দ্যা বাকেট লিস্ট
শ্রীলঙ্কায় স্কুবা ডাইভিংয়ের পরিকল্পনা
হোমায়েদ ইসহাক মুন || রাইজিংবিডি.কম
কোয়েমবাটুরে থেকে ইনডিগোর উড়ানকাল বেলা গড়িয়ে পরার পর। একটানা ওড়ার পর চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, যাকে ‘মেনামবাক্কাম এয়ারপোর্ট’ নামে স্থানীয়রা চেনে।
এক সপ্তাহ আগেই কলকাতা থেকে সাউথে চেন্নাই হয়ে কেরালার কচি এবং মুন্নার, এরপর তামিলনাডুর উটি ঘুরে কোয়েমবাটুরে থেকে উড়ান মাত্র পঞ্চান্ন মিনিট। আবার চেন্নাই এলাম। গন্তব্য কলম্বো। চেন্নাই বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারো ইন্ডিগো উড়ল মধ্যরাতে। উড়োজাহাজে বসে নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান মনে করলাম। অনেকদিন পর একদম নতুন কোনো দেশে নতুন গন্তব্যে নিজেকে আবিষ্কারের আশায় উড়ে চলেছি।
ব্যাগ প্যাকিং করে ঘোরাঘুরি করতে হলে পয়সা বাঁচিয়ে চলতে হয়, আর সেইসব ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে হয়। তাই কলম্বো যাওয়ার জন্য এই রুটটাই বেছে নিলাম। ভারত থেকে অন্য কোনো দেশে ফ্লাই করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী ভারতে প্রবেশের পর তিনদিন থাকতে হয়। ঘুরতে ঘুরতেই আমার ১৫দিন থাকা হয়ে গেল। কচিতে এসে সায়েমের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সে আমার আসার পনেরো দিন আগেই এই অঞ্চল চষে বেড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কা যাবার পরিকল্পনা যখন শুরু হয় তখন সায়েমের সঙ্গে আলোচনা হয় এবং একসঙ্গে একটা সফরের প্ল্যান করি। তবে এই দেশে যাবার জন্য যে সুপ্ত বাসনা অনেক দিন থেকে জমে ছিল তা অন্য আরেকটা কারণে। আমার বাকেট লিস্টে একটা টিক চিহ্ন যোগ করতে এই ট্রিপটার বড় দরকার ছিল।
মধ্যরাত, আকাশ ঘন অন্ধকার। ইন্ডিগোর এয়ারবাস এ ৩২০-২১২ প্রধান রানওয়ের দিকে এগিয়ে চলল। হলুদ বাতিগুলো জ্বলজ্বল করছে দুপাশের রাস্তায় সারি বেঁধে। গতি বাড়িয়ে দেখতে দেখতে চেন্নাইয়ের মাটি ছেড়ে একটা চক্কর মেরে ইন্ডিয়ান ওশানের দিকে উড়ে গেল। তারপরই জেটপ্লেন সুলভ অবলীলায় সোজা মেঘ ফুঁড়ে নিচের পৃথিবীকে চোখ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টায় ক্রমাগত উপরে উঠতে লাগল। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। উপর থেকে আর কিছু দেখার সুযোগ নেই। এক ঘণ্টা বিশ মিনিট পরে উত্তর দ্রাঘিমাংশ থেকে একটু আলোকরেখা উঁকি দিয়েছিল। ভারত মহাসাগরের উপরে উড়োজাহাজের বাঁক নেওয়াটা খুব সিনেম্যাটিক বোধ হচ্ছিল। এতো বিশাল মহাসাগরের উপরে ভেসে চলেছি, এর তলদেশ জানি আরো কত বিশাল আর বৈচিত্র্যময়; খুব দেখার ইচ্ছে জাগে মনে।
এই ভারত মহাসাগর হলো পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। পৃথিবীর মোট জলভাগের ২০ শতাংশ এই মহাসাগর অধিকার করে আছে। বাংলাদেশ থেকে উত্তর দিকে ভারত মহাসাগরের অবস্থান। শ্রীলঙ্কা মূলত এই ভারত মহাসাগরের একটা বলয়ের মধ্যে রয়েছে।
বন্দরনায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট বেশ পুরনো বিমানবন্দর, শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এ সময় এসে তেমন অত্যাধুনিক বা জাঁকজমকপূর্ণ মনে হলো না। ছিমছাম ঝামেলামুক্ত। কলম্বো প্রধান শহর থেকে প্রায় সাড়ে বত্রিশ কিলোমিটার দক্ষিণে এই বিমানবন্দরের অবস্থান। বিশ ডলার দিয়ে অনলাইনে ভিসা নিয়ে রেখেছিলাম। আলাদা কাউন্টার থেকেও আরো পাঁচ ডলার বেশি দিয়ে ভিসা সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখা আছে। বর্তমানে ভিসা নিতে ৫০ ডলার খরচ করতে হবে।
ভারতীয় ইমিগ্রেশন নিয়ে একটু ভাবনায় ছিলাম কি না কি জিজ্ঞেস করবে, সবাই নানা কথা বলে একটু ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পরে দেখলাম ভারতীয় অফিসার কিছুই জিজ্ঞেস করলো না, বরং কলম্বো ইমিগ্রেশনে অফিসার আমাদের ফিরতি টিকিট আর হোটেল বুকিং দেখতে চাইল। সব ঠিকঠাক করাই ছিল, সিল দিয়ে ছেড়ে দিল।
প্রথম দিন কলম্বোতে উঠেছিলাম মালাবের কোকাকোলা হোস্টেলে। পাহাড়ি রাস্তা, শহর থেকে দূরে বেশ নিরিবিলি থাকার পরিবেশ। সেখানে সকালের নাস্তা ছিল বিনামূল্যে অর্থাৎ কমপ্লিমেন্টারি। শ্রীলঙ্কার প্রধান খাবার আমাদের মতো ভাত মাছ। সঙ্গে আরো থাকে নারকেল দিয়ে রান্না করা তরকারি, শাক, মাংস বা অন্যান্য কারি। সব খাবারেই নারকেলের আধিক্য। আমার হোস্টেলে সেদিন সকালে ভাত মাছ আর একটা শাক ভাজি দিয়েছিল। তবে খাবার যাই হোক না কেন আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাদের এই ভাত মাছের র্যাপিং করে পরিবেশনা। প্রথমে পাতলা কাগজে খাবার রেখে এক পরত র্যাপিং করে তারপর আবার একটু মোটা কাগজ দিয়ে র্যাপিং করে রাখা হয়। এতে খাবার নষ্ট হবার আশঙ্কা কম থাকে এবং বড় জায়গা নিয়ে টেবিলে রেখে খাওয়া যায় এবং প্লেট ধোয়ারও ঝামেলা হয় না। আমার কাছে এই র্যাপিং বা মোড়কের ধরনটি বেশ শৈল্পিক মনে হয়েছে।
কাগজ ব্যবহার করে শ্রীলঙ্কানরা খুব সুন্দর করে খাবার র্যাপিং করতে জানে। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং শিক্ষনীয় ব্যাপারটি হলো এতে পরিবেশের ক্ষতি হয় না, পলিথিন জাতীয় মোড়ক থেকে দেখতেও অনেক সুন্দর লাগে। যে কোনো পানীয় খেতে তারা কাগজের স্ট্র ব্যবহার করে, এমনকি টয়লেটে টিসু পেপার ব্যবহারেও তারা নিরুৎসাহিত করে পরিবেশ রক্ষার্থে। প্রতিদিন আমরা যে পরিমাণ পলিথিন ব্যবহার করি, একবারও কি ভেবে দেখি পরিবেশের কত ক্ষতি করে ফেলছি আমরা?
কলম্বো শহরে অনেক বড় বড় পুরাতন বৃক্ষ রয়েছে, তাতে অনেক জাতের পাখি। ভালো লাগার ব্যাপার হচ্ছে, তারা সচেতনভাবেই গাছগুলো নিধন করেনি। শহরের প্যাটার্ন দেখলেই ঠিক অমুমান করা যায়। আমাদের দেশ আর শ্রীলঙ্কার পার্থক্য হলো, আমরা গাছ কেটে রাস্তা বানাই আর শ্রীলঙ্কাতে গাছ বাঁচাতে রাস্তার রুট পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। হিরিকিটিয়ার এক হোস্টেলের বাথরুমে খুব সুন্দর করে ইংরেজিতে লিখা ছিল- টয়লেট পেপার ব্যবহার করার কারণে কীভাবে গাছ কাটা পড়েছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। একটা লিঙ্কও দেওয়া ছিল যেখানে জানা যাবে কত পরিমান গাছ কাটা হয় এই টয়লেট পেপার ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য। তাই শ্রীলঙ্কার অধিবাসীরা টয়লেট পেপার ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে।
শহর গ্রাম যা ঘুরে দেখলাম বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অর্থনৈতিকভাবে তারা একটু দুর্বল হতে পারে কিন্তু মানবীয় গুণাবলী আর শিক্ষায় তারা আমাদের থেকে অনেকখানি এগিয়ে আছে। শ্রীলঙ্কায় শিক্ষার হার শতকরা ৯২ শতাংশ। বাসের কন্ডাক্টর, টুকটুকের ড্রাইভার বেশিরভাগই ইংরেজিতে প্রয়োজনীয় কথা বলতে পারে। এ দেশে অটোরিকশাকে ‘টুকটুক’ বলে। এ দেশে নামার পরে প্রথমবার মনে হলো বাংলাদেশী হিসেবে একটু উপরের সারিতে আছি। কারণ আমাদের টাকার মান শ্রীলঙ্কা থেকে বেশি। বাংলাদেশী ১ টাকা সমান শ্রীলঙ্কান ৩ রুপী পাওয়া যায়।
কলম্বোতে এক দিন বিশ্রাম নিলাম। এখানে আসার পেছনে অনেকদিন থেকে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। বলা যায় বছরখানেক ধরে এই পরিকল্পনা চলেছে। এবং এখানে আসার তারিখ আরো অনেক আগেই ঠিক হয়ে যেতে পারতো কিন্তু এবারের সফরে লেজ লাগালাম আমার বন্ধুর সঙ্গে। ম্যাথিউ থাকে চেন্নাইতে। গত বছর পন্ডিচেরি যাওয়ার সময় তার সঙ্গে পরিচয়। আমাদের দুজনেরই বাকেট লিস্টে রয়েছে জলের তলে বিচরণ করবো, যাকে বলে স্কুবা ডাইভিং। আমরা ওপেন ওয়াটার ডাইভিং এর বেসিক কোর্সটা করবো দুজনে। স্কুবা ডাইভিং এর দুনিয়াব্যাপী যারা কোর্স করায় তাদের মধ্যে PADI (Professional Association of Diving Instructors) অন্যতম। ম্যাথিউ আমাকে প্রথম থেকে কেরালার লাক্ষাদ্বীপের কথা বলে আসছিল, এবং অনেক চেষ্টা করেও বাংলাদেশী হিসেবে সেখানে যাওয়ার অনুমতি নিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাতে ভারত মহাসগরের তলদেশে এই কোর্স করার মনস্থির করলাম। এদিকে ম্যাথিউয়ের পাসপোর্ট নেই, শ্রীলঙ্কার প্ল্যান করে বসে আছে। পাসপোর্ট করার কথা বলেও ২ মাস চলে গেছে। ইতোমধ্যে আমি ইন্ডিয়াতে প্রবেশ করেছি ২২শে ফেব্রুয়ারি। তার অপেক্ষাতে থেকে আমরা এখনো শ্রীলঙ্কার ফ্লাইটের টিকিটও কাটতে পারিনি। রাতে ম্যাথিউয়ের বন্ধু শিফাজের সঙ্গে আমি আর সায়েম দেখা করলাম। সে আমাদের নিয়ে গেলো মুসলিম পাড়ায় কাবাব খাওয়াতে। ‘আলুতকাডে’ বেশ জমজমাট জায়গা, আমাদের পুরান ঢাকার কাবাব এরিয়ার মতো। তবে রাস্তা বেশ প্রশস্থ। বিশাল বড় একটা জামে মসজিদও আছে। এর সামনে সারি সারি কাবাবসহ নানা বাহারি খাবার দাবার ও জুসের দোকান।
কলম্বোর মালাবে থেকে গল হয়ে হিক্কাদুয়ার পথ ধরলাম। দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। এখানের বাস যাত্রা বেশ নিরাপদ আর সাশ্রয়ী। অনেক জোরে চালায় ঠিকই তবে দুর্ঘটনার রেকর্ড অনেক কম। প্রতিটা বাসেই তারা সিংহলি গান চালায়। বিকালের মধেই জায়গামত পৌঁছে গেলাম। বাস থেকে সমুদ্র সৈকত দেখতে দেখতে মনটা জুড়িয়ে গেল। শ্রীলঙ্কাজুড়েই এমন দৃশ্য দেখা যাবে। এক সৈকত থেকে আরেক সৈকতের সৌন্দর্য অনন্য। হিক্কাদুয়াতেই আমাকে থাকতে হবে মোটামুটি সাতদিন। স্কুবা ডাইভিংয়ের এই কোর্স মূলত তিন থেকে চার দিনের হয়। বুকিং ডট কম থেকে ট্র্যাভেলার্স হোস্টেলে বুকিং দিয়ে উঠে গেলাম; বিচের খুব কাছেই। ৫ তলা ডাইনিং এরিয়া থেকে সমুদ্র দেখা যায়। একটা ছোট্ট সুইমিং পুল আছে। আর ৫ তলার উপরে চিলেকোঠায় একটা রান্নাঘর আছে, যেখানে আমি রান্না করে খেতে পারবো, আর কি লাগে! ব্যাগ প্যাকিং স্টাইলে ঘুরলে কয়েক বেলা যদি নিজের খাবারটা নিজে তৈরি করার সুযোগ থাকে তাহলে যেমন সাশ্রয়ী হয় আবার স্বাস্থ্যটাও ঠিকঠাক থাকে। সব দেখেশুনে ব্যাগপত্তর রেখে ডাইভিং স্কুলের দিকে রওনা হলাম। (চলবে)
তারা//