ঢাকা     সোমবার   ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৩ ১৪৩১

এই শীতে চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে

হৃদয় দেবনাথ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৩, ৪ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৭:০৭, ৪ জানুয়ারি ২০২৫
এই শীতে চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে

যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকে আকৃষ্ট করে। তাই পর্যটকরা বার বার ছুটে যায় চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলের চিরসবুজের শোভা আর বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখতে।

১৯টি চা বাগানের সতেজ সবুজ পাতায় পূর্ণ হয়ে আছে শ্রীমঙ্গলের নিসর্গশোভা। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে এবং চায়ের রাজধানী হিসেবে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খ্যাতি সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে।

এই তীব্র শীতে চা বাগানসহ  শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো যেন সেজেছে নতুন সাজে। যেদিকে চোখ যায় উঁচুনিচু পাহাড়, পাহাড়ের বুকজুড়ে চা বাগানের সারি, পাহাড়ি ঝরনা, চারদিকে প্রকৃতির নজরকাড়া সৌন্দর্য, হাজার প্রজাতির গাছ-গাছালি, দিগন্তজোড়া হাওর আর নীল জলরাশি ঢেউয়ের ছন্দে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। 

চা-শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। আয়তনের এ জনপদের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে সারা দেশের। চা, রাবার, লেবু, পান, আনারস ও মূল্যবান কাঠসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাসের কারণে শ্রীমঙ্গলের খ্যাতি রয়েছে সর্বত্র। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে বছরের প্রতিটি দিন মুখরিত শ্রীমঙ্গল। 

দর্শনীয় স্থান

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট: (বিটিআরআই) 
বিচিত্র সব ফুল চারদিকে। এর সঙ্গে বাড়তি পাওনা সারিবদ্ধ পাম, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি বৃক্ষরাজির শোভা। লেকের জলে ফুটন্ত লাল পদ্মফুল। এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে একটি চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র। কর্তৃপক্ষের অনুমিত সাপেক্ষে চা কারখানাসহ পুরো এলাকাটি আপনি দেখে নিতে পারেন। মনোমুগ্ধকর এ এলাকাটি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে হলেও রিকশায় ১০-১৫ মিনিটের পথ। ভাড়া ১০ টাকা।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান: 
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ন্যাশনাল পার্ক লাউয়াছড়ার অবস্থান। ১৯২০ সালে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জায়গাজুড়ে প্লান্টেশন করে তৈরি ধনরাজি এখন ঘন প্রাকৃতিক বনের আকার ধারণ করেছে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই পার্কে দেখা মেলে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পশুপাখি। এখন এই পার্কটি ধীরে ধীরে দেশের শিক্ষা, গবেষণা, ইকো-ট্যুরিজম স্পট হয়ে উঠেছে। শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে অথবা বাসে আপনি আসতে পারেন এ বনে। এখানে আসার পথে রাস্তার দুই ধারে দেখতে পাবেন সবুজ অরণ্য। দেখতে পাবেন বিচিত্র সব পশুপাখি। এসব প্রাণি দেখতে বনের একটু গভীরে যেতে হবে।

বাইক্কা বিল:
বাইক্কা বিল একটি অনন্য স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম এবং জলচর পাখির বিচরণভূমি। এর আয়তন ১০০ হেক্টর। বাংলাদেশের অন্যতম জলাশয় হাইল-হাওরে এর অবস্থান। ২০০৩ সালের ১ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে একটি স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। হাওরটি বর্ষায় ১৪ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গিয়ে ১৩৩টি বিল ও বেশ ক’টি খালে খণ্ডিত হয়ে মোট ৪ হাজার হেক্টর এলাকায় সংকুচিত হয়ে পড়ে। বাইক্কা বিলের প্রধান আকর্ষণ পাখি। সারা বছর বিভিন্ন প্রজাতির জলজ পাখির বিচরণে মুখরিত থাকে এ বিলটি। তবে শীত মৌসুমে প্রচুর পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে।

পশু-পাখি সেবাশ্রম:
এক সময়ের সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানার নাম পরিবর্তিত হয়ে এখন হয়েছে বন্যপ্রাণি ফাউন্ডেশনের পশু-পাখি সেবাশ্রম। সিতেশ রঞ্জন দেবের এই সংগ্রহশালায় রয়েছে সাদা বাঘ, মেছো বাঘ, সোনালি বাঘ, মায়া হরিণ, অজগর সাপ,  বানর, লজ্জাবতী বানর, সজারু, সোনালি কচ্ছপ, বনমোরগ, ময়না, বন্য খরগোশ, সাইবেরিয়ান ডাক, পাহাড়ি বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণি।

ভাড়াউড়া লেক: 
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে জেমস ফিনলে কোম্পানির চা-বাগান। ভাড়াউড়ায় রয়েছে একটি লেক, রয়েছে জলপদ্মের মেলা। চা বাগানের বুকে এই লেকটির আকর্ষণ কম নয়। এখানে আছে বানর আর হনুমানের বিচরণ। শীতে দল বেঁধে আসে অতিথি পাখি। পাহাড়ের কাছাকাছি গেলেই দেখতে পাবেন এক সাথে অনেক বানর। চার পাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন দেখবেন বানরগুলো আপনাকে ভেঙচি কাটছে।

নিম্মাই শিববাড়ি:
আজ থেকে প্রায় ৫৫৩ বছর আগে ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা পরগনার শংকরসেনা গ্রামে নিম্মাই শিববাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে বালিশিরা অঞ্চলের ত্রিপুরার মহারাজা রাজত্ব করতেন। প্রবল শক্তিশালী এ রাজার বিরুদ্ধে কুকি সামন্ত রাজা প্রায়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন। এরকম কোনো একদিন কুকি রাজার বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে মহারাজা একদল সৈন্য পাঠান বিদ্রোহ দমনের জন্য। তুমুল এ যুদ্ধে কুকি রাজা পরাজিত হলেও মহারাজার প্রধান সেনাপতি রণক্ষেত্রে নিহত হন। বিয়ের অল্প ক’বছরের মধ্যেই স্বামীহারা হন মহারাজার কন্যা নিম্মাই। তখনকার দিনে ভারতবর্ষে সহমরণ প্রথা চালু ছিল। কিন্তু রাজকন্যা সহমরণে রাজি না হয়ে স্বামী নিহত হওয়ার স্থানে এসে শিবের আরাধনা শুরু করেন এবং সিদ্ধিও লাভ করেন। তার নামেই শিববাড়ির নামকরণ করা হয় নিম্মাই শিববাড়ি। ঐতিহাসিক এই স্থানটি ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনী, সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আচার-আচরণে একটি অন্যতম তীর্থস্থানের মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত।

মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি:
মাগুরছড়ায় রয়েছে খাসিয়াপুঞ্জি। উঁচু পাহাড়ের ওপর বিশেষভাবে নির্মিত তাদের আবাস। খাসিয়া সম্প্রদায় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করে এখানে। প্রতিটি পুঞ্জিতে একজন করে মন্ত্রী (খাসিয়াদের হেডম্যান) থাকেন। তার অনুমতি নিয়ে পুঞ্জি এলাকা ঘুরে দেখতে পারেন। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পান গাছের সারি চোখে পড়বে। সারি সারি উঁচু পাহাড়ি গাছগাছালি পরম মমতায় পানের লতাকে বুকে ধারণ করে আছে, যা অন্যরকম এক সৌন্দর্য। খাসিয়াপুঞ্জি ভ্রমণ করে আপনি সহজেই খাসিয়াদের স্বতন্ত্র এবং বিচিত্র জীবনধারা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। 

পাহাড় ডোবা লেক:
শ্রীমঙ্গলের বন-পাহাড়, হাওর-বিল আর সবুজের সমারোহে একাকার হয়ে গড়ে ওঠা হ্রদটির নাম পাহাড় ডোবা লেক। বিলাসছড়া চা বাগানের পাদদেশে এই জলাশয়ের অবস্থান। প্রচার না হওয়ায় পর্যটক তথা এলাকাবাসীর পদচারণা খুব একটা হয়নি এ জলাশয় এলাকায়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কালীঘাট রোড ধরে দলই চা বাগানের রাস্তা ধরে বিলাসছড়া পৌঁছা যায়। বিলাসছড়া অফিস ও লিপ হাউস ছাড়িয়ে কিছু সামনে এগুলেই দেখা যায় লেকটি। এটি চা বাগানের ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত। সবুজ বন বনানী বেষ্টিত পাহাড় ডুবে পরিণত হয়েছে বিশাল জলরাশিতে। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে জলের পাশ দিয়ে নতুন একটি রাস্তা করা হয়েছে। এলাকাটির প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তবে বিলাসছড়া চা বাগানের সুপারিনটেনডেন্টের অথবা বিটিআরআই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বেড়ানো যায় এখানে। 

রামনগর মনিপুরী পাড়া:
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে মনিপুর রাজপুরুষ মোয়রাং থেম গোবিন্দের নেতৃত্বে একদল মনিপুরী মনিপুর রাজ্য ছেড়ে শ্রীমঙ্গলের খাসগাঁওয়ের রামনগরে এসে আবাস গড়েন। খাসগাঁওয়ে রয়েছে মোয়রাং থেম গোবিন্দের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ, যা একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। স্বতন্ত্র কৃষ্টি, সভ্যতা, ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণসমৃদ্ধ এক বৈশিষ্ট্যময় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে আপনিও এই পাড়ায় আসতে পারেন। এখানে আপনি মনিপুরী মেয়েদের তাঁতের কাপড় বুননের দৃশ্য দেখতে পাবেন এবং পছন্দ মত শাড়ি, চাদর, ওড়না ইত্যাদি কিনতে পারেন। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কালিঘাট চা-বাগানের রাস্তা ধরে দুই কিলোমিটার পথ পেরুলেই আপনি পৌঁছে যাবেন মনিপুরী পাড়ায়।

হাইল-হাওর:
শ্রীমঙ্গল শহরের পশ্চিম প্রান্তে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে বৃহত্তর সিলেটের মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত বিখ্যাত হাইল-হাওর। এই হাওরে শীত মৌসুমে সাতসমুদ্র তেরনদী পার হয়ে বেড়াতে আসে অতিথি পাখিরা। তারা দল বেঁধে হাওরে সাঁতার কেটে বেড়ায়। হাওরের জলে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, অতিথি পাখিদের জলকেলী, আর পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত পর্যটকদের মনকে ভরিয়ে তুলবে অনাবিল আনন্দে।

পরিত্যক্ত গ্যাসকূপ:
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন গভীর রাতে এ গ্যাসকূপে ড্রিলিংয়ের সময় অগ্নিবিস্ফোরণে আশপাশের খাসিয়াপুঞ্জি, চা বাগান, রেললাইন, সবুজ বনাঞ্চল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই গ্যাসকূপটি এখন পরিত্যক্ত এবং সংরক্ষিত এলাকা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। ৭ বছর ধরে এ এলাকাটিতে পুনরায় সজিবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বন বিভাগ। আগুনে পোড়া গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাগুরছড়ায়। শ্রীমঙ্গল থেকে সড়কপথে এখানে আসতে নয়ন ভোলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।

ডিনস্টন সিমেট্রি:
শতবর্ষের স্মৃতিবিজড়িত শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রির ইতিহাস মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ডিনস্টন চা বাগানে এর অবস্থান। আজ থেকে শতাধিক বছর আগে শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন চা বাগানে ডিনস্টন সিমেট্রির গোড়াপত্তন হয়। ১৮৮০ সালে এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের দ্বারা বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হওয়ার পর সুদূর ব্রিটেন থেকে এখানে চা চাষি ও ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটতে থাকে। জাহাজ, ঘোড়ার গাড়ি কিংবা হাঁটার সেই যুগে সেসব বিদেশিদের অনেকেই এই অঞ্চলে মারা যায়। তাদের সমাহিত করা হয় শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রিতে। উঁচু নিচু পাহাড়ঘেরা চিরসবুজ চা বাগানের মাঝে অবস্থিত সিমেট্রিতে বিদেশিদের কবর রয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে পাঁচটি কবরে কোনো পরিচিতি নেই। এখানে গেলে একই কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত ব্রিটিশ দম্পতি কিংবা নিষ্পাপ শিশুর কবর আমাদের মনকে অদ্ভুত বিষণ্নতায় ছুঁয়ে দেয়।

জলপ্রপাত যজ্ঞকুঞ্জের ধারা:

শ্রীমঙ্গলের একমাত্র জলপ্রপাত যজ্ঞকুঞ্জের ধারা। এটি জাগছড়া চা বাগান এলাকায় অবস্থিত। জলপ্রপাত দেখতে আপনি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মৌলভীবাজার রোড হয়ে কাকিয়া নেমে ডান দিকে জাগছড়া চা বাগান চলে যাবেন। অথবা শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভাড়াউড়া চা বাগান হয়ে কাঁচা রাস্তায় জাগছড়া চা বাগানে কাউকে জিজ্ঞেস করে চলে যাবেন জাগছড়ার ১৪ নং সেকশনে। সেখানে চোখে পড়বে একটি ব্রিজ। ব্রিজের ডান পাশ দিয়ে ছড়ার পাড় ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই শুনতে পাবেন শোঁ শোঁ শব্দ। জনশ্রুতি রয়েছে- শ্রীমঙ্গলের কালাপুরে প্রাচীন বেলতলীতে দেবস্থান নির্মাণ করেন তৎকালীন রাজা। দেবস্থান নির্মাণকালে বিরাট যজ্ঞস্থানকে পরিষ্কার করে যে পয়ঃপ্রণালি সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই জলপ্রপাতের আকার ধারণ করে, যা আজো যজ্ঞধারা বা যজ্ঞছড়া নামে কথিত রয়েছে।

পাহাড় ডোবা লেক:
শ্রীমঙ্গলের বন-পাহাড়, হাওর-বিল আর সবুজের সমারোহে একাকার হয়ে গড়ে ওঠা হ্রদটির নাম পাহাড় ডোবা লেক। বিলাসছড়া চা বাগানের পাদদেশে এই জলাশয়ের অবস্থান। প্রচার না হওয়ায় পর্যটক তথা এলাকাবাসীর পদচারণা খুব একটা হয়নি এ জলাশয় এলাকায়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কালীঘাট রোড ধরে দলই চা বাগানের রাস্তা ধরে বিলাসছড়া পৌঁছা যায়। বিলাসছড়া অফিস ও লিপ হাউস ছাড়িয়ে কিছু সামনে এগুলেই দেখা যায় লেকটি। এটি চা বাগানের ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত। সবুজ বন বনানী বেষ্টিত পাহাড় ডুবে পরিণত হয়েছে বিশাল জলরাশিতে। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে জলের পাশ দিয়ে নতুন একটি রাস্তা করা হয়েছে। এলাকাটির প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তবে বিলাসছড়া চা বাগানের সুপারিনটেনডেন্টের অথবা বিটিআরআই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বেড়ানো যায় এখানে।

শ্রীমঙ্গলের ‘চা-কন্যা ভাস্কর্য: 
চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় পানীয় চা। আর চা উৎপাদনে বাংলাদেশের মধ্যে শ্রীমঙ্গল জনপ্রিয়। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির বিস্ময়কর চমক চা। বিশ্বের বুকে এই চমক আবিষ্কারের পর থেকেই চায়ের স্বাদে মেতে থাকছে চা-প্রেমীরা। বাঙালির ঘরে ঘরেই এখন চায়ের সঙ্গে সখ্যতা। বন্ধুদের আড্ডায়, অতিথি আপ্যায়নে কিংবা অবসাদ কাটাতে চায়ের বিকল্প নেই। চায়ের কাপে প্রতিটি চুমুকেই তৃপ্ততা মেলে।চায়ের স্থান শ্রীমঙ্গল। যেখানে ঢুকতেই চোখে পড়বে চা-কন্যার ভাস্কর্য। যেখানে লেখা রয়েছে ‘চায়ের দেশে স্বাগতম’। এখানেই শুরু প্রকৃতির সৌন্দর্য। শ্রী আর মঙ্গলে নিহিত শ্রীমঙ্গলে রয়েছে প্রকৃতির অপরূপ সাজ। সবুজ শ্যামলের সমারোহে ভরপুর।

শ্রীমঙ্গলের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে চায়ের বাগান। পুরো অঞ্চলজুড়েই রয়েছে শুধু চা-বাগান। শ্রীমঙ্গলকে তাই দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশও বলা হয়। দেশের অধিকাংশ চা-বাগান শ্রীমঙ্গলের চারদিকেই অবস্থিত। সেই সঙ্গে রয়েছে লেবু ও আনারসের বাগানও। পথের ধারেই ছোট-বড় আনারস বিক্রি হচ্ছে। চায়ের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছে লেবু ও আনারসের কদরও কিন্তু কম নয়।বৃহত্তর সিলেটের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছোট্ট এই শহরটি, যার চারপাশ পাহাড় ও চা-বাগানে বেষ্টিত রয়েছে। সড়ক বা রেলপথে ঢাকা থেকে যাওয়া যাবে শ্রীমঙ্গলে। পাহাড় ও চা-বাগানের বুক চিরে আঁকাবাঁকা পথ ধরেই গন্তব্যে পৌঁছাবে প্রকৃতিপ্রেমীরা। শ্রীমঙ্গলে পৌঁছে যাওয়ার বার্তা মিলবে চা-কন্যার ভাস্কর্য দেখেই। সাদা রঙের ভাস্কর্যটি ফুটে উঠেছে বিশাল জায়গাজুড়ে। ভাস্কর্যের চারপাশেই চা-বাগানে ঘেরা। শ্রীমঙ্গলের প্রবেশদ্বারে নির্মাণ করা হয়েছে অপরূপ সাজে সজ্জিত এক ‘চা-কন্যার ভাস্কর্য’। স্থানীয়রা জানান, পর্যটন নগরী হিসেবে খ্যাত শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আকর্ষণীয় করে তুলতেই এই ‘চা-কন্যার ভাস্কর্য’ নির্মাণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। দেশের সব চা-শ্রমিকের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সবই যেন মিলেমিশে রয়েছে ‘চা-কন্যা ভাস্কর্যটি’তে। মনমুগ্ধকর এই ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি পর্যটক সেখানে ভিড় করেন। ক্যামেরাবন্দী করেন নিজেদের সেই মুহূর্তকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিভৃত অরণ্যভূমি শ্রীমঙ্গল এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। বিভিন্ন রিসোর্ট বা হোটেলে থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেন পর্যটকরা। শীতের কুয়াশা হোক কিংবা বর্ষার বৃষ্টির শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্য সব সময়ই সুন্দর। সেই অঞ্চল সম্পর্কে, অঞ্চলের চা-শ্রমিকদের জীবন সম্পর্কে পর্যটকদের আগ্রহও বেড়ে চলেছে।

কোথায় এই ‘চা-কন্যার ভাস্কর্য’:
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে হবিগঞ্জ জেলার শেষ সীমান্তে এবং মৌলভীবাজার জেলার প্রবেশদ্বারের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার আমতলী চা-বাগানসংলগ্ন মুছাই বাজার। এখানেই শ্রীমঙ্গলের প্রবেশপথ। সেই রাস্তার বাঁ পাশে অবস্থিত ‘চা-কন্যার ভাস্কর্য’।

চা-কন্যার ভাস্কর্যের নেপথ্যে:
২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাস। শুরু হয় ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকেই শেষ হয়। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির প্রকৌশলী সঞ্জিত রায়ের হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ায় নির্মিত হয় চমৎকার এই শিল্পকর্মটি। প্রায় ২৪ ফুট উঁচু এই ভাস্কর্যটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এক নারী চা-শ্রমিককে। যার কোমল হাতে চা পাতা তোলার মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। ভাস্কর্যটির অপরূপ সৌন্দর্য আর কারুকাজে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে শ্রীমঙ্গলের পরিবেশ ও প্রতিচিত্রের রূপ। সেই সঙ্গে কারুশিল্পকারের হাতের নৈপূণ্যতারও প্রমাণ মিলেছে এই ভাস্কর্যে। চা-বাগান এবং চাশিল্পের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত নারী চা-শ্রমিকরা। এই বিষয়কে শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এই ভাস্কর্যে। প্রকৃতিপ্রেমীরাও মনোরোম এই দৃশ্য উপভোগ করেন প্রতিদিন।

ঢাকা/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়