ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যাচ্ছিলাম অ্যাডামস পিক- আদম পাহাড়ে

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যাচ্ছিলাম অ্যাডামস পিক- আদম পাহাড়ে

ইংরেজিতে বলা হয় অ্যাডামস পিক। আদম চূড়া। এই পাহাড়টি বিখ্যাত এ কারণেই- পৃথিবীর প্রথম মানব আদমের পায়ের ছাপ রয়েছে এখানে।

কার পায়ের ছাপ?

মুসলমানদের কাছে আদমের পায়ের ছাপ।

হিন্দুরা বলেন শ্রী পদ। হনুমান বা শিবের পায়ের ছাপ!

বৌদ্ধদের কাছে গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ন।

খ্রিস্টানদের কাছে অ্যাডামস অথবা সেন্ট থমাসের ফুট প্রিন্ট।

এমনকি একে সেক্রেট ফুট প্রিন্ট বা গোপন পদচিহ্নও বলা হয়। শক্ত পাথরের ওপর ওই পায়ের চিহ্নটি ১.৮ মিটার বা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা!

ওই অ্যাডামস এর নামানুসারে পাহাড় চূড়ার নাম হয়েছে অ্যাডামস পিক, আদম চূড়া।

পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষের কাছে এটি পবিত্রতম স্থান। এমনকি যারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না-তাদের কাছেও জায়গাটি আকর্ষণীয়। তাদের সংখ্যাও কিন্তু কম না, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না; পরিসংখ্যান বলছে তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে! ধর্ম সৃষ্টির আগে প্রথম মানব পৃথিবীতে এসেছিলেন অ্যাডামস পিক-এ; এমন মিথ ধার্মিক অধার্মিক সবাইকে আকর্ষণ করে।

কথিত আছে, স্বর্গের বাগান বা ইডেন গার্ডেন থেকে আদম এবং হাওয়া বিতাড়িত হন। সেখান থেকে আদমকে এই পাহাড়ের চূড়ায় নিক্ষেপ করা হয়। পৃথিবীতে তিনি প্রথম পা ফেলেন এই পাহাড়ের মাথায়। এ জন্য জায়গাটির এরকম নামকরণ।

অনেকে মনে করেন এটি আসলে ধর্মীয় মিথ। ইডেন গার্ডেন আবার পৃথিবীর মাটিতে একটি স্থানকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। যাতে এর অবস্থান দেখানো হয়েছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (ইরাক বা সংলগ্ন এলাকা) কোনো স্থানকে। বাইবেলে এর উল্লেখ আছে। ইডেন গার্ডেনকে একেক সময় একেকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোথাও উদ্যান, কোথাও উদ্যানের গাছ, কোথাও বৃক্ষ শাখা, আবার কোথাও এর ফুল বা ফল, আবার কোথাও উদ্যানের জলকে বোঝানো হয়েছে। কোথাও আবার ইডেন বলতে ঈশ্বরের রোপন করা গাছকেও মনে করা হয়। হিন্দু পূরাণে একটি শব্দ আছে পারিজাত। এর অর্থ স্বর্গের সমুদ্র মন্থনের ফলে উদ্ভূত উদ্ভিদ, বৃক্ষ, ফল বা ফুল বিশেষ। তবে ইডেন নামটি উচ্চারণ করলে ভারতের ইডেন গার্ডেন ক্রিকেট স্টেডিয়াম এবং ঢাকার ইডেন কলেজ নাম দুটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে।

প্রথমবার শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। আকাশ পথে কলম্বো যেতে ঢাকা থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগে সুন্দরবনের শেষ মাথায় পৌঁছতে। সেখান থেকে আরো ঘণ্টাখানেক লাগে বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিতে। শ্রীলঙ্কার ভূভাগে প্রবেশের পর তখন পাইলট কথা বলছিলেন ককপিটে বসে। তিনি তখন যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ‘আমাদের বা পাশে অ্যাডামস পিক, ডান পাশে সাফারি পার্ক, ন্যাশনাল ফরেস্ট’ ইত্যাদি। অ্যাডামস পিক শব্দটা তখনই প্রথম শুনেছিলাম। কিন্তু মনের ভেতরে গেঁথে গিয়েছিলো শব্দটি। ইচ্ছে ছিল একদিন ওখানে যেতেই হবে।

সে বছর অ্যাডামস পিক এর কাছ দিয়ে ঘুরেছি। বার দুয়েক ওই রাস্তা দিয়ে ক্যান্ডি গিয়েছি। কিন্তু সেখানে যাওয়া হয়নি। এমনকি কলম্বো থেকে মালদ্বীপও গিয়েছি।

২০১৭ সালেও শ্রীলঙ্কা গিয়েছি। কলম্বো ঘুরেই চলে এসেছিলাম। আর তাই ২০১৯ সালের সুযোগ আর হাতছাড়া করতে চাইনি। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট সিরিজে স্পন্সর ছিল ওয়ালটন। দুই সহকর্মী ফিরোজ আলম এবং মিলটন আহমেদ আমার সঙ্গী। ঢাকা থেকেই বলে রেখেছিলাম- এবার আমি অ্যাডামস পিকে যাব। মিলটন সঙ্গে যেতে রাজি হচ্ছিল। কিন্তু ফিরোজ আলমের কথা হলো, ওটা ভীষণ কষ্টসাধ্য। সম্ভব না। আমি বলেছি, এখন যদি না পারি তাহলে আর কবে পারব।

ভিয়েতনামে হা লং বে’তে অনেক উঁচু পাহাড়ে উঠেছি। ভুটানে টাইগার নেস্ট ছাড়াও আরেকটা উঁচু পাহাড়ে উঠেছি। তাহলে পারব না কেন? ফিরোজ আলম বিভিন্ন ভিডিও, তথ্য, রিভিউ ইত্যাদি পর্যালোচনা করে বললেন, ‘সম্ভব না। আপনারা যান, আমি যাব না’।

আমি তখন বলেছিলাম, নো প্রবলেম, আমি একা যাব। আমাকে একটা বাসের টিকিট করে দিয়েন। না হলে একটা কার ভাড়া করে দিয়েন।

মিলটন অবশ্য আমার সঙ্গেই যেতে চাইছিলেন। মনে মনে হয়তো সে-ও ভাবছিলেন, এত কষ্টের চেয়ে কলম্বোতে বিশ্রাম নেয়াই ভালো। আমি অবশ্য স্থির ছিলাম-জীবনের শেষ চিকিৎসা, আমাকে যেতে হবেই।

কলম্বোতে আমরা এয়ারবিএনবি থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। যে কারণে মাঝখানে এক রাত না থাকলেও সমস্যা নেই, ফ্ল্যাট ছাড়তে হচ্ছিল না। ফ্ল্যাটের মালিককে শুধু জানিয়ে রেখেছিলাম। এক রাত থাকব না কলম্বোতে।

এর আগে ক্রিকেট খেলার গ্যাপ ছিল একদিন। সেদিন গিয়েছিলাম গল। পরের ম্যাচের আগে দুদিন গ্যাপ পেয়ে প্ল্যান করেছিলাম অ্যাডামস পিক যাওয়ার। একটা প্রাইভেটকার ভাড়া নিয়েছিলাম। কলম্বো থেকে সরাসরি অ্যাডামস পিক। আগের রাতেই ফিরোজ আলম জানালেন, তিনিও যাবেন আমাদের সঙ্গে। তবে পাহাড়ে উঠবেন না। হোটেলে বিশ্রাম নেবেন। আমরা তাতে খুশি হয়েছিলাম। কারণ বহু জায়গাতে আমরা একসঙ্গে গিয়েছি। আমাদের ক্যামিস্ট্রি বা পারস্পরিক বোঝাপড়া দারুণ। আমরা কেউই স্মোকার নই। পান-বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস নেই। এমনকি আমি চা-কফিও পান করি না। আমার দেখাদেখি এরা দুজনেও তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর কোনো বাজে নেশা নেই আমাদের। নেশা একটাই- নতুন জায়গা আর প্রকৃতি উপভোগ। আর কোনো টিমে ফিরোজ থাকা মানেই ভরপুর এন্টারটেইনমেন্ট। গল্প-কৌতুক উপস্থিত বুদ্ধি- অসাধারণ এক প্যাকেজ- ‘ফিরোজ প্যাকেজ’।

অ্যাডামস পিক দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার মাঝখানে অবস্থিত। নির্দিষ্ট করে বললে, দেশটির মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণাংশে। এটি রত্নপুরা জেলায় পড়েছে। তবে কিছু অংশ পড়েছে সাবারাগামুয়া প্রদেশের নুয়ারা এলিয়া জেলায়। নুয়ারা এলিয়া জায়গাটি বিখ্যাত অন্য কারণে। এর আবহাওয়া ঠিক লন্ডনের মতো। যে কারণে পর্যটকরা সেখানে যান লন্ডনের আমেজ পেতে। যাহোক রত্নপুরা জেলা থেকে জায়গাটি ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে। পাশের জেলার নাম হাটন। হাটন থেকে এটি ৩২ কিমি দূরে। তবে, রেলে চড়ে গেলে ওই হাটন শহরে নামতে হয়। এরপর বাস বা অন্য কোনো যানবাহনে করে পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত যাওয়া যায়।

ফিরোজ যাবে শুনে খুবই খুশি হলাম। সকাল ৮টায় গাড়ি চলে এলো ফ্ল্যাটের নিচে। উঠে বসলাম। কোথায় যাচ্ছিলাম? যে জায়গা থেকে পাহাড়ে উঠতে হয় তার নাম নালাঠালিয়া। সেখানেই আমাদের হোটেল বুকিং ছিল। অতি ছোট্ট একটি অসমতল পাহাড়ি শহর, কিন্তু ভারী সুন্দর!

গাড়ি চলতে শুরু করল।

চলবে... 


শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়