এলাকাবাসীও ভুলতে বসেছেন বধ্যভূমির কথা
সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম
![এলাকাবাসীও ভুলতে বসেছেন বধ্যভূমির কথা এলাকাবাসীও ভুলতে বসেছেন বধ্যভূমির কথা](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2023December/risingbd2-2312130855.jpg)
বিকেলে ফিরতে হবে নিজ গন্তব্যস্থলে। আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম সকাল সকাল বের হবো নতুন গন্তব্যের সন্ধানে। না হলে ফিরতি ট্রেন ধরতে দেরি হয়ে যাবে। শীত আসি আসি করছে তাই এই সময়টার ঘুম অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় আরামদায়ক।
তাই ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল বৈকি! ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। মনে মনে ভাবছিলাম, কোথায় যাওয়া যায়? কারণ বেশি সময় দেয়া যাবে না। ফিরতি ট্রেন ধরে আমাদের ফিরে যেতে হবে শহর পানে। বলাই হলো না- আমরা আছি সিলেটের শমসেরনগরে অবস্থিত সুইস ভ্যালী রিসোর্টে। আমরা রিসোর্টের কর্মীর কাছে জানতে চাইলাম আশেপাশে খুব কম সময়ে কোথা থেকে ঘুরে আসতে পারব।
তারা বললেন নিকট দূরত্বে চা বাগান আছে। সেখানে ঘুরে আসতে পারেন। আমি বললাম, চা বাগান তো দেখেছি। আর কোথায় যাওয়া যায়? তারা জানাল বধ্যভূমি থেকে ঘুরে আসা যেতে পারে। সেখানে তেমন একটা লোকজন যায় না বললেই চলে। আমি রাজি হলাম। কারণ এই সুযোগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর সেনানীদের শ্রদ্ধাও জানিয়ে আসতে পারবো।
আমরা বের হলাম রিসোর্ট থেকে। বের হয়েই পথের ধারে তিন চাকার যানবাহন পেলাম। বললাম বধ্যভূমিতে যাবো। আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পরলেন তিন চাকার যানের কাণ্ডারি। তিনি বললেন, এখানে বধ্যভূমি পেলেন কোথায়? আমি বললাম, সামনেই আছে বুঝি? আমার কথা শুনে পাইলট মহোদয় বললেন, চলেন যাই খুঁজে বের করে নেবো।
স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম বাজারে। পাইলট মহোদয় কয়েকজনের সাথে কথা বললেন। এবার বললেন, চলেন এ বার চিনতে পেরেছি। এখানে মানুষজন যায় না বললেই চলে। তাই চিনতে পারছিলাম না। পঁচিশ মিনিটের মাঝেই আমরা পৌঁছালাম বধ্যভূমির সামনে। জঙ্গলে ঘেরা অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখতে পেলাম বধ্যভূমি। দেখে খারাপই লাগলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন একটি রাষ্ট্র। বিশ্ব মানচিত্রে যুক্ত হয় বাংলাদেশের নাম। টানা ৯ মাস ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার দ্বারা এদেশের মানুষের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বর্বরতা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
বাংলাদেশ শহীদের আত্মত্যাগ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিখাঁদ দেশপ্রেমের চূড়ান্ত ফসল। কিন্তু আমরা সেসব শহীদদের প্রতি প্রাপ্ত সম্মান কি দেখাতে পেরেছি? জানিয়েছি কি সেই সব শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্মের কাছে। মনে মনে খুঁজছিলাম এই বধ্যভূমির ইতিহাস সম্বলিত কোন ফলক পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ইতিহাস লিপিবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পেলাম না। শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীণ গণহত্যার শিকার শহীদদের নাম ও ঠিকানা একে একে করে দেওয়া আছে। বধ্যভূমির পাশে তেমন কারোর দেখা পেলাম না কিছুক্ষণ পরপর যাত্রীবাহী যানবাহন ছাড়া।
আমার পাইলট মহোদয় এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই বলতে পারলেন না। আমরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। পুবের বাতাস বইছে দূর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের ডাক। আমাদের পাইলট সাহেব বললেন এক জায়গায় বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকবেন না জোঁকে ধরতে পারে। ওনার কথা শুনতেই আমি তাকাতে লাগলাম পায়ের দিকে। কিছু সময় দাঁড়াতেই পা বেয়ে বিচুটি ওঠা শুরু করেছিল- চোখে পরেছিল বলে রক্ষা। দেখতে দেখতে কীভাবে যে সময় ছুটে চলছিল আমরা টের পেলাম না।
আমরা ফিরে চললাম ফিরতি পথে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক এ সব বধ্যভূমি, যাতে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের ত্যাগ, নির্যাতিত মা বোনদের হাহাকার। আর সাক্ষী হয়ে আছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং দেশীয় সহচরদের নারকীয় গণহত্যা, নারী নির্যাতনের চিহ্ন। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, খোলা আকাশের নিচে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভটি নির্ভীক প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কীভাবে যাবেন
দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন বা বিমানযোগে মৌলভীবাজার যাওয়া যাবে। রেলপথে এলে ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর ট্রেনে করে নামতে হবে শ্রীমঙ্গল, ভানুগাছ বা শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে। সব আন্তঃনগর ট্রেন শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রাবিরতি করলেও ভানুগাছ ও শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে সব আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি নেই।
ফলে আগেই জেনে নিতে হবে কোথায় নামতে হবে। শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে নামলে সেখান থেকে বাস ও সিএনজি অটোরিকশা পাওয়া যায়। শমসেরনগর পর্যন্ত বাসে যাওয়ার পর সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে সহজেই লেকটিতে পৌঁছানো সম্ভব। যাদের প্রচুর হাঁটার অভ্যাস আছে তারা শমসেরনগর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটেও যেতে পারেন। আর ঢাকা বা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাসে আসতে চাইলে মৌলভীবাজারগামী বাসে উঠে নামতে হবে শ্রীমঙ্গলে। সেখান থেকে একইভাবে লেকটিতে যাওয়া যায়। এ ছাড়া বিমানে এলে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে নেমে বাস বা ট্রেনে আসা যাবে শমসেরনগর।
তারা//
আরো পড়ুন