মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি এবং শিল্পাচার্যের সংগ্রহশালায়
ফয়সাল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম
ছবি: ইন্টারনেট
ময়মনসিংহ আমাদের বহুবার ভ্রমণ হয়েছে। কারণ এ জেলাতেও আমাদের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়ি রয়েছে। বহু ঘটনা, গল্প এবং ভালোলাগা জড়িয়ে আছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন সময়ের ভ্রমণে। শুধু ময়মনসিংহ শহরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমি ও দুই আলোকচিত্রী বন্ধু খায়রুল ও সোহেল কোনো এক ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাই। উদ্দেশ্য ব্রহ্মপুত্র নদ ঘিরে চমৎকার কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা।
বন্ধু খোকনের বাড়ি ময়মনসিংহ সদরে বিদ্যাগঞ্জে। ঈদের পর হওয়ায় রাস্তা ছিল ফাঁকা। ফলে সড়ক পথে ৩ ঘণ্টাতেই পৌঁছে যাই ময়মনসিংহ শহরে। সিএনজি চালিত অটো নিয়ে চলে আসি বিদ্যাগঞ্জে বন্ধুর বাড়ি। আতিথেয়তায় খোকনের বাবা-মা, ছোট ভাই রোকন এবং বোন সীমা কেউ কারো থেকে কম নয়! ঈদের ছুটি থাকায় সবাইকে আমরা বাড়িতে পেয়ে যাই।
সুলতানী আমলের নাসিরাবাদ মোঘল আমলে কীভাবে মোমেনশাহী হলো? কিংবা মোমেনশাহী থেকে ময়মনসিংহ নামের বিবর্তনের ইতিহাস তোলা থাক গবেষকদরে জন্য। বিকেলে আমরা রওয়ানা হয়ে যাই মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে মুক্তাগাছার সুস্বাদু মণ্ডার মতো মুক্তাগাছা নামকরণের মজার গল্পটি না বলে পারছি না।
ময়মনসিংহ জেলার প্রাচীন জনপদ মুক্তাগাছা। মোগল আমলে এটি ‘আলাপসিং পরগনা’ নামে পরিচিত ছিল। এই পরগনা খাজনার দায়ে নিলামে উঠলে এর পত্তন নেন বগুড়ার আদি নিবাসী শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী। তার ছিল চার পুত্র। রামরাম আচার্য চৌধুরী, হররাম আচার্য চৌধুরী, বিষ্ণুরাম আচার্য চৌধুরী এবং শিবরাম আচার্য চৌধুরী। পিতার মৃত্যুর পর চার পুত্র বসতি স্থাপন করেন বর্তমান মুক্তাগাছায়।
মুক্তাগাছার পূর্ব নাম বিনোদবাড়ী। বগুড়া জেলার ঝাকর থেকে চার ভাই বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বর্তমান চৌরঙ্গীর মোড়ের রাজঘাটে যাত্রা বিরতি করেন। বিনোদবাড়ীর আশপাশ পুরোটাই ছবির মতো সুন্দর আর ছিমছাম দেখে তারা বিমোহিত হন। তারা স্থির করেন এখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করবেন। অতঃপর শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে এখানে রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। জমিদার আমলে প্রজা কর্তৃক নজরানা (উপঢৌকন) দেওয়া ছিল বহুল প্রচলিত রেওয়াজ। রাজা বাহাদুরদের আগমনে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ তাদের খুশি করতে নজরানা দিয়ে। জনশ্রুতি আছে, মুক্তারাম কর্মকার নামে এক ব্যক্তি রাজ বাহাদুরের আগমনে নজরানা হিসেবে একটি গাছা (পিলসুজ) উপহার হিসেবে নিয়ে যান। রাজা গাছার নিখুঁত কারুকাজ দেখে খুশি হয়ে বিনোদবাড়ীর নাম পরিবর্তন করে মুক্তারামের ‘মুক্তা’ আর তার উপহার দেয়া ‘গাছা’ একত্র করে নতুন নাম রাখেন মুক্তাগাছা।
দৃষ্টিনন্দন এই জমিদার বাড়ির বিভিন্ন অংশ বেশ আকর্ষণীয়! এখানে রয়েছে কারুকার্যখচিত বিশাল ফটক, কাঠের রাজসিংহাসন, ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ, রাজেশ্বরী মন্দির, কোষাগার, রানীর অন্দরমহল ইত্যাদি। আরো আছে লক্ষ্মীপুজো ও দুর্গাপুজোর জন্য পৃথক ঘর। আছে দরবার হল এবং কাচারি ঘর। আমরা এসব দেখতে দেখতে অতীতে ফিরে যাই। কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো টের পাইনি। কে যেনো বললো, কোথায় একটা গোপন সুরঙ্গ না কি আছে এখানে! আমরা দেখেছি, প্রায় সব রাজপ্রাসাদেই অর্থ রাখার জন্য গোপন সিন্দুক অথবা চরম বিপদে পালিয়ে যাওয়ার জন্য এমন সুরঙ্গ থাকে। রাজা বা জমিদাররা প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং অত্যাচারী হওয়ার কারণে বাইরের শত্রু আবার কখনো কৃষক-প্রজাদের দ্বারা আক্রমণের ভয়ে ভীত থাকতো। এ কারণে অনেকেই গোপন সুরঙ্গ বানিয়ে রাখতো। যাই হোক, মুক্তাগাছার সর্বশেষে জমিদার ছিলেন শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী।
রাজবাড়ি থেকে আমরা খোকনের বসতবাড়িতে ফিরে আসি। চমৎকার পারিবারিক পরিবেশে গল্প, আড্ডা এবং খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে রাত গভীর হলে ঘুমুতে যাই। সকালের নাস্তা সেরে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ময়মনসিংহ শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। প্রথম গন্তব্য অপরূপ সুন্দর একটি স্থাপনা- শশীলজ। আমি অবশ্য এখানে পূর্বে একাধিকবার এসেছি। শশীলজের প্রতিষ্ঠাতা সূর্যকান্ত আচার্য দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এর নাম রাখেন শশীলজ। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়েছিল মূলভবনের দোতলা অংশ।
শশীকান্ত ১৯০৫ সালে নতুনরূপে নির্মাণ করেন শশীলজ। ১৯১১ সালে এর সৌন্দর্য বর্ধনে করা হয় ব্যাপক সংস্কার কাজ। দৃষ্টিনন্দন এই রাজবাড়ি দেখা শেষে আমরা পা বাড়াই ব্রহ্মপুত্র নদের দিকে। শুরুতেই আমরা শিল্পাচার্যের সংগ্রহশালায় প্রবেশ করি। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের এই গাছপালা ঘেরা ভবনটি মূলত জনৈক ইংরেজ বার্ডেন সাহেবের বাড়ি ছিল। নানা সময়ে হাত বদল হতে হতে এটি ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছবির সংগ্রাহক ছিলেন। তাঁর লালিত স্বপ্ন ছিল এরকম একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার।
আমরা বিভিন্ন গ্যালারী ঘুরে দেখি। শিল্পাচার্যের স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে শিল্পীর গভীর আবেগ জড়িয়ে আছে। এই সংগ্রহশালার যাত্রা ৭০টি চিত্রকর্ম দিয়ে শুরু হয়েছিল। যার বেশিরভাগই ছিল তৈলচিত্র। এখানকার ছবিগুলোর মধ্যে শিল্পীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময়কালে অঙ্কিত ছবি, ‘গুণটানা’, ‘নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র’ এবং ‘দুর্ভিক্ষ’ উল্লেখযোগ্য। চিত্রকর্ম ছাড়াও এই সংগ্রহশালায় রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য এবং বিভিন্ন সময়ে তোলা আলোকচিত্র। জয়নুল সংগ্রহশালার দায়িত্বে থাকা একজনের কাছ থেকে জানতে পারি, তাঁর চিত্রকর্মের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম হচ্ছে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের মন্বন্তরের উপর করা ‘দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা’। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পকর্ম হচ্ছে ১৯৫৭ সালে ‘নৌকা’, ১৯৫৯ সালের ‘সংগ্রাম’, ১৯৭১-এ ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’, ‘ম্যাডোনা’ ইত্যাদি। দীর্ঘ ক্যানভাসে আঁকা দুটি চিত্রকর্ম ১৯৬৯-এ অঙ্কিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ খুবই আলোচিত ও বিখ্যাত দুটি শিল্পকর্ম।
জয়নুল আবেদিন পূর্ব বাংলার চিত্রশিল্প প্রসারে পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। তাঁরই উদ্যোগে ধাপে ধাপে উত্তরণের মধ্য দিয়ে আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ময়মনসিংহের এই সংগ্রহশালা ছাড়াও সোনারগাঁর লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাত্র ৬২ বছরের কর্মময় জীবনে জয়নুল আবেদিন তাঁর অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্ম দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের জগৎ। একই সাথে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠকও। তিনি সৃজনশীল প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ এবং সাংগঠনিক দক্ষতার সম্মিলনের এক বিরল দৃষ্টান্ত।
জয়নুল সংগ্রহশালা থেকে বের হয়ে আমরা ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বিশাল একটি সবুজ ঘাসের মাঠে বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ। মাথায় তখনো ঘুরছিল জয়নুলের অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। ব্রহ্মপুত্র নদীতে বেশ কিছু পালতোলা নৌকা দেখতে পাই। তবে পালগুলোর মধ্যে যে ছবি ছিল, তা একটি কোমল পানীয় উৎপাদন ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। নৌকাগুলো ভাসছিল মূলত ব্রহ্মপুত্রপাড়ে বেড়াতে আসা লোকজনকে নিয়ে। ঈদের ছুটি হওয়ায় বহু ভ্রমণকারীর উপস্থিতিতে সরগরম ছিল সেদিনের ব্রহ্মপুত্র তীর। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পথিকৃৎ বলা যায়। কৃষি বিষয়ক বেশ কিছু মৌলিক গবেষণা ও প্রায়োগিক কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে কৃষির প্রসারে অত্র অঞ্চল শুধু নয়, সারা দেশেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা রয়েছে। ঈদের ছুটিতে বন্ধ থাকার কারণে আমরা চমৎকার সাজানো গোছানো বিশ্ববিদ্যালয়টি খুব বেশি ঘুরে দেখার সুযোগ পাইনি। ততক্ষণে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে।
আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল গির্জায় চলে আসি। এখানকার ফাদারের সাথে খোকনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি সকলের খোঁজখবর নিলেন। গির্জা থেকে বেরিয়ে আমরা আবারো নদীর পাড়ের একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্টে বসে হালকা খাবার ও চা পান করার মধ্য দিয়ে আমাদের সংক্ষিপ্ত ময়মনসিংহ ভ্রমণ সমাপ্ত করি।
তারা//