ঢাকা     রোববার   ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২১ ১৪৩১

আয়রনম্যান: শেষ পর্ব

আমার নাম, দেশের নাম বলা হলো, বুকটা ভরে গেল 

হোমায়েদ ইসহাক মুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ২ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৮:১৯, ২ জানুয়ারি ২০২৫
আমার নাম, দেশের নাম বলা হলো, বুকটা ভরে গেল 

এনার্জি বাঁচিয়ে পথ চলতে হবে। এরপর আরো কঠিন দৌড়ের পর্ব বাকি আছে। ৯০ কিলোমিটার পথ আগেই আমরা দেখে ফেলেছি, সুতরাং এখন রাস্তা কোথায় কেমন কিছুটা মাথায় আছে। পাহাড়ের আপ-এ আমি কোথাও ঠেলে উঠলাম, ডাউনে স্প্রিডে নামলাম, আবার সেই গতি ঠিক রেখে চড়াই উঠে গেলাম চালিয়ে। 

সাঁতারের সময় কিছুটা মাসলপুলের আলামত দেখা দিয়েছিল তাই রিস্ক না নিয়ে সাইকেলের সময় হাইড্রেশন পয়েন্ট থেকে পায়ে স্প্রে করে নিলাম। কলা খেলাম, ইলেকট্রোলাইটের বোতল নিয়ে নিলাম, হাই ফাইভ জেল খেলাম। আমার টার্গেট ৪ ঘণ্টার মধ্যে সাইকেল শেষ করা। যুদ্ধ কর‍তে করতে মরে যাওয়া যাবে না। রাস্তায় দেখলাম অনেক ভালো মানের দামী সব সাইকেল পাংচার হয়ে পড়ে আছে; সেগুলো অপেক্ষা করছে সাহায্যের আশায়। যারা পাচ্ছে তারা সত্যি ভাগ্যবান। গ্রাম-জঙ্গল, পাহাড়ের মাঝখানে কখন চাকা লিক হবে কেউ জানে না। 

পথে আকিককে ক্রস করার সময় বলল, তারও চাকা লিক হয়েছিল। সে মাউন্টেন বাইক নিয়ে গেছে তবে চাকা সরু। পরে শুনলাম নাহিদেরও লিক হয়েছে সিওটু দিয়ে কোনো রকমে পার পেয়েছে। অর্ধেক পথে এসে আমাকে একে একে পিযুশ, রাফাত, আতাউর ভাই ক্রস করেছে। তারা সাইকেল অনেক ভালো চালায় তাই সাঁতারে একটু দেরি হলেও সাইকেলে আমাকে ধরে ফেলেছে। আমি আমার পেইস ঠিক রেখে চালিয়ে যাচ্ছি। এই যুদ্ধ যেহেতু আমার একার সুতরাং কাউকে চেজ করার প্রয়োজন নেই। শুধু কামনা করি, সবাই যেন ভালোভাবে ফিনিশিং লাইন ক্রস করতে পারে। 

আরাফাতকেও পথে পেলাম, ফুল আয়রনম্যান প্রতিযোগীরা আমাদের প্রায় আধাঘণ্টা পরে শুরু করেছে। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের রেইস চলবে। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে লোকালয়ে ঢুকে গেলাম। রাস্তায় দোকানের সামনে বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়েরা সবাই দাঁড়িয়ে আমাদের হাততালি দিচ্ছে। বাচ্চারা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ক্ল্যাপ করতে চাইছে। কেউ আবার নিজ উদ্যোগে পানি-খাবার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। ‘আয়রনম্যান’ বলে আমাদের উজ্জীবিত করে চলেছে। আয়োজকদের দেওয়া সাদা বোতল বাচ্চাদের দিয়ে দিচ্ছে কোনো কোনো প্রতিযোগী। 

মুসুরি এক্সিবিশন সেন্টারের কাছে এসে বেলাল ভাইয়ের দেখা পেলাম। তিনি রাস্তা ভুল করে ২০কিমি অতিরিক্ত চালিয়ে ফেলেছেন এবং আয়োজকরা পেনাল্টিতে অপেক্ষারত রেখেছেন। এক ঝলকে তার আর্তনাদ শুনলাম, ‘দেখেন ভাই আমাকে আটকে রেখেছে!’ তিনি এই লানকাউইতেই আরো কয়েকবার আয়রনম্যান সম্পন্ন করেছেন। তারপরও রাস্তা কীভাবে ভুল হয় এটাই ভেবে পেলামনা। আসলে রেইসের সময় অনেক কিছুই হতে পারে। সব ঘটনার জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। বেলাল ভাই আরো ২০কিমি বেশি মোট ২২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এরপর আবার কাটঅফ টাইমের মধ্যে ৪২কিমি রান করে আয়রনম্যান শেষ করেছিলেন। 

এক্সিবিশন সেন্টারে প্রবেশ করে মনটা শান্ত হলো। হিমশীতল হাওয়ায় লাল গালিচার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে বেশ রাজকীয় মনে হলো নিজেকে। সাইকেল টি-টু এর স্থানে রেখে রানের ব্যাগ থেকে ক্যাপ, বিব আর দেশের পতাকা নিলাম। মোজা পাল্টে নিলাম। শীতল হাওয়া ছেড়ে বের হওয়ামাত্র বুঝতে পারলাম দোযকে প্রবেশ করেছি। 

বেলা একটা বেজে গেছে, মাথার উপর প্রখর সূর্যর মধ্যে দৌড়ে যেতে হবে ২১কিমি। পুলিশ ট্রেনিং একাডেমির রাস্তা ধরে এয়ারপোর্টের দিকে ট্রেক চলে গেছে। রানওয়ে বলতে গেলে উন্মুক্ত, এক পাশে প্লেন উড়ে যাচ্ছে অন্যপাশে সমুদ্র- কি সুন্দর দৃশ্য! কিন্তু এই গরমে দৌড়াতে দৌড়াতে দৃশ্য যে হজম হয় না। তপ্ত রোদে এই দৌড় শেষ হলে এ যাত্রায় পরীক্ষায় পাস। গরমের জন্য সব ব্যবস্থা তারা করে রেখেছেন। ৩ কিলোমিটার পরপর হাইড্রোশন পয়েন্টে বরফ ঠান্ডা পানি বালতি দিয়ে ঢেলে দিলো, ঠান্ডা তরমুজ সাজিয়ে রাখা গপাগপ খেয়ে নিলাম। কোক রাখা আছে ইনস্ট্যান্ট এনার্জি আর জেল তো ছিলই। রানের শুরুর সময় জেল খেয়ে নিলাম। মেডিকেল বুথ থেকে মাসেলে স্প্রে করে জামার ভেতর বরফ ঢুকিয়ে দিলো। এত জল শরীরে যাওয়ার পরেও দেখছি মূত্র বিসর্জনের কোনো খোঁজ নেই। শরীরে অস্বস্তি শুরু হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দৌড়ের গতি কমতে থাকলে আট ঘণ্টার মধ্যে শেষ করা কঠিন হয়ে যাবে। শহরের মধ্যে দিয়ে দুইবার পাক খেতে হয়, চারপাশের দোকানিরা সবাই রাস্তায় নেমে ঘণ্টা বাজাচ্ছে আর আমাদের চিয়ারআপ করছে। মন আবার চাঙা হয়ে উঠলো। 

১০ কিলোমিটার রান শেষে সতীর্থদের সঙ্গে দেখা হওয়া শুরু হলো। নাহিদ, রাফাত, সৌরভদা, আতাউর ভাই আমাকে ক্রস করে যাচ্ছে। তারা আমার আগেই ফিনিশ লাইনে পৌঁছে যাবে। আমি এবার আরেকটু গতি বাড়িয়ে দিলাম। পা যেনো চলতেই চাইছে না। এক পাক ঘুরে এসে লেংগুরা বিচের কাছে ফিনিশ লাইনে পৌঁছে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ঘড়ি দেখে মনে হচ্ছিল আমার তো এখন দৌড় শেষ হবার কথা না। ভলেন্টিয়াররা ঠিক পাশ দিয়ে রস্তা দেখিয়ে দিলো। এরপর বুঝলাম আরো এক চক্কর একই পথে ঘুরে আসতে হবে- যা খুবই বোরিং! 

একটা পিংক কালারের ব্যান্ড হাতে পরিয়ে দিলো। এই চক্করের পর সব উত্তেজনার অবসান হবে। সময় যত যাচ্ছে সূর্যের তাপ আরো বেড়ে চলেছে। পানিয় যা আছে গিলে যাচ্ছি, জেলও খেয়ে ফেললাম। নিচের দিকে সব অবশ হয়ে গেলো মনে হচ্ছে। কিন্তু দৌড় তো থামানো যাবে না, বারবার মনকে তাই বুঝালাম। এয়ারপোর্টের রাস্তায় মারিয়াকে দেখতে পেলাম। তখন সে আমার আগেই ছিল। একটা জায়গায় এসে ইউটার্ন নিতে হয় আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগীদের, আর যারা ফুল দিচ্ছে তারা চলে যাবে সামনে। খুব সুন্দর করে সব ধরনের সাইন দেওয়া আছে এবং ভলেন্টিয়াররাও বেশ সচেষ্ট সহযোগিতার জন্য। লক্ষ্য করলাম মারিয়াকে আর দেখা যাচ্ছে না সামনে। সে ফুল আয়রনম্যানের ট্রেকে ঢুকে গেছে। এখন পুলসিরাত পার হবার মতো অবস্থা, কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। 

আমি প্রাণপণে গতি ঠিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আর বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যাচ্ছি। হাইড্রোশেন পয়েন্টে আর থামার চেষ্টা করলাম না। শহরের দোকানিদের হাততালি পার হয়ে বালির রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। ৮ ঘণ্টা শেষ হতে আরো ১০ মিনিট বাকি আছে। আমি ফিনিশ লাইন দেখতে পাচ্ছি, পকেট থেকে লাল সবুজ পতাকা বের করে দুহাত উঁচু করে যতটুকু শক্তি বাকি আছে দৌঁড়াতে থাকলাম। আমার চোখে পানি চলে এলো। ফিনিশিং লাইনে ঢোকার মুখে লাল গালিচা বিছানো, সাজসাজ রব, সংগীতের মূর্ছনায় উত্তেজনায় ভরপুর। আমি ফিনিশ লাইনে দাঁড়ালাম, মাইকে আমার নাম বলা হলো, আমার দেশের নাম বলা হলো, বুকটা ভরে গেলো আনন্দে। 

আট ঘণ্টার আগেই শেষ করলাম আয়রনম্যান ৭০.৩ মাইল। স্বপ্নের মতো এত দিনের পরিশ্রম আজ সার্থক হলো। নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হলুদ আর নীলের মিশেলে সুন্দর মেডেল আমার গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো। আয়রনম্যান ৭০.৩ ফিনিশার লেখা একটা টাওয়াল জড়িয়ে দিলো শরীরে। জীবনের এই অনন্য অনুভূতি হয়ত কখনো ভুলতে পারব না। 

যারা এ যাত্রায় আমাকে নানা দিক থেকে সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। ইমতিয়াজ ইলাহি ভাই, রিপন ভাইয়ের কাছ থেকে গল্প শুনতে শুনতে আর উৎসাহ পেয়ে এই ফিনিশ লাইনে এসে দাঁড়াতে পারবো তা কল্পনাও করি নাই। অনেক ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা। আর্থিক প্রতিকূলতা পার করতে ক্রাউড ফান্ডিং করতে হয়েছে। সহযোগিতা যেভাবে পেয়েছি, নিজেকে সৌভাগ্যবান বলবো। 
রেজিষ্ট্রেশনের সময় হেদার আমাকে ইউএস থেকে টাকা পাঠিয়েছে। এরপর টাকা পাঠিয়েছে কানাডা থেকে বন্নি, জার্মানি থেকে আমার বন্ধু সুস্মিতা, জাহিদ ভাই, প্রবালদা, জিয়া ভাই, সাহেদ, আমিদ, রিপন ভাই, নাজু আন্টি, সুমিত সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ভিসার জন্য আরিফ ভাই অনেক দিন আমার একাউন্টে টাকা রেখেছেন। এত ভালোবাসা পেয়ে যা কিছু বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাও কম হবে। ধন্যবাদ আমার উপর বিশ্বাস রেখেছেন। আশাকরি ভবিষ্যতেও বড় কোনো অভিযানে যাওয়ার আগে প্রপার কোনো প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর পাবো। এই অর্জন যদি তরুণদের এবং সমাজের কাজে লাগে তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। 

পড়ুন আয়রনম্যান ৩য় পর্ব : পরীক্ষা হলো শুরু

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়