ঢাকা     শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১৩ ১৪৩১

দশম পর্ব

দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:৫৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

মুহিত ভাইয়ের মোবাইল ফোনে সুরবিন্দ্রা কুমার পুন মাগারের কল এলো। সুরবিন্দ্রা কান্তিপুর পত্রিকার সাংবাদিক। তার বাড়ি এই মাইকোটে। তিনি কাঠমান্ডুতে থাকেন, তবে এই মুহূর্তে গ্রামেই আছেন। মুহিত ভাইয়ের এক শেরপা বন্ধু এই সুরবিন্দ্রার ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, যদি তোমাদের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তাহলে সুরবিন্দ্রার সাথে যোগাযোগ করো, সে সহযোগিতা করবে। 

আমরা যে মাইকোটে এসেছি সেটা রাতেই মুহিত ভাই সুরবিন্দ্রাকে কল করে জানিয়েছিলেন। সে সকালে দেখা করবে বলে কথা দিয়েছিল। এ কারণেই সাতসকালে এই ফোন। মুহিত ভাই কল রিসিভ করে জানালেন, আমরা গ্রাম ঘুরে দেখছি। সুরবিন্দ্রা জানালেন, আমরা যে লজে উঠেছি সেখানে তিনি বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। মুহিত ভাই তাকে বসতে বললেন। আমরা গ্রাম দেখা বাদ দিয়ে লজে ফিরে এলাম। 

মাঝারি গড়নের দেহের একজন মানুষ কালো রঙের জ্যাকেট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। প্রথমে মুহিত ভাই ও পরে আমাদের সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে পরিচিত হলেন। দেখে মনে হলো খুবই শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কথা বলছে ধীরে ধীরে নিচু গলায়। তবে গম্ভীর প্রকৃতির। মুখে কোনো হাসির লেশ মাত্র নেই। আমরা সবাই লজের ছাদে ডাইনিং রুমে বসেছি। মুহিত ভাই এই এলাকার মানচিত্র বের করে তার সাথে অভিযানের বিস্তারিত প্ল্যান শেয়ার করছেন। যেহেতু এই পর্বতে আগে কোনো অভিযান হয়নি তাই এর কোনো রাস্তাও জানা নেই। তাই স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতা নিয়েই অভিযানের রাস্তা তৈরি করতে হবে। সেজন্যই সুরবিন্দ্রার সহযোগিতা নেওয়া। এই অঞ্চলটি নেপালের রুকুম জেলায় অবস্থিত। মাইকোট গ্রাম এবং দোগারি পর্বত ঢোরপাটান হান্টিং রিজার্ভ এর মধ্যে পড়েছে। 

জঙ্গল আর জলাভূমিকে ‘ঢোর’ এবং সমতল তৃণভূমিকে ‘পাটান’ বলা হয়। নেপালের একমাত্র হান্টিং রিজার্ভও এটি। ৫১২ বর্গ মাইলের এই এলাকাকে ১৯৮৭ সালে নেপাল সরকার হান্টিং রিজার্ভ ঘোষণা করে। হান্টিং রিজার্ভ হলো যেখানে শিকারীরা অনুমতি নিয়ে বৈধভাবে পশু শিকার করতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিকারীরা এখানে আসেন পশু শিকার করতে। এই ঢোরপাটানে ১৮টি স্তন্যপায়ী স্থানীয় প্রজাতি রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তুষার চিতা, হরিণ, লাল পান্ডা এবং ব্লু-শীপ। এখানে ১৩৭ প্রজাতির পাখিও রয়েছে। 

সুরবিন্দ্রা বললেন, আমার বন্ধু ভক্তপুন মাগার ঢোরপাটান হান্টিং রিজার্ভ এর পথঘাট ভালো চেনে। যারা এখানে শিকারে আসেন তাদের গাইড করে এই ভক্তপুন। সে তোমাদের রাস্তা সম্পর্কে ভালো দিকনির্দেশনা দিতে পারবে। তার বাড়ি এই গ্রামেই। আমি তার সাথে কথা বলে তোমাদের সাথে বিকেলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। আমি চেষ্টা করব তাকে তোমাদের সাথে পাঠানোর। মুহিত ভাই সুরবিন্দ্রাকে আমদের সাথে সকালের নাস্তা করতে বললেন। তিনিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। আমরা সকালের নাস্তা করতে বসে গেলাম। কিলু আর নিমা আমাদের খাবারের প্লেট এনে দিলেন। আমরা খাবার টেবিলে না বসে প্লেট হাতে রোদের মধ্যে বেরিয়ে এলাম। মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সকালের নাস্তা করলাম। 

সুরবিন্দ্রা এখন আমাদের এই মাইকোট গ্রাম ঘুরে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। ভোরেই আমরা গ্রামের কিছুটা অংশ দেখেছি। তবে এখন সুরবিন্দ্রা তার নিজের গ্রাম ঘুরে দেখাবে। প্রথমেই আমাদের নিয়ে এলো এই গ্রামের ভিতরে একটি ছোট্ট পুরনো ভাঙা বাড়িতে। এটা যে একটা রাজবাড়ি সেটা দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। সরু সিঁড়ি দিয়ে আমরা বাড়ির ছাদে উঠে এলাম। এখানে দাঁড়িয়ে পুরো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। এমন কি চারপাশের বহুদূর পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকা দেখা যাচ্ছে। ‘কোট’ হলো রাজবাড়ি। রাজা যেখানে বসবাস করতেন। এই অঞ্চলের রাজা এই গ্রামে বাস করতেন। তাই এর নাম মাইকোট। নেপালে এরকম বেশ কয়েকটি কোট আছে, যেমন মাইকোট, নাগরকোট, সিমিকোট ইত্যাদি। পাহাড়ের রিজের উঁচু স্থানে এই রাজপ্রাসাদ। দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক সিনেমার সেটে এসে দাঁড়িয়েছি। এখানে দাঁড়িয়ে সুরবিন্দ্রা তার বাড়ি দেখিয়ে বললো, ঐ যে নীল টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে ঠিক তার পাশে যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে যেখানে দুইটা বাচ্চা খেলা করছে সেটাই আমার বাড়ি। ওরা আমার বড় ভাইয়ের বাচ্চা। আমার বউ আর একটা বাচ্চা কাঠমান্ডুতে আছে। আমি কাঠমান্ডুতেই থাকি। 

গ্রামের উপরে সাদা রঙের একটি চোরতেন দেখা যাচ্ছে। চোরতেনকে স্তুপাও বলা হয়। এটা বৌদ্ধদের একটি ধর্মীয় স্থাপনা। সেটা দেখিয়ে সুরবিন্দ্রা বললো, ওটা আমদের এই গ্রামের প্রধান চোরতেন। ওখানে আমার উপসনা করি। চলো তোমাদের আমার বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাই। তার বাড়িতে অনেক আপেল হয়। সেই আপেলগুলো বেশ মিষ্টি। সে তার শৈশবের গল্প বলতে বলতে আমাদের নিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিচ্ছে। কিছুটা চড়াই উঠে এসে তার বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছালাম। তার বন্ধু বাড়িতে নেই। কাজে বেরিয়েছেন। বাড়িতে শুধু তার বন্ধুর স্ত্রী ও ছোট বোন। বারো মাসের একটা বাচ্চাও আছে। আমরা বাড়ির উঠানে যাওয়ার পরই তার বন্ধুর বউ হাসি মুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমাদের বসার জন্য রোদের মধ্যে একটি প্লাস্টিকের ত্রিপল বিছিয়ে দিলেন। আমাদের বসতে দিয়েই সুরবিন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা ছ্যাং খাবো নাকি চা? সুরবিন্দ্রা মুহিত ভাইকে জিজ্ঞে করলেন, আমার কী খেতে চাই? মুহিত ভাই বললেন, আগে আমদের আপেল কেটে দাও তারপর চা। এর মধ্যে সুরবিন্দ্রের বন্ধুর বোন বন্ধুর বাচ্চাকে নিয়ে ঘরের বাইরে এসে আমাদের পাশে বসলেন। বোনের নাম জুন। মুহিত ভাই জিজ্ঞেস করলেন, জুন নামের অর্থ কি? জুন মুচকি হেসে মাথা নেড়ে জানালো সে তার নামের অর্থ জানে না। 

সুরবিন্দ্রা জুনকে আপেল পেড়ে দিতে বলল। জুন একটি লম্বা লাঠি দিয়ে আপেল পাড়ার চেষ্টা করছে। আমি আর বিপ্লব ভাই এগিয়ে এলাম। আপেল গাছটি বেশ বড়। গাছে আপেল তেমন নাই। জুন বলল, এই গাছের আপেল সব থেকে বেশি মিষ্টি। অনেক আপেল ধরেছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। আমি গাছে উঠে পড়লাম। গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। গাছ থেকে আপেল ছিঁড়ে আমি নিচে ফেলছি আর বিপ্লব ভাই নিচ থেকে ধরছেন। প্রায় কেজি দুয়েক আপেল হবে। বড় বড় দেখে চারটা আপেল জুনকে দিয়ে মুহিত ভাই বললেন, ভালো করে ধুয়ে ছোট ছোট টুকরো করে নিয়ে এসো। জুন ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে। মুহিত ভাইয়ের কথা বুঝতে তার খুব বেগ পেতে হলো না। 

জুন নার্সিং এর পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্রী। হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করছে। এক সপ্তাহের ছুটিতে এসেছে। ছুটিও প্রায় শেষ, আর একদিন পরেই চলে যাবে হোস্টেলে। আপেল পাড়ার সময় জুনের সাথে কথা বলে এসব জেনেছি। বেশ হাসিখুশি ও মিশুক। সেও আমাদের সম্পর্কে, বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। সে বলছিল, আমাদের কলেজের বেশ কয়েকজন বাংলাদেশে নার্সিং পড়ছে। স্যারদের মুখে শুনেছি। বাংলাদেশে নাকি নার্সিং পড়া ভালো। আমি তাকে বলালম, তুমিও পড়তে যেতে আমাদের দেশে। সে মুচকি হেসে একটু আফসোসের সুরেই বললো, ওরে বাবা, বাংলাদেশে গিয়ে পড়ার টাকা কোথায় পাবো? অনেক টাকা লাগে শুনেছি। তার কথা শোনার পরে আর কিছু বলতে পারলাম না। 

বড় একটি কাসার প্লেটে আপেলগুলো কেটে এনেছে। আমরা বসে বসে আপেল খাচ্ছি। আপেল এতো রসালো আর মিষ্টি হতে পারে? এরকম আপেল আমি আর কখনো খাইনি। এটা শুধু আমার কথা না, মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই এবং সানভি ভাইও একই কথা বললেন। মুহিত ভাই জুনকেও দুই টুকরো আপেল দিলেন। আপেল খেতে খেতে জুনের ভাবি আমাদের জন্য চা বানিয়ে আনলেন। চা খেতে খেতে মুহিত ভাই সুরবিন্দ্রাকে বললেন, এই আপেলগুলো একটা ব্যাগে দিতে বলো, আর এই আপেল আর চায়ের দাম কতো দেব? প্রথমে সুরবিন্দ্রা বলল দাম দিতে হবে না। তবে মুহিত ভাই বললেন, কি যে বলো, টাকা কেনো দেব না? অনেকগুলো আপেল নিচ্ছি। এগুলোর দাম তো দিতেই হবে। সুরবিন্দ্রা জুনের ভাবিকে জিজ্ঞেস করল, কত টাকা দেবে? ভাবি সাফ জানিয়ে দিলেন, টাকা নেব কেনো? তারা গেস্ট, তাদের আপ্যায়ন করেছি টাকা নেওয়ার জন্য? আপনারা আমাদের বাড়িতে এসছেন এটাতেই আমরা খুশি। এই দারুণ মানুষের আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করল। হিমালয়ের মানুষগুলোর সাথে যতোই মেশার সুযোগ পাচ্ছি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বেড়েই চলেছে। 

সুরবিন্দ্রা বললো, চলো তোমাদের অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাই। সামনেই আমাদের এই গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিক। সেটা দেখিয়ে নিয়ে যাই। আমরা একটা ছোট জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। অনেকটাই সমতল রাস্তা। গাছের পাতার ফাঁকা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। সেই রাস্তা দিয়েই জঙ্গল পেরিয়ে এলাম। দুই রুমের ছোট এক ঘর। বাইরে নেপালী ভাষায় ক্লিনিকের সাইনবোর্ড। ক্লিনিকের দরজায় এখনো তালা ঝুলছে। আমার ক্লিনিকের পাশ দিয়ে নিচে গ্রামের দিকে নামছি। রাস্তার পাশে বড় একটি গাছ। সেই গাছের ডালে দঁড়ি বেঁধে দোলনা বানিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলছে। বিপ্লব ভাই দোলনায় বসলেন আর আমি জোরে ঠেলা মারলাম। অনেক উপর পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলো। বিপ্লব ভাইয়ের পর আমিও দোলনায় বসলাম আর বিপ্লব ভাই ধাক্কা দিলো। আমিও অনেক উপরে উঠে এলাম। ভয় পেয়ে গেলাম, যদি দড়ি ছিঁড়ে যায় তাহলে সেই গ্রামের মাঝখানে গিয়ে পড়বো।  

লজে এসে চলে এলাম। আজ বিকেলে স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা আছে। যদি আমরা খেলা দেখতে যাই তাহলে সে আমাদের নিয়ে যাবে। এই বলে এখনকার মতো তিনি চলে গেলেন। এর মধ্যে আস গুরুং এবং মালামালসহ খচ্চরের দলও চলে এসেছে। কিলু আমাদের জানালো আজ আমরা আর লজে থাকছি না। রুম ছেড়ে দিতে হবে। আজ আমরা তাবুতে থাকবো। গ্রামের ভিতরেই একটি খেলার মাঠ। সেখানেই আমাদের ক্যাম্প করা হয়েছে। চারটা ছোট তাবু যেগুলোর প্রতিটাতে দুই জন করে থাকা যায়। একটা কিচেন তাবু এবং একটা ডাইনিং তাবু। লজ থেকে রুকস্যাক গুছিয়ে নিয়ে আমরা ক্যাম্প সাইটে চলে এলাম। দুইজন করে প্রতি তাবুতে থাকতে হবে। আমি আর সানভি ভাই, মুহিত ভাই আর বিপ্লব ভাই, কিলু আর নিমা এবং আংডু আর তামটিং। যেহেতু কিচেন তাবু এবং ডাইনিং তাবু বড় সেহেতু কিচেন তাবুতে কিচেন স্টাফ এবং ডাইনিং তাবুতে পোর্টাররা থাকবে। (চলবে)   

পড়ুন নবম পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়