ঢাকা     বুধবার   ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ||  মাঘ ১ ১৪৩১

দ্যা বাকেট লিস্ট: ২য় পর্ব

জলের নিচে অবিশ্বাস্য দুনিয়া!

হোমায়েদ ইসহাক মুন  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৩:২৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫
জলের নিচে অবিশ্বাস্য দুনিয়া!

ম্যাপে একটা পথ দেখালো, সেখান দিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। সরু খালের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে, সেই খালে বিশাল সাইজের গুঁইসাপ। সঙ্গে লাগোয়া বসতবাড়িও আছে কিন্তু কেউ ভ্রুক্ষেপ করে না। ওদের কেউ না ঘাটালে ওরাও মানুষকে কিছু করে না। মানুষ আর প্রাণীকুলের সাথে শ্রীলঙ্কাবাসীর সহাবস্থান। হাতিকে তারা বেশ সম্মান করে ও ভালোবাসে। 

কালো পানির সেই খাল পার করে পুরনো এক বাড়ির ভেতর দিয়ে আরেকটা রাস্তা পেলাম। কি সুন্দর ছোট ছোট মাটির টালি দেওয়া ঘর, সামনে ফুলের বাগান, নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। শ্রীলঙ্কার বাড়িঘরগুলো খুব নজরকাড়া। বিখ্যাত স্থপতি জেফ্রি বাওয়া শ্রীলঙ্কার নান্দনিক সুন্দর স্থাপনাগুলোর নকশা করেছিলেন। তার কাজের প্রশংসা স্থপতি মহলে দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ে, দুনিয়াজুড়ে তার নাম হয়। ভালো কাজ আপন মনে করে যেতে হয়। কে বাহবা দিলো সেসবের আশায় না থেকে নিজেকে নিজের কাজের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হয়। 

ছায়াঘেরা সরু পথ দিয়ে ঘুরে ঘুরে পৌঁছে গেলাম ডিপ ব্লু ডাইভিং সেন্টারে। সেখানে পিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। বাংলাদেশ থেকেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। জার্মান অধিবাসী ইয়ন আমাদের কোর্স নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো। এখন আমাদের কোর্স করাবে ভারতের ঋত্বিক জন। তার সঙ্গে পরিচিত হলাম এবং কোর্সের খুঁটিনাটি জেনে নিলাম। পরদিন বিকেল বেলা আমাদের গভীর জলে নামার প্রস্তুতির জন্য সি বিচের অগভীর জলে ক্লাস শুরু হবে। এর মধ্যে ম্যাথিউর সব রেডি হয়ে  গেছে।

আগামীকাল ভোরবেলা সে কলম্বো নামবে, এরপর আমার সঙ্গে যোগ দেবে। আমি হেঁটে হেঁটে গোধূলির শেষ বিন্দু দেখা পর্যন্ত বিচে বসে রইলাম। স্বচ্ছ আর টলটলে পানি, অনেকদূর পর্যন্ত তলদেশ দেখা যাচ্ছে। ইয়োরোপীয়ানদের বিচরণ সর্বত্র। স্বল্প বসনে সবাই জলকেলি করছে। কতক কাপলকে দেখলাম রোমান্টিক ভাবে আধোজল আর আধো বালিয়ারিতে বসে আছে। সুন্দর একটা বিকেল কাটিয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম। সুইমিং পুলে নেমে একটু আরাম দিলাম শরীরকে, এ কয়দিন ছুটে ছুটে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। 

পরদিন স্কুবা ডাইভিংয়ের নানা কৌশল শিখলাম। কীভাবে ডাইভিং স্যুট পরতে হবে, সিলিন্ডার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, পানিতে কীভাবে দম নিতে হবে এবং ছাড়তে হবে, ফিরে এসে কীভাবে ওয়াশ করতে হবে। অনেক কিছু জীবনে শেখার বাকি আছে বুঝলাম। একটা ই-লার্নিং লিঙ্ক দিয়ে দিল যার দাম ১৫০ ডলার। এখানে বিস্তারিত সব কিছু আছে স্কুবা ডাইভিং সম্পর্কে। ভালো মত পড়ে বুঝে এরপর পরীক্ষা দিতে হবে। এই পরীক্ষা এবং ইন্সট্রাক্টরের কাছে প্র্যাক্টিকাল করার পরে সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। স্কুবা নিয়ে আরো বিস্তারিত লিখবো আশা করি। আগামী কয়েকটা দিন আমার আর ম্যাথিউর বেশ ব্যস্ত সময় গেলো। 

প্রথম যেদিন ডিপ ডাইভ দেব সেদিন ছিল আমার জন্মদিন; ১১ মার্চ। এ জন্য এই দিনটিও আমার জন্য বেশ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফর্ম ফিল-আপ করার সময় আজকের তারিখ আর আমার জন্মদিনের তারিখ মিলে গেল। ইন্সট্রাক্ট্রর ব্যপারটা লক্ষ্য করল। সেদিন ডাইভিং সেন্টারের সবাই আমার জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি দিলো। এমনটা নাকি সাধারণত হয় না যে কোর্সের শুরুতেই পার্টি দিয়েছে, আমার জন্মদিন উদযাপনে তারা এমনটা করলো। 

রাতে সবাই মিলে খুব আড্ডাবাজি আর খাইদাই করলাম। বিদেশমুলুক এসে এমন অচেনা অজানা মানুষজনের সাথে যে আত্মীক বন্ধন হয়ে যায় এটা আমার সৌভাগ্য। বিধাতার কাছে বড় কৃতজ্ঞতা জানালাম। কত কি না তুমি দিলে! এই প্রবাসে দুদিনে পরিচয় হওয়া মানুষগুলোর বুকে এত ভালোবাসা ও প্রীতি দিয়েছ তুমি! যা পয়সা দিয়ে পাওয়া যায় না, কাঙালপনা করে পাওয়া হয় না; সেই অমূল্য স্বার্থহীন অমলিন ভালোবাসা কত সহজে পেলাম। নিজের জন্যে, প্রত্যেক মানুষের জন্যে ভালোবাসায় ভাসমান আমার অন্তর এক কৃতজ্ঞ নম্রতায় ভরে উঠল। যেই এই আপাততুচ্ছ কিন্তু বড় দামি পাওয়া জীবনে পায়, কেবল সেই জানে তার দাম। 

জলের নিচে যে এক অবিশ্বাস্য দুনিয়া আছে তা নিচে যারা না গেছে তাদের বোঝানো যাবে না কখনোই। এ এক অনন্য অনুভূতি, আর জীবনের জন্য সেরা এক অভিজ্ঞতা। ৫টা দিন পর মনে হলো আমরা একটা ঘোরের মধ্যে আছি। জলের ৪০ ফুট নিচে এতো বৈচিত্র দেখে সত্যি মুগ্ধ! সব কিছু ভালোভাবে সম্পন্ন করে ডাইভিং স্কুলের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম ক্যান্ডির পথে। চারবার বাস পাল্টে ক্যান্ডি নামলাম। হিক্কাদুয়া থেকে গল, সেখান থেকে কাডুয়েলা তারপর ক্যান্ডি। হোস্টেল ছিল এক পাহাড়ের উপরে। 

এক রাত কাটালাম ক্যাণ্ডিতে। বিশাল বড় এক লেক আছে ক্যান্ডি শহরে, তার আশেপাশে হাঁটলাম। গৌতম বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষণ করা আছে এক মন্দিরে সেখানে গেলাম। পরদিন সকালে ক্যান্ডি থেকে এল্লা ১৪০কিলোমিটারের রেলপথ পাড়ি দিলাম প্রায় সাত ঘণ্টায়। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে সেই রেলযাত্রা হলো অভাবনীয়! শ্রীলঙ্কাতে বেড়াতে এলে প্রত্যেকের জন্য নির্দেশনা থাকে এই রেলযাত্রাটি উপভোগ করার জন্য। ট্রেন বেশ সময় নিয়ে চলে। 

রিসারভেশন টিকিট অনেক আগে কেটে রাখতে হয়। তবে ভারতের মত এখানের ট্রেনে খুব বেশি যে ভিড় বলা যাবে না। বেশিরভাগই ফিরিঙ্গি। ইউরোপ, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এসব দেশ থেকে বেশি পর্যটকদের দেখা পেলাম। আগের দিন রাতে ক্যান্ডি রেল স্টেশনে খবর নিতে গিয়েছিলাম। স্টেশন ছিল জনশূন্য। কাউন্টার থেকে জানলাম সকালে ৮টার পরে আসলেও টিকিট কিনতে পারবো সেকেন্ড ক্লাস, শ্রীলঙ্কান ৬০০ রুপি। তবে বসে যাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভাগ্য ভালো থাকলে সিট পেয়েও যেতে পারি। 

স্থানীয়দের মধ্যে খুব কম লোকজনই টেন ভ্রমণ করে মনে হলো। সকালে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পরিচয় হলো স্থানীয় শ্রীলঙ্কার রাগবি কোচ এসি তেন্নাকুনের সঙ্গে। তিনি হাটর্ন পর্যন্ত যাবেন। সেখানে একটা ক্রিকেট ম্যাচ আছে প্লান্টেশন এবং ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের কলিগদের টিমের সাথে। বর্তমানে তিনি কোচের কাজ থেকে একটু দূরে আছেন ব্যবসার কাজ এবং ফিটনেসের জন্য। ভলিবল শ্রীলঙ্কার জাতীয় খেলা। তবে রাগবি খেলাও এখানে বেশ জনপ্রিয়। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় অবশ্য ক্রিকেট। তেন্নাকুনের সাথে যখন কথা বলছি তখন বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কার টি টোয়েন্টি সিরিজের ফাইনাল খেলা হচ্ছে সিলেটে। অবশেষে সেই খেলায় বাংলাদেশ জিতেও গিয়েছিল। রাগবির বিশেষ খেলাগুলোতে তেন্নাকুনের ডাক পড়ে। প্রায় ১৬টা দেশে তিনি গিয়েছেন শ্রীলঙ্কার রাগবি খেলোয়াড়দের নিয়ে। কয়েকটি হোম স্টে আছে তার নিজের। হাতে অনেকটা সময় ছিল, শ্রীলঙ্কার অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ হলো। কারণ ট্রেন ২০মিনিট লেট আছে। এক সপ্তাহ পর সায়েমের সাথে দেখা হবে এল্লাতে। এরপর আমরা এক সপ্তাহের জন্য বের হয়ে যাব বাকি জায়গাগুলো দেখতে।

ক্যান্ডি থেকে এল্লা ট্রেনে এক ঘণ্টা পরেই জানালার ধারে সিট পেয়ে গেলাম। বাইরের দৃশ্য বেশ মনোমুগ্ধকর! চোখ জুড়িয়ে যাবে আর মন ভরে যাবে। সাদা চামড়ার পর্যটকরা বেশ আনন্দ নিয়েই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ রেলের দরজায় বসে পড়েছে ছবি তোলার জন্য। চলন্ত ট্রেনে স্বল্প বসনে সাদা কেশ এলিয়ে দিয়ে তারা ছবি তুলছে। কখনো জানালার বাইরে মাথা বের করে, কখনো দরজার হাতল ধরে শরীরের অর্ধেক হেলে দিয়ে। আসার পথে একা ছিলাম বলে নিজের ছবি আর তোলা হলো না। 

পরদিন এল্লা থেকে ট্রেনে নুয়ারাএলিয়া যাওয়ার পথে সায়েম থাকাতে আমরা একে অন্যের ছবি তুলতে পারলাম। এই ট্রেন মূলত শিমলার টয় ট্রেনের মতো। তবে ভেতরে জায়গা আছে পর্যাপ্ত। দুটো করে চারটা সিট দুপাশে। মাঝখানে দাঁড়াবার জায়গা আছে। আমার পাশে নেদারল্যান্ডসের জোস্ফি বসেছে। বয়স ২৩ বা ২৪ হবে। থাইল্যান্ড ঘুরে শ্রীলঙ্কা এসেছে। এখানে তিন সপ্তাহ একটা হোস্ট ফ্যামিলির সঙ্গে ভলানটারি করবে তারপর ফিরে যাবে। ইউরোপীয়ানদের মধ্যে এমন লম্বা ভ্রমণের একটা চল আছে। ১৮ বা ২০ বছর বয়সের পরে তারা একটা লম্বা সফরে বের হয়। কেউ কেউ কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘুরতে বের হয়, আবার নতুন কাজ খুঁজে নেয়। কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। আমাদের দেশের মতো পারিবারিক বাধাবিপত্তি নেই। বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে এখান থেকে ওখানে। 

এল্লাতে পরিচয় হলো মারভিসের সঙ্গে। সে ফ্রান্সের অধিবাসী,  তার ভ্রমণ শুরু হয়েছে ওমান থেকে। সেখান থেকে মাত্র ১০০ ডলারে শ্রীলঙ্কা চলে এসেছে। এরপর যাবে কম্বোডিয়া।  আমিও যেহেতু ওমানে ছিলাম কোন কোন জায়াগায় সে ঘুরেছে সেই জায়গাগুলো স্মৃতি হাতরে মিলিয়ে নিলাম। মারভিন মিডিয়া জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করেছে প্যারিসে। আমরাও যে মিডিয়া জার্নালিজমের স্টুডেন্ট ছিলাম তাকে জানালাম। জমে গেলো আড্ডা।

‘নুয়ারা এলিয়া’ পাহাড়ি এলাকা, ছিমছাম আর ঠান্ডা হিম শীতল আবহাওয়া। এখানে এসে জ্যাকেট চাপাতে হলো গায়ে। সন্ধ্যা হতেই বেশ ঠান্ডা অনুভব হচ্ছিল। আমাদের হোস্টেলের  অবস্থান রেল স্টেশন থেকে বেশ দূরে। প্রায় ৮ কি.মি. হবে। হোস্টেলের নামটাও বেশ, হাকুনা মাটাটা। আফ্রিকান এই শব্দের মানে হলো ‘নো অরি, জাস্ট চিল’। হোস্টেলের মালিকও সেই ধাঁচের। জটা চুলধারি, সে এবং তার স্ত্রী। পাহাড়ের উপর এক চিলতে বাড়ি। সামনে একটা গ্রাউন্ড আছে, সেখানে তাবু আর হেমক ঝুলানো আছে। দোতলা বাড়ির এক চিলতে বারান্দা থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ড্রোন আছে মারভিনের সঙ্গে। আমাদের হোস্টেলের টেরেস থেকে ড্রোন উড়িয়ে দিলো। পাখির চোখে কি দারুণ দেখালো নুয়েরা এলিয়ার সবুজ পাহাড়ি গ্রাম। ঘরের কর্তা আমাদের চা আর বিস্কুট পরিবেশন করলেন সঙ্গে ওয়াইফাইও। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পাহাড় দেখার আনন্দটাই একদম আলাদা। (চলবে) 

পড়ুন সূচনা পর্ব: শ্রীলঙ্কায় স্কুবা ডাইভিংয়ের পরিকল্পনা

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়