ঢাকা     শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১২ ১৪৩১

সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন

শাহীন গোলদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:০৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২০:১২, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন

বাস থেকে নামলেই দেখা যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। এ জন্য বলা হয়, সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন! তবে একমাত্র সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ থেকে সরাসরি দেখা যায় এ বনের সবুজ আবহ। কিন্তু সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে নানা কারণে পর্যটক কমছে। এতে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন জীবিকায় ভাটা পড়েছে।

বনবিভাগ সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন ৫১ হাজার ৪৮০ জন দেশি ও ৫০ জন বিদেশি পর্যটক। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন ৪০ হাজার ৯১৪ জন দেশি ও ১৮০ জন বিদেশি পর্যটক। এখন সুন্দরবনে প্রবেশ ফি মাথাপিছু ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা। 

সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পে জড়িত একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, এখানে পর্যটক কমার অন্তত তিনটি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো, সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা, সুন্দরবনের প্রবেশ মূল্য বৃদ্ধি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে সুন্দরবনে রাতে থাকার অনুমতি না থাকা। যদিও বনবিভাগ বলছে, বর্তমানে অনলাইনে সুন্দরবনে প্রবেশের ফি প্রদান করে রিসিট জমা দিলে সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে সুন্দরবনে রাত্রিকালীন অবস্থানের পাস নেওয়া যায়। 

ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা আসতে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগলেও, সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ আসতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। যেমন সড়কের অবস্থা, তেমনি এ সড়কের পরিবহণ ব্যবস্থা। সড়কটি সংস্কার করে চার লেনে প্রশস্ত করা হলে এবং সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে সরাসরি পর্যটকবাহী বাস চলাচলের উদ্যোগ নিলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। 

কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম সেন্টার

সাতক্ষীরা রেঞ্জের অধীনে অবস্থিত কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক ও টহল ফাঁড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। কেন্দ্রটির একদিকে লোকালয় ও আরেক পাশে সুন্দরবন। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে খোলপেটুয়া নদী। বন পেরিয়ে নদী পথে খাল পার হয়ে কলাগাছিয়া যেতে হয়। লোকালয় পার হয়ে সুন্দরবনের পশ্চিমবনের ভিতর দিয়ে কলাগাছিয়া যাওয়ার সময় দুই ধারের সারি সারি বন আপনাকে মুগ্ধ করবেই!

ইকো ট্যুরিজম ঘাটে ট্রলার ভিড়লেই অসংখ্য বানরের দেখা মিলবে। বনের মূল অংশে ঢোকার পথে আছে লোহার তৈরি একটি ব্রিজ। এই ব্রিজ পার হলে একটি রেস্ট হাউজ ও কাঠের তৈরি আরেকটি ব্রিজ রয়েছে। কাঠের সেতুর দুই পাশে আছে খলিশা, গরান, সুন্দরী, গোলপাতা, পশুর, কেউড়া ও বাইন গাছের সারি। আর বনের ভিতরে আছে বানর ও হরিণের দল। ওয়াকওয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে পাঁচতলা ওয়াচ টাওয়ার থেকে পাখির চোখে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম সেন্টারে আরও দেখতে পাবেন কুমির প্রজনন কেন্দ্র, ছবি তোলার স্থাপনা, বসার জন্য গোলপাতার ছাউনি গোলঘর। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির কাকঁড়া, মাছ তো রয়েছেই। 

কীভাবে যাবেন

কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে যেতে হলে প্রথমে সাতক্ষীরা জেলায় আসতে হবে। ঢাকা থেকে যে কেনো পরিবহনের বাসে পদ্মা সেতু হয়ে সাতক্ষীরা যেতে পারবেন। ভাড়া বাসের মানভেদে নন এসি ৬৫০ থেকে ৮০০টাকা, এসি ৯০০ থেকে ১৩০০ টাকা। জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ অথবা নীলডুমুর ঘাট থেকে ট্রলারে কলাগাছিয়া যেতে হয়। তার আগে মুন্সিগঞ্জ ফরেস্ট অফিস এবং বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট অফিস থেকে পাস নিতে হবে। 

নীলডুমুর খেয়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে কলাগাছিয়া যেতে ৪৫ থেকে ৫৫ মিনিট সময় লাগে। ২০ থেকে ২৫ জনের একটি ট্রলারের ভাড়া প্রায় ২ হাজার টাকা। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জ ট্যুরিস্ট ঘাট থেকেও  সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বনের সৌন্দার্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। যেতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। ট্রলার ভাড়া ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার টাকা। 

কোথায় থাকবেন

শ্যামনগরে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। এখানে থাকতে হলে আগে থেকেই মূল্য শুনেবুঝে নিতে হবে। এ ছাড়াও রয়েছে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন কতৃর্ক পরিচালিত সুন্দরবনসংলগ্ন আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম সেন্টার। 

আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম সেন্টার

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সদরে আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম সেন্টার স্পট একেবারে সুন্দরবনসংলগ্ন। এখানে রয়েছে দুটি রেস্ট হাউস। হেঁটে চলাফেরার জন্য রয়েছে কাঠের ব্রিজ, বসার জন্য গোলঘর, এবং পার্কের সঙ্গেই নদী। মাঝেমাঝে সুন্দরবনের হরিণ, বানরের দেখাও  পেয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া ফিস মিউজিয়ামে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির নদীর মাছের কঙ্কাল।

আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম সেন্টারে যেতে হলে সাতক্ষীরা শহর থেকে  শ্যামনগর হয়ে মুন্সিগঞ্জ বাজারে আসতে হবে। মুন্সিগঞ্জ বাজার থেকে এর দূরত্ব আধা কিলোমিটার। টিকিট কাউন্টারে মাথা পিছু ২০ টাকা দিয়ে সারাদিন অবস্থান করতে পারবেন। পার্কে চা-নাস্তার জন্য কিছু দোকান আছে।

কোথায় খাবেন

সুন্দরবনে বেড়াতে এলে মুন্সিগঞ্জ সুশীলন এবং বরসা রিসোর্ট, আকাশলীনা টাইগার পয়েন্টে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সুন্দরবন দেখে যাওয়ার পথে পাচ্ছেন, শ্যামনগর সদরে হোটেল ঠিকানা, মোহাম্মাদিয়া হোটেল, আলামিন হোটেল, সোনার বাংলা হোটেল, কাশেম হোটেলসহ একাধিক হোটেল। এ ছাড়া সাতক্ষীরা শহরে বড় বড় হোটেল তো রয়েছেই। 

যেসব বন্যপ্রাণী দেখা যাবে

সুন্দরবন নানা ধরনের প্রাণীবৈচিত্রে অনন্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। এখানে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, সজারু, উদ বিড়াল এবং বন্য শূকর।

প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির; এদের সংখ্যা প্রায় ২০০। সাপের মধ্যে রাজগোখরা, অজগর, কেউটে এবং কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ উল্লেখযোগ্য। অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্রজাতিগুলোর মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক।

সুন্দরবনে বসবাসকারী ৩২০ প্রজাতির পাখির অধিকাংশই স্থানীয় বা আবাসিক। প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী এবং এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। বক, সারস, হাড়গিলা, কাদা-খোঁচা, লেনজা ও হট্টিটিসহ অসংখ্য উপকূলীয় পাখি এখানকার নদীনালার কিনারায় বিচরণ করে। সমুদ্র এবং বড় বড় নদীর উপকূলভাগে দেখা যায় বহু প্রজাতির গাঙচিল, জলকবুতর, টার্ন ইত্যাদি। চিল, ঈগল, শকুন ইত্যাদিরও দেখা পাওয়া যায় সুন্দরবনে। এ বনে মাছরাঙার দেখা মেলে প্রতিনিয়তই।

এ ছাড়া, কাঠঠোকরা, ভগীরথ, পেঁচা, মধুপায়ী, বুলবুল, শালিক, ফিঙে, বাবুই, ঘুঘু, বেনে, হাঁড়িচাঁচা, ফুলঝুরি, মুনিয়া, টুনটুনি ও দোয়েলসহ রয়েছে নানা ধরনের ছোট ছোট পাখি।

যে গাছ দেখবেন

সুন্দরবনের অধিকাংশ উদ্ভিদ চিরসবুজ হওয়ার কারণে সবার শারীরবৃত্তিক ও গঠনগত অভিযোজন কমবেশি একই রকম। অধিকাংশ বৃক্ষের আছে ঊর্ধ্বমুখী শ্বাসমূল, যার সাহায্যে এরা শ্বসনের জন্য বাতাস থেকে সরাসরি  কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করতে পারে। এ বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া। এছাড়া পশুর, ধুন্দল, গরান, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছও দেখতে পাবেন।

ফিরে আসার আগে 

সুন্দরবন দেখে ফিরে আসার সময় অবশ্যই পরিবার আত্নীয়সহ বন্ধু-বান্ধদের জন্য সুন্দরবনের খাঁটি মধু নিয়ে যেতে ভূল করবেন না। সুন্দরবনের প্রকৃতির খাঁটি মধু নাম ও জশ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।

সুন্দরবনে যে ফুলের মধু পাওয়া যায়, তারমধ্যে রয়েছে খলিশা, গরান, কেওড়া, বাইন, লতা ইত্যাদি। তবে খলিশা এবং গরান ফুলের মধুর স্বাদ সবচেয়ে সুস্বাদু। এই মধুর রঙ এবং ঘ্রাণ উভয়ই অসাধারণ এবং দেশীয় স্বাদু পানির অঞ্চলের মধুর থেকে অনেকটাই ভিন্ন। একইসঙ্গে পাচ্ছেন, সুন্দরবনের নদীর বিভিন্ন মাছ, গলদা ও বাগদা চিংড়ি। এ ছাড়াও রয়েছে সাতক্ষীরার  বিখ্যাত সন্দেশ। 
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়