ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

ঢাকার খুব কাছেই বালিয়াটি জমিদার বাড়ি

ফয়সাল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫২, ৩ অক্টোবর ২০২৪   আপডেট: ১৫:৫৬, ৩ অক্টোবর ২০২৪
ঢাকার খুব কাছেই বালিয়াটি জমিদার বাড়ি

ঢাকার খুব কাছেই চমৎকার দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। এই বাড়ির অনেক গল্প শুনেছি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে। বন্ধুর বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে একসময় তাদের পরিবারের আবাসিক ভবন ছিল বালিয়াটি জমিদার বাড়ির একাংশ। শুনেই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে পরিবারসহ থাকতো তারা! কতো রহস্য ও রোমাঞ্চঘেরা ছিল সেই সময় আমার ঐ স্কুল পড়ুয়া বন্ধু ও তার ভাইবোনদের জীবন! রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’র মেহের আলী কী এখানেও তাদের বলতো ‘তফাৎ যাও, তফাৎ যাও!’ আমি গল্প শুনতাম আর ভাবতাম কবে দেখতে যাবো এই বিশাল প্রাসাদোপম জমিদার বাড়ি! 

খুব দূরে নয়। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩৫ মাইল উত্তরপশ্চিমে এবং মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৫ মাইল পূর্বে সাটুরিয়া উপজেলায় বালিয়াটি গ্রামে এই জমিদার বাড়ির অবস্থান। বাড়িটি প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। ইংরেজ আমলের শুরুতে যারা জমিদারি লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে বালিয়াটির জমিদারি অন্যতম। আঠরো শতকের মাঝামাঝি এই এলাকার ধনাঢ্য লবণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ রায় সাহা বালিয়াটি জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন। ৫.৮৮ একর জমির উপর এই বাড়ি নির্মিত। পরবর্তীকালে তার চার ছেলে বাড়ির সামনের চারটি প্রাসাদসহ ভেতরের স্থাপনাগুলো নির্মাণ করেন। 

অবশেষে বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে একদিনের একটি পারিবারিক ভ্রমণের আয়োজন করি। বেশ সকালে রওয়ানা দিয়ে পৌঁছে যাই বিশাল বালিয়াটি এস্টেটে। তখনো এটি প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নেয়া হয়নি। আমরা ঘুরে দেখি বাড়ির বিভিন্ন অংশ। জানা যায়, এই জমিদার বাড়ির উত্তরে একসময় গাজীখালী নামে নদী প্রবাহিত হতো। ১৬,০০০ বর্গমিটার আয়তনের সুবিস্তৃত এই জমিদার বাড়িতে শয়ন কক্ষ, অতিথি কক্ষ, বৈঠকখানা, মালখানা, রান্না ঘর, নাচঘর, দরবার হলসহ মোট ২১৫টি কক্ষ রয়েছে। জমিদারবাড়ির সামনে ও  পেছনে চারটি শান বাঁধানো ঘাটসহ বিশাল দুটি দীঘি রয়েছে। এই দীঘির দক্ষিণে রয়েছে পুজোমণ্ডপ। রয়েছে যাত্রামঞ্চ। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া এক সময় যাত্রাপালার জন্য বিখ্যাত ছিল। বিভিন্ন যাত্রাপালা এবং দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন জমিদাররা। 

জমিদার কিশোরলাল রায় চৌধুরী ১৮৭২ সালে ঢাকার ব্রাহ্ম স্কুল কিনে নিয়ে তার পিতার নামানুসারে জগন্নাথ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলটি কালক্রমে জগন্নাথ কলেজ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। এটিই আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। উল্লেখ্য ১৮৯৮ সালে ‘ডায়মন্ড জুবিলি’ নামে ঢাকায় পেশাদারী থিয়েটারের প্রচলন করেছিলেন জমিদার কিশোরলাল রায়। তিনি বালিয়াটি জমিদার বাড়ির সন্নিকটে স্থাপন করেন ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়। চারটি প্রাসাদোপম বাড়ির উত্তর বাড়িতে এখনো জমিদারদের পরবর্তী প্রজন্মের একটি পরিবার বাস করে। এক সময় ডাকসাইটে সামন্তীয় জমিদারের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে তারা নিজেদের অস্তিত্ব এখনো টিকিয়ে রেখেছে। 

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সাথে সাথে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বালিয়াটি জমিদারেরা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অর্থ ব্যয় করলেও সাধারণ প্রজা বা কৃষকদের প্রতি সদয় ছিলেন না। তাদের নির্মমতার কারণে কৃষকরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিল। ১৯৪৭ সালে অত্যাচারিত প্রজারা জমিদারের পশ্চিম ও মধ্যবাড়ি দুটি দখল করে নেয়। তখন শুধু পূর্ববাড়িতে জমিদারদের অবস্থান ছিল। ক্ষুব্ধ প্রজাদের ভয়ে ১৯৪৮ সালে জমিদাররা সপরিপারে ভারত চলে যান। এরপর দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ১৯৮১ সালে স্থানীয় সরকার অধিগ্রহণ করে সরকারি কার্যালয় ও বাসভবন হিসেবে বাড়িটি ব্যবহার করতে শুরু করে। সরকারি বাসভবন হওয়ার সুবাদে এবং মানিকগঞ্জে বদলির কারণে আশির দশকে আমার বন্ধুর বাবার আবাসস্থল ছিল এই জমিদার বাড়ি। 

মাঝের প্রাসাদটি এখন জাদুঘর। আশপাশের এলাকা ঘুরে আমরা জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করি। জমিদার বাড়ি ঘিরে থাকা সুউচ্চ প্রাচীরে তিনটি চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর ফটক রয়েছে। দেখতে দেখতে আমরা ২০০ বছরের ইতিহাসের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প শুনতে থাকি। পুকুরপাড়ে বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ। বর্তমানে ‘বালিয়াতি প্রাসাদ’ নামকরণ করে বাংলাদেশ প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর এই জমিদার বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছে। পুরনো সেই সময়, শৈলী, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের সমন্বয় করে সাজানো হয়েছে গ্যালারিসমূহ। 

আমরা বালিয়াটি জমিদার বাড়ি দেখা শেষ করে এখান থেকে ৮ কি.মি. দূরে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি দেখতে যাই। এটি টাঙ্গাইল জেলায় পড়েছে। বেশ কারুকার্য খচিত এই জমিদার বাড়ি ১৯৬৭ সাল থেকে একটি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

কলকাতা থেকে আগত ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ১৯১৫ সালে জমিদারী শুরু করেন। প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে একই নকশাঁর পরপর তিনটি প্যালেস বা অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়। তখন জমিদার বাড়িটি তিন মহলা বা তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল।

মানিকগঞ্জের আরো কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন জমিদার বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে জেলা সদরে অবস্থিত বেতিলা জমিদার বাড়ি এবং শিবালয় উপজেলায় তেওতা জমিদার বাড়ি অন্যতম। পদ্মা নদীর পাড়ঘেরা অপরূপ সুন্দর মানিকগঞ্জে আরেকটি বড় আকর্ষণ হচ্ছে শীতকালে দিগন্ত বিস্তৃত সরিষার ক্ষেতে ঘুরে বেড়ানো। বালিয়াটি জমিদার বাড়ির বিশালত্ব এবং পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির কারুকার্যময় নান্দনিক সৌন্দর্যের রেশ এবং ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গ মাথায় নিয়ে আবার মানিকগঞ্জের কথা ভাবতে ভাবতে আমরা ঢাকা ফিরে আসি।

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়