তৃতীয় পর্ব
পেনিনসুলার পথে পথে
তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম
এ. পি. জে আবদুল কালামের পৈত্রিক ভিটা
পঞ্চম দিন ভোরে কন্যাকুমারিকা বীচ ও সূর্যোদয়ের শোভা উপভোগ শেষে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে সকালের খাওয়ার পর্ব শেষ করি। সকাল ৯টায় আমরা বিবেকানন্দ স্মৃতিসৌধ দর্শনের লক্ষ্যে বের হই। মূল ভূখণ্ড থেকে শিলার দূরত্ব ৩০০ মিটার। সমুদ্রে জলের তোড় বেশ। দক্ষিণার বিনিময়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পার হতে হয়। অবশ্য সকলের কাছে লাইফ জ্যাকেট রাখা বাধ্যতামূলক। ৮-১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছি যাই। স্মৃতি মেমোরিয়াল কমিটির মূল পরিকল্পনায় মূল ভূখণ্ড থেকে বিবেকানন্দ শিলায় সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা ছিল। অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। সম্ভবত পর্যটন বাণিজ্যের কথা ভেবে তা করায় আপত্তি ছিল।
এখানে আসার পর বেদবাণী মনে পড়ে ‘আত্মানং বিদ্ধি’। ব্রহ্মচারী নরেন দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ) সম্ভবত তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ ও আত্মদর্শনের জন্যই নগ্নপদে ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ভারতের সর্বদক্ষিণে কন্যাকুমারীতে এসে তিনি ত্রিবেণী সঙ্গমে সমুদ্র স্নান শিলায় ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন। শিলাখণ্ডের উপর নির্মিত ধ্যানমণ্ডপে গণধ্যানের আয়োজন করা হয়েছে। ওখানে ধ্যান করে যে কেউ প্রগাঢ় শান্তি অনুভব করতে পারেন। বিশেষ করে এখানে শ্রুত নিরন্তর নাদধ্বনি মর্মভেদী। আইডিয়াটি অভূতপূর্ব। স্মৃতিসৌধ ও ধ্যানমণ্ডপের অসাধারণ পরিকল্পনা ও পাথরের সূক্ষ্ম অনবদ্য কাজ দেখে বিমোহিত হতেই হয়। জাতি, ধর্ম ও বর্ণের সকল মানুষ এখানে এসে অপার শান্তি উপভোগ করতে পারেন।
স্বামী বিবেকানন্দর স্মৃতিসৌধ
দুপুর একটায় শিলা থেকে নেমে, খাওয়া সেরে হোটেলে সী শোরে ফিরি। বিকেলে সূর্যাস্ত, সন্ধ্যায় গাঁধি স্মৃতিসৌধ ও কন্যাকুমারী মায়ের মন্দির পরিদর্শন এবং তিন সমুদ্রের হাওয়া উপভোগ শেষে হোটেলে ফিরি। বলছি বটে তিন সমুদ্রের কথা। আসলে আমার কাছে সবই একই সমুদ্রের জল মনে হয়েছিল। আলাদা করে কোনটা কোন সাগর বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। তবু সবাই যখন বলছেন, মানচিত্রেও দেখাচ্ছে কল্পনার চোখে দেখে তৃপ্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে রাতের আহার সারতে হয়। সী শোর নামে হোটেল, কাজে নয়। এখানে আহারের ব্যবস্থা নেই। যা হোক, হোটেলের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ভালো। বিবেকানন্দ শিলায় সকলে ট্যাপ থেকে জলপান করছে দেখে আমারও পানের ইচ্ছা হয়। ছেলের সাবধান বাণী ভুলে পান করেছিলাম। ব্যাস, রাত থেকে অজান্তে লুঙ্গি ভিজতে শুরু করে। গৌতম ওষুধ দিলে একটু কমে। ভিতরে শঙ্কা, আরো তিন দিন আমার জন্য সকলের আনন্দ মাটি হবে না তো! পরদিন সকাল সাড়ে ৮টায় রামেশ্বরম যাত্রা। এ.সি ট্র্যাভেলার বাহনে কন্যাকুমারী থেকে রামেশ্বরমের দূরত্ব প্রায় ৩১০ কিলোমিটার। সময় লাগবে প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা।
ভোরে উঠে কেউ কেউ সমুদ্র সৈকত ও আশপাশে ঘোরাঘুরি করে ফিরেছেন। স্নান সেরে, পোশাক পরে সকলে ডাইনিং হলে টিফিন খেতে আসেন। টিফিন তো নয়, রাজভোগ। কোভেলামের সমুদ্র তীরম বীচ রিসোর্টেও সকালের টিফিনে আইটেমের এলাহী কাণ্ড ছিল। এখানেও তাই। বুফে সিস্টেম। যার যতো ইচ্ছা খাও। আমি অবশ্য রয়েসয়ে খেলাম। কোনো আইটেম ফুরিয়ে গেলে আবার যোগান দিচ্ছেন। আপনার বা বাচ্চার প্রয়োজনে কেনো কোনো আইটেম নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হলে তাতেও বাধা নেই। তবে তা খারাপ দেখায় বলে খুব লোভী ব্যক্তি ছাড়া অনেকে এই কর্মটি করেন না। হোটেল প্রদত্ত মিনি সাবান, টীব্যাগ, কফি ব্যাগ, টুথ পিক, টিস্যু পেপার, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ নিয়ে আসতে পারেন। ছোট বড় তোয়ালে, রিমোট কন্ট্রোল ইত্যাদি আনলে জরিমানা গুণতে হবে। অসম্মান তো উপরি পাওনা।
মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধ
ঠিক সাড়ে আটটায় রামেশ্বরমের উদ্দেশ্যে রওনা। রামের ঈশ্বর, রামেশ্বরম ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামনাথপুরজেলার একটি শহর ও পৌরসভা। এটি চেন্নাই থেকে ৪২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে একটি শঙ্খ আকৃতির দ্বীপ। এর চারদিকে রয়েছে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর। দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে শিবমন্দির। এই মন্দিরে দ্বাদশ জ্যোতির্ময় শিবলিঙ্গ বিদ্যমান বলে ভক্তদের বিশ্বাস। রামেশ্বরম বা পামবান দ্বীপ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে পামবান চ্যানেল দ্বারা বিচ্ছিন্ন। রামেশ্বরম শতবর্ষী পামবান রেল সেতু দ্বারা মূল ভূখণ্ড ভারতের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৮৮ সাল থেকে রেলওয়ে সেতুর পাশাপাশি আন্নাই ইন্দিরা গান্ধী রোড ব্রিজ ব্যবহৃত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে রোডের উচ্চতা ১০ মিটারের বেশি। এর নিচ দিয়ে ছোট জাহাজ ও নৌকা চলাচল করতে পারে। জাহাজ পারাপারে রেল সেতুতে মাঝখানের একটি অংশ তুলে রাখার যন্ত্রকৌশল আছে। রামেশ্বর ভারতের নিকটবর্তী শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর নিকটতম বিন্দু।
আমরা দুপুর আড়াইটার দিকে রামেশ্বরমে পা দেই। কিন্তু পুলিশ গাড়ি নিয়ে ভিতরে যেতে দেবেন না। আমার গোপন ইচ্ছা দ্রুত হোটেলে যাওয়া। আধ্যাত্মিক সাধনার মূল কথা নাকি সবসময় ঈশ্বরকে স্মরণে রাখা। স্মরণে থাকতে থাকতে দেহত্যাগ করলে পরমগতিপ্রাপ্ত হয়। কন্যাকুমারি থেকে রামেশ্বরমে আসার পথে ৫-৬ ঘণ্টাই আমার শঙ্কিত মন ছিল পায়ুপথে। ভয়, কখন না অর্ন্তবাস ভিজে যায়। কখন না গাড়ি থামিয়ে ঝোপঝাড়ে বা উন্মুক্ত রাস্তার পাশে নতজানু হয়ে বসতে হয়। হোটেলে ঢোকা মানে আমার পরম স্বস্তি। ভাবি ৫-৬ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বরকে স্মরণে রাখতে পেলে সম্ভবত যোগীপুরুষে উন্নীত হওয়া যায়।
ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছোট গাড়ির ব্যবস্থা করে আমরা হোটেল জীবন রেসিডেন্সিতে পৌঁছাই। হোটেল রুমে গিয়ে স্বস্তির আনন্দ উপভোগ করি। সমুদ্রমুখী পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও সুরুচিসম্পন্ন হোটেল মনে সুন্দর অনুভূতিরও সঞ্চার করে। হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে বিকালে সমুদ্রের পাড়ে বসি। আশপাশে দোকান-পাট কম। সকলে শহরে বেড়িয়ে পড়েছেন। সম্ভবত বিনীতাদি বেরোননি। রামনাথ স্বামিজীর মন্দিরে সকালে পুণ্য স্নান করতে হলে মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আগে যোগাযোগ করতে হয়। ট্যুরাধিপতি ও আরো কেউ কেউ মন্দিরে গিয়েছিলেন। আমি দেখলাম ডান দিকে গেলে সমুদ্রে নেমে যেতে হবে। কারণ এটাই দ্বীপের শেষ প্রান্ত। বাঁয়ে গিয়ে ছোট চায়ের দোকান পাই। ওখানে বসে জল কিনে বিস্কুট খাই। চা-ও পান করি। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরি। ইতোমধ্যে কলকূজনে বুঝতে পারি আরো কিছু পাখি ফিরে এসেছে। রামনাথ স্বামীজীর মন্দিরেও স্নানের ব্যবস্থা করে অরুণ বাবুরা ফিরেছেন।
এ. পি. জে.র সমাধিসৌধ
অনেকে গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথকে চার ধাম মনে করেন। কিন্তু এই চারটি ধাম উত্তরাখণ্ড রাজ্যে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে ভারতজুড়ে চার ধাম রয়েছে। উড়িষ্যা রাজ্যে পুরীর জগন্নাথধাম, তামিলনাড়ু রাজ্যে রামেশ্বরমে রামনাথ স্বামী, উত্তরাখণ্ড রাজ্যে বিষ্ণুর প্রতি নিবেদিত বদ্রীনাথ মন্দির ও গুজরাট রাজ্যে দ্বারকাধীশ (শ্রীকৃষ্ণ) মন্দির। সমর্থ ও ধর্মপ্রাণ সনাতনীরা জীবনে অন্তত একবার চার ধাম দর্শনের চেষ্টা করেন।
রামেশ্বরে রামানাথস্বামীজীর জ্যোর্তিলিঙ্গ মন্দির দৈর্ঘ্যে ৮৬৫ ফুট এবং প্রস্থে ৬৫৭ ফুট। এই মন্দিরের গর্ভগৃহেই রয়েছে শিবের দ্বাদশ লিঙ্গমূর্তি। ভারতের সকল মন্দিরের মধ্যে এর করিডর দীর্ঘতম। ছাদেও রয়েছে অপূর্ব চিত্ররাজি। মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, মন্দির চত্বরের মধ্যে থাকা ২২ টি কূপ। এগুলোকে কুণ্ডও বলা হয়। কুণ্ডগুলোর তাপমাত্রা পরস্পর থেকে আলাদা। ভক্তদের বিশ্বাস এই কূপের জলে স্নান করলে রোগমুক্তি ঘটে।
পরদিন সকালে অনিন্দিতারা স্বামীনাথন মন্দিরে পূজা ও স্নান সেরে আসে। সকালে টিফিন করে ট্যাভেলার বাসে এ. পি. জে আবদুল কালামের পৈত্রিক ভিটা ও রামসেতু পরিদর্শন করে দুপুরে হোটেলে ফিরি।
আমাদের সৌভাগ্য, দরিদ্র ধীবর পুত্র মিসাইল ম্যান, ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি, ভারতরত্ন ও কিংবদন্তি প্রাতস্মরণীয় বিজ্ঞানী, মহামানব এ. পি. জে আবদুল কালামের জন্মস্থানে এসে তাঁর পৈতৃক ভিটা দেখার দুর্লভ সুযোগ লাভ। আভুল পাকির জয়নুলাবেদিন আবদুল কালাম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রামেশ্বরমের মসজিদ স্ট্রীটের ছোট ঘরে এক তামিল মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন। পিতা জয়নালাবুদিন মারাকায়ার। তাঁর একটি নৌকা ছিল। তিনি স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করতেন। মা গৃহবধূ আশিয়াম্মা। তাঁর পরিবার এতোই দরিদ্র ছিল যে, বাবা-মা তাঁকে স্কুলে পড়ানোয় সক্ষম ছিলেন না। শিশু কালাম ভোর চারটায় উঠে প্রাতকৃত্য সেরে শিক্ষকের বাড়ি যেতেন। শিক্ষকের বাড়ি থেকে এসে ট্রেন স্টেশনে গিয়ে খবরের কাগজ বিক্রি করে যা আয় হতো তা দিয়ে স্কুলের বেতন ও পড়ার খরচ চালাতেন। আবদুল কালাম অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজেকে উন্নতির শীর্ষে তুলেছিলেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কালামের ভিটেয় তিন তলার ছোট বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে বাড়িটিতে কালাম মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে।
রাম সেতুকে আ্যাডামস সেতুও বলা হয়। ভারতের তামিলনাড়ু এবং শ্রীলঙ্কার উত্তর পশ্চিম উপকূলে মান্নার দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে পাম্বান দ্বীপ বা রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে প্রাকৃতিক চুনাপাথরের শৃঙ্খলকে রাস্তার মতো দেখায়। এর কিছু অংশ শুষ্ক এবং বেশ কিছু অংশে সমুদ্রের জলের উচ্চতা এক মিটারের নিচে। ভূতাত্ত্বিক প্রমাণে নির্দেশ করে যে, পূর্বের রামসেতু ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল। হিন্দুদের বিশ্বাস, শ্রীলঙ্কায় বন্দী সীতা উদ্ধারে রাম তাঁর ভক্তদের সহায়তায় এই সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে রাবণ নিধন করেছিলেন। চুনা পাথরের খণ্ডগুলো জলে ভাসে। রামেশ্বর থেকে শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপের দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার মাত্র।
পেনিনসুলার পথে পথে দ্বিতীয় পর্ব
তারা//