্ত মুঠিতে হাল ধরে বসা মাঝি সুকুমার, নিপেন্দ্রনাথ আর নারায়ণরা জীবনের সংগ্রামে বৈঠা বেয়ে যায় মাঝ দরিয়ায়। এমনকি জেলেপল্লীর নারীরাও সাহসের সাথে সীতা পাহাড় আর রাম পাহাড়ের মাঝে এই খরস্রোতা কর্ণফুলী এপার ওপার করে। শহরের মানুষের এসব বিলাসিতা তাদের ছোঁয় না, দামি জায়গায় গিয়ে চেক ইন তাঁদের রোচে না। সাধারণ জীবনে, অল্প সুখ অল্প দুঃখ, জীবন কেটে যায় কোনোভাবে। 

যদিও এখন জেলেপল্লীতেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তাদের ঘরেও টিভি আছে, হাতে মুঠোফোন আছে। তবে দাদনের টাকা আগের মতই আছে। তাদের ঠকিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা এখনো ফায়দা লুটে নিচ্ছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে পদ্মার দু-মাইল উজানে কেতুপুর গ্রামের কুবের মাঝি, ধনঞ্জয়, গনেশদের গল্পেও বারবার তাদের নিগৃহীত হবার কথা উঠে এসেছে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’- আরেক অমর সৃষ্টি অদ্বৈত মল্লবর্মণের। আমাদের সমাজের উঁচু-নিচুর বৈষম্য নিয়ে অনেক উপন্যাস আর চলচ্চিত্র হয়েছে। তারপরও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কতটুকু বদলেছে তা বিবেচ্য বিষয়।  

চার দুষ্ট ছেলেদের দল 

জেলেপল্লীর দুজন সাহসী নারী দূর থেকে বিপরীতমুখী স্রোত ঠেলে আসছিল আমাদের দিকে। একটা কুকুর আছে তাদের সাথে, নাম মিন্টু। কুকুরটাও তাদের নৌকার সাওয়ারি। জলের তোড়ে ভেসে যাওয়ার ভয় নেই তার, মনিবের তরে জীবন বিলাতে সে প্রস্তুত। নৌকার আগায় পাটাতনে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। উজানের স্রোত ঠেলে তীরে আসতে তাদের বেশ বেগ পেতে হলো। নিকটে আসলে দেখলাম তারা নৌকা বোঝাই করে গবাদি পশুর জন্য ঘাস বয়ে এনেছে। কুকুরটি কাছে এলে দেখলাম মুখটা দুর্ঘটনায় বাঁকা হয়ে গেছে, তারপরও তার জন্য জেলেপল্লীর নারীদের আদরের কমতি নেই। প্রাণীদের যারা আগলে রাখে, ভালোবাসে তারা আর যাই হোক, খারাপ মানুষ হতে পারে না। 

কর্ণফুলীর তীরে জেলেপল্লীর জীবনে কত সুখ-দুঃখের খেলা, দুই দিন আমাদের তারা দেখেছে, কথা বলেছে। তাদের জীবনও আমরা কাছ থেকে দেখেছি। এ নদী জেলেদের অনেক ব্যথার সাক্ষী। কিছুদিন আগেই জেলেপল্লীর এক ছেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে অকালে মারা গেছে। বলছিল মাঝি এবং মাছের ব্যাপারী সুকুমার দাদা। 
নদীতট আর সমুদ্র দেখলেই আমার ছোটবেলায় বিটিভিতে দেখা ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’র দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত এই বই থেকে এই সিনেমাটা তৈরি করা হয়েছে। যেখানে সান্তিয়াগো নামে একজন মৎস্যজীবী চুরাশি দিন বড়শি ফেলে একটি মাছও পায়নি। 

তবে জেলে সুকুমার মাছ পেয়েছে, তার থেকে আমরা দামদর করে সাতশো টাকায় সোয়া কেজি ওজনের একটা আইড় মাছ কিনে নিলাম। মাছের মুখ থেকে তখনো দম ওঠা-নামা করছে। মাছ কাটার প্রস্তুতি নিলাম মুনাবির কুড়াল আর সারভাইভাল নাইফ দিয়ে। ট্রেনে উঠেই পরিচয় হলো তার সঙ্গে।পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি, তবে ঘুরে বেড়ানোর বিস্তর অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরে ফেলেছে। আমার ছাত্র জীবনের ছায়া কিছুটা তার মধ্যে পেয়ে আমিও মনোযোগ দিয়ে মুনাবির গল্প শুনতে লাগলাম। কর্ণফুলীর পাড়ে নিরিবিলিতে রাত কাটানোর আইডিয়াটা তার মাথা থেকেই এসেছে। কারণ বেশ কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে সে এই জায়গাতে থেকে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো  জায়গাটা অন্যদের চোখের আড়ালে এবং আমরা চাই তা আড়ালেই থাকুক। কারণ ইতোমধ্যে আশেপাশে সব কমার্শিয়াল টুরিস্ট স্পট হয়ে গেছে। নদীর তীর ঘেঁষে কায়াক ক্লাব আর নিসর্গ রিভার ভ্যালির মতো জমজমাট টুরিস্ট স্পটে লোক সমাগম হচ্ছে রোজ রোজ। আমাদের খুঁজে পাওয়া ক্যাম্পিংয়ের জায়গাটা এখন পর্যন্ত মুক্ত আছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আর এমন থাকবে না। কয়েকদিন আগে একজনের লেখা পড়ছিলাম যে, বান্দরবানের কিছু জায়গা শুধু প্রচারণার কারণে তা এখন পরিবেশের জন্য হুমকির মুখে পড়তে বসেছে। এতোদিন পর এসে অনুশোচনা হচ্ছে তখন এভাবে সেই জায়গাগুলোর বর্ণনা না দিলে হয়তো আরো কিছুদিন জায়গাগুলো মানুষের ভোগ-বিলাস আর বাণিজ্যের হাত থেকে রক্ষা পেতো।  

মেহগনি বাগানের এক কোণে আমাদের ক্যাম্প সাইট 

আমাদের চারজনের দলের কর্ডিনেটর হলো শিহাব। এবার বিসিএস-এর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। চাকরিটা এবার আমি পেয়ে গেছি বেলা, শুনছো! চাকরিটা এবার শিহাবের লাগবেই। এ দেশের মাটি আর মায়া ছেড়ে কোথাও সে যেতে চায় না। শিহাবের সাথেও আমার পরিচয় এই ঘোরাঘুরি ঘিরেই। বেড়ানোর সুবাদে কত মানুষজনের সাথে যে পরিচয় হলো, এর মধ্যে এসব মানিক রতনদেরও পেয়ে যাই, যারা নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। 

কর্ণফুলীর পাড়ে ক্যম্পিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেই শিহাব আমাকে ফোন দিয়ে বলল, ভাই চলেন আমাদের সাথে, জায়াগাটা আপনার ভালো লাগবে। শিমুল আমাদের আরো একজন সঙ্গী। কথা বলে খুব কম, আপন মনে থাকে আর বাস করে সবার থেকে দূরে- নারায়ণগঞ্জ। সবাই কমলাপুর থেকে রওনা হবে রাতের মেইল ট্রেনে। কারণ কম বাজেটের ট্রিপ। আমি এয়ারপোর্ট ষ্টেশনে এসে হাতে সময় দেখে কি মনে করে উল্টা কমলাপুরের  ট্রেনে উঠে পড়লাম। ভেবে রেখেছি ত্রিশ মিনিটের যাত্রা, পরে বুঝলাম এ আরেক মেইল ট্রেন- পথে পথে যার বিরতি। সময়ে কুলাবে না বলে ট্রেন থেকে নেমে আবার বাস ধরে এয়ারপোর্ট এসে দৌড়াতে হলো চট্টলার মেইল ট্রেন ধরতে। তেমন একটা ভিড় হয়নি আর কম বাজেটে ঘুরতে গেলে এসব ছাড়া বিকল্প নেই। আমাদের ভ্রমণের সম্বল করলাম দুইটা তাবু, চারটি হ্যামক, স্লিপিং ম্যাট, চুলা এবং গ্যাস ক্যান, মাঝারি সাইজের কুড়াল, চাকু, নুডুলস, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, কফি আর মসলাপাতি।

ভোরবেলা চট্টগ্রাম নেমে মুনাবির নিয়ে গেলো দুই নাম্বার গেইট, তার চাচার বাসায়। চাচা-চাচী জম্পেশ নাস্তা করালো। তাদের ধন্যবাদ দিয়ে আমরা লিচুবাগানের বাস ধরলাম। দুই ঘণ্টায় চলে এলাম কর্ণফুলীর তীরে। মুনাবির যে এত বড় কুড়াল নিয়ে ঘুরছে তা প্রথমে টের পাইনি। বেশ হালকা আর মজবুত। মাছ কাটার সময় বের করলো এই কুড়াল আর ধারালো একটা ছুরি। নদীর পাড়ে বসে তাজা মাছ কাটার আনন্দই আলাদা। সারাক্ষণ রিল আর ইউটিউবে এসবই দেখে বেড়াই। এবার একটা সুযোগ পেয়ে ওদের বললাম কিছু শুট করে দাও আমায়। ওরাও কাজে লেগে পড়লো। কারণ মাছ কাটার ঝামেলা থেকে তাদের মুক্ত করে দিয়েছি।

সীতা আর রাম পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী নদী

মাছ কেটে ধুয়ে আমরা কিছুক্ষণ জলকেলি করলাম। জলে তরঙ্গ আর সাথে মায়াবী কণ্ঠ মিলে-মিশে একাকার হলাম। মুনাবির গলা ছেড়ে গান ধরল:
‘তোমারে দেখিবার মনে চায়,
দেখা দাও অমায় 
দেখা দিয়া শান্ত কর
নইলে আমার প্রাণও যায় 
তোমারে দেখিবার মনে চায়’

এই ছেলে যে এত ভালো গান করে জানাই ছিল না! পরে জানলাম ছোটবেলায় তাকে গানের স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। আমাদের সমাজে টাকা কামানোর মেশিন বানানোর চাপে পড়ে যেমন সম্ভাবনাময় প্রতিভাগুলো অঙ্কুরোদগম হবার আগেই ঝড়ে পড়ে যায়, মুনাবিরের ক্ষেত্রেও এমন কিছু হয়েছিল।

কর্ণফুলীর সুন্দর আর স্নিগ্ধ রূপের সামনে আমরা এখন অবগাহন করছি। গানের কথাগুলোও তাই হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছিল। দেখা দিয়া শান্ত কর নাইলে আমার প্রাণও যায়। এই বিকেলটার কথা হয়ত অনেকদিন মনে থাকবে, সাথের মানুষগুলোকেও। সন্ধ্যায় লক্ষ কোটি তারার মাঝে ঝলঝলে একটা চাঁদ উদীয়মান হলো। সীতা আর রাম পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পূর্ণ চন্দ্রের রোশনাই নদীর জল আরো মহনীয় করে তুলল। পাহাড়, জঙ্গল, নদী সেই রোশনাইতে দিনের আলোর মত পরিষ্কার- সব মিলিয়ে একটা জলজ্যান্ত ক্যানভাস চোখের সামনে। আমরা নির্বাক হয়ে শুধু চেয়ে রইলাম, আর কান খাড়া করে ছলাত ছলাত ঢেউয়ের শব্দে বিমোহিত হলাম। কতক্ষণ, তা অনুমান করতে পারি না!

যে জায়গায় আমাদের ক্যাম্প করা হয়েছে তা একটা মেহগনির বাগান পেরিয়ে তারপর নদীর তীরে আসতে হয়। এটি একজনের ব্যক্তিগত জায়গায় বিশাল এক সবুজের বাগান। মেহগনি গাছ ছাড়াও আরো বিচিত্র সব গাছের সমারোহ এই বাগানে। সব গাছ চিনি না বা নামও জানি না। জানতে পারলে খুশি হতাম।  অবশ্য পৃথিবীর তাবৎ গাছের নাম যারা জানেন, তারা উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। যারা নাম-না-জেনেও তাবৎ গাছপালা ফুল-লতাকে ভালোবাসেন তারা কবি-সাহিত্যিক। তফাত হয়তো এইখানেই; এইটুকুই। 

মেহগনি গাছগুলো উচ্চতায় বেশ বড়, তার মাঝ বরাবর ইটের রাস্তা। এর পাশ দিয়ে জেলেদের পল্লী, টিন শেডের সারিবদ্ধ ঘর। নদীর ঠিক কাছেই বাঁশবাগান, আগের দিন আমরা তার নিচেই ভেজা মাটিতে তাবু ফেলেছিলাম। তাতে বেশ পিঁপড়ের আনাগোনা, তাই পরদিন আমরা উপরের মেহগনি বাগানের এক কোনে গিয়ে তাঁবু ফেললাম। ক্যাম্পে হ্যামকের জন্যও সুন্দর জায়গা পেয়ে গেলাম। চঞ্চল হাওয়ায় জোয়ারভাটা দেখে হ্যামকে অনেকক্ষণ দোল খেয়ে সময় গেলো। দুলতে দুলতে উপরের সুবুজ গাছের কঁচি পাতা আর তার ফাঁক গলে আকাশটাও দুলতে থাকে। নদীর হুহু হাওয়া আর আকাশভাঙা বৃষ্টি, সঙ্গে গরম কফির মগ- সব মিলিয়ে যেনো আরো দোলে দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা, দোলে শিখী-পাখা, দোলে শুক-সারি, ময়ুরী দোলে প্রেম অভিসারী।   

সোয়া কেজি ওজনের তাজা আইড় মাছ কাটা হলো

পেটে দানা পানি দিতে রান্নায় হাত লাগালাম। কেটে রাখা তাজা আইড় মাছ আলু দিয়ে পেঁয়াজ মশলা সমেত রান্না করলাম এক রত্তি ছোট্ট চুলা আর গ্যাস ক্যান দিয়ে। শিহাব ও বাকি দুজন মিলে ভাত রান্না করলো। রাতের খাওয়া হলো অমৃত। সেরাতে আকাশ ভারি করে ঝুম বৃষ্টি এলো। মনে হলো তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টি আমাদের মাথায় পড়ছে। পরদিন আবারো সেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি, সঙ্গে খিচুরি আর ডিম। শিহাবও গলায় শান দিলো মুনাবির সাথে, গানে নাচে রাত হলো পরিপূর্ণ। এবারের পালা সাঙ্গ করে আমি দিলাম ছুট। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছিল তারা আরো দু’রাত, ঝুম বৃষ্টির মায়া তাদেরকে ছাড়তে চায়নি। 
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ