ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অ‌্যাডামস পিক : সামিট করার মুহূর্তে ব্যাড লাক!

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৭ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অ‌্যাডামস পিক : সামিট করার মুহূর্তে ব্যাড লাক!

আহা, আদম পাহাড়। অ‌্যাডামস পিক। এতো কাছে তুমি। তারপরও সংশয়-আদৌ কি উঠতে পারব চূড়ায়!

মধ্য রাতে রওনা হয়েছিলাম। রাত ফুরিয়ে সকাল। মেঘে ঢাকা আকাশ। পথঘাট ভেজা। বৃষ্টি হয়নি। তবে মেঘেরা এই পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে দিগ্‌বিদিক ছুটে যায়। এই পাহাড়ের গায়ে এসে আছড়ে পড়ে প্রমত্ত মেঘ। কোনো মেঘেরা হয়তো এখানে এসেই ক্ষান্ত দেয় যাত্রা। মেঘদূত এখানে নীরব! বেশি চঞ্চল যারা তারাই হয়তো গোল্লা ছুট খেলে বেড়ায়। আর তাই এখানে পথ থাকে ভেজা।

দূর থেকে অ‌্যাডামস পিক এর ছবিতে দেখা যায়- একটা পর্যায়ে পাহাড়টা একেবারে খাঁড়া। আরো দূর থেকে পর্বতের মুকুটের মতো দেখায় মাথাটাকে। সব পথ পেরিয়ে ওই মুকুট অংশে ছিলাম আমরা। সবচেয়ে কঠিন ওই অংশটুকই। আমি খুবই ক্লান্ত। বসে পড়ব বিশ্রাম নিতে। এমন সময় শ্রীলঙ্কান এক যুবককে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম- আর কতক্ষণ লাগবে? বললো, বেশি দূরে নেই। চেষ্টা করুন। সফল হবেন। গতানুগতিক কথা।

বললাম, এখান থেকে ফিরে যাওয়া কি ঠিক হবে? না কি ওঠার চেষ্টা করব? এবার যুবকের কালো মুখে কিঞ্চিৎ হাসি। সত্যি বলতে কী- এখান থেকেও অনেকে ফিরে চলে যায়। তবে ফিরে যাওয়াটা বোকামি। কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। যত কষ্টই হোক, এখান থেকে ফিরে যাবেন না। চেষ্টা করুন, নিশ্চয় পারবেন।

ওম, বেচারা ঠিকই বলেছে। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে ওই অংশে রাস্তাটা শক্ত সিমেন্টে বাঁধানো। সরু পথ হলেও মাঝখানে রেলিং দেয়া। একজন করে মানুষ উঠতে পারবে, একজন নামতে পারবে। যাতে ওঠা নামার সময় কারো গায়ে কারো ধাক্কা না লাগে। দুর্বল ক্লান্ত শরীরে ধাক্কা খেলে নিশ্চিত নিচে পড়ে যাবে। তাতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।

কখনো লতা-পাতা এসে পথ ঢেকে ফেলেছিলো। কোথাও পানি জমে পথ পিচ্ছিল। কোথাও শ্যাওলা। আবার সিঁড়ির পাশেই কোথাও অতি পুরনো ছাউনিও দেখছিলাম। শীতকালে, মানে ওখানে ওঠার মৌসুমে ওসব জায়গায় হয়তো চা-পানির ব্যাবস্থা থাকে। থাকে শৌচ কর্মের জায়গা। কোথাও পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিলো। ওরকমই একটা নলে হাত পেতে কিছুটা পানি নিয়ে গলা ভিজিয়েছিলাম।

পাহাড়ের নিচে তাকিয়ে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। মেঘে ঢাকা। তবে সিঁড়ি দিয়ে নিচে তাকিয়ে ভয় হচ্ছিলো। এমনকি মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিলো। শ্রী পদ’র এই অংশটুকু ওঠাই সবচেয়ে কঠিন। ইউটিউবে অনেকবার এর ছবি দেখেছিলাম। এমনকি হেলিকপ্টার দিয়ে ওখানে যাওয়ার ভিডিও দেখেছিলাম। বিশেষ করে ড্রোন শটের ছবিগুলো দুর্দান্ত। চূড়ায় ওঠার ওই শেষ অংশটুকু বলা চলে রিয়েল অ‌্যাডভেঞ্চার! পাথুরে সুঁচালো মাথা। তার উপরে সামান্য একটু স্থাপনা। মন্দির। ওখানে ওঠা এতোটা কঠিন বলেই হয়তো আদম, বুদ্ধ, শিব- উনাদের ওখানে নামানো হয়েছিলো!

বাবা আদমের পাহাড়ে উঠতে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটা বাবা হয়ে গিয়েছিলাম। ততক্ষণে বেশ দুর্বলও হয়ে পড়েছিলাম। পা কাঁপছিলো। ঠিক মতো স্টেপ নিতে পারছিলাম না। পানির বোতল ছিলো মিলটনের কাছে। পানি ছিলো না তাতে, সব শেষ। ছোট এক প্যাকেট কেক ছিলো, সেটাও শেষ। পা যখন অনেকটা অসংলগ্ন ঠিক ওই সময়ে মিলটন আর ফিরোজ আমাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলো। পথের একটা বাঁক থেকে আরেকটা বাঁক দেখা যাচ্ছিলো না। ওরা আমার থেকে কতটা এগিয়ে সেটাও বোঝা যাচ্ছিলো না। আমি মাঝে মাঝে মিল্টন বলে হাঁক দিচ্ছিলাম। মিলটন উত্তরও দিচ্ছিলো।

খেয়াল করলাম, খুব ফরসা দুই তরুণ নিচে নামছিলো। তাদের হাতে লাঠি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো ইউরোপিয়ান হবে। তারা আমাকে ক্রস করার হাত তিনেক আগে তখন। হঠাৎ সামনের তরুণটি আমাকে বলে উঠলো, এই আমার ক্যাপ দাও। হকচকিয়ে গেলাম। ক্যাপ? ও হ্যাঁ, আমার হাতে তো একটা ক্যাপ। এটি আমার না। পথে কুঁড়িয়ে পেয়েছিলাম। তাহলে কি..। মুহূর্তের মধ্যে এসব ভাবলাম। চটপট উত্তর দিলাম- এটা কি তোমার? তরুণটি বললো, হ্যাঁ। ওকে, খুব ভালো। নাও, নিয়ে নাও।

তরুণটি ক্যাপটা নিয়ে নিলো। ধন্যবাদ জানালো। জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছো? জবাব, অস্ট্রিয়া। তার মানে ইউরোপের দেশ। আমার অনুমান সঠিক ছিলো। জানতে চাইলাম তোমারা কি বন্ধু? - হ্যাঁ। নাম কী তোমাদের? সামনের ছেলেটি, যে ক্যাপটি নিলো তার নাম মাভিয়া। তার বন্ধুর নাম থাম্বিয়া। ওরা অনেক আগে রওনা হয়েছিলো। উপরে গিয়ে নেমে আসছিলো। বললাম, আসো সেলফি নিই, তারা রাজি হয়ে পোঁজ দিলো।

এর আগেও মনে হচ্ছিলো বিরান জঙ্গল। কোনো জনমানুষের চিহ্নটি নেই। কিন্তু ভোর বেলায় দেখছিলাম দল বেঁধে অনেকেই নামছিলো। তার মানে আমরা দেরিতে রওনা হয়েছিলাম। ওরা আরো আগে শুরু করেছিলো। ১০/১২ বছরের এক কিশোরীকে দেখলাম। নামছিলো বাবার হাত ধরে। আগন্তুকদের প্রায় সবাই বিদেশি। স্থানীয় সেরকম আর কাউকে চোখে পড়ছিলো না। আরো এগিয়ে যেতেই দেখলাম বেশ কয়েকটা বিদেশি মেয়ে। গল গল করে কথা বলছিলো, মজা করছিলো আর নামছিলো। দুটো ফ্যামিলি দেখলাম। ছেলেমেয়েদের নিয়ে উঠেছিলো। এরা যখন উঠেছিলো তাহলে আমি কেন পারব না?

হাত ধরাধরি করে এক প্রেমিক যুগল নামছিলো। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, আর কত দূর? বললো বেশি দূর না। এইতো সামনেই। জানতে চাইলাম, উপরে উঠেছিলে? হ্যাঁ। নিশ্চয় খুব মজা পেয়েছো? বললো, না। কেন? আকাশ মেঘে ঢাকা। তাই সূর্য দেখতে পারি না। ও আচ্ছা!

ঝোঁপ জঙ্গলে ভরা উপরে ওঠার পথের বাঁকগুলো। রাস্তাটাও এতো খাঁড়া। পায়ে কুলোচ্ছিলো না। সিঁড়িগুলো কোনোটা অনেক উঁচুতে। একটা থেকে আরেকটায় উঠতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়তে হচ্ছিলো। সঙ্গে কেউ ছিলো না। একা ছিলাম। তাই আস্তে আস্তে একটা একটা করে সিঁড়ি পাড়ি দিচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো পুলসেরাত পার হচ্ছিলাম। বার দুয়েক ডাকলাম মিলটনকে। সাড়া নেই। মানে শব্দ শোনার বাইরে চলে গিয়েছিলো ওরা। কত পেছনে পড়েছিলাম?

আরেকটা সিঁড়ি পথের বাঁকে নিচের দিকে তাকালাম। মাই গড! আর তাকানো যাবে না। মাথা ঘুরে নির্ঘাৎ পড়ে যাব। আগেই বলেছি, পড়ার কী পরিণাম! কেউ লাশটাও খোঁজার চেষ্টা করবে না।

আরো বিপজ্জনক সিঁড়ি পার হচ্ছিলাম। সামনে গিয়ে মানুষের কথাবার্তা শুনতে পেলাম। যারা আদম পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছেছে আসলে কথা বলছিলেন তারাই। তার মানে বেশি দূরে নেই। শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চেষ্টা করলে নিশ্চয় পারব। তবে সাবধানে। তীরে গিয়ে তরী যেন না ডোবে। একটু বেখেয়ালে পড়ে গেলে ভবলীলা সাঙ্গ।

হাঁটুর উপরে হাত দিয়ে দিয়ে চেষ্টা করলাম উপরে ওঠার। আহা, কত মানুষের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম! খুব কাছেই। পথটা এমনভাবে বাঁকিয়ে তৈরি যে চূড়া দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওদিকে জংলা ঝোঁপ ঝাঁড়ে আটকে ছিলো দৃষ্টি। যত যাই হোক, শেষতো করতেই হবে।

শেষের দিকে জোরে একটা ডাক দিলাম মিলটনকে। শুনতে পেলো। বললো, বস এসে গেছেন। নো টেনশন। চলে আসেন। আমরা পৌঁছে গেছি। সাহস পেলাম। শেষ বাঁক পার হয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম পাহাড়ের মাথার স্থাপনা। অ‌্যাডামস পিকের মুকুট! বেশকিছু যুবক। কেউ ছবি তুলছিলো, কেউ বিশ্রাম নিচ্ছিলো। কেউ সামিট করার আনন্দে ভাসছিলো।

শেষ অংশে ছিলাম আমি। একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙছিলাম, একটু একটু করে স্বপ্নের কাছে যাচ্ছিলাম। দীর্ঘ দিন যার প্রতীক্ষায় ছিলাম, সেই অ‌্যাডামস পিক এতো কাছে!

কুঁড়ি পঁচিশটা সিঁড়ি পেরোলেই অ‌্যাডামস পিকে পৌঁছব। সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। মিলটন ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। কেউ কেউ গো প্রো ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করছিলো। সমবয়সী একটা তরুণের দল খুনসুঁটি করছিলো। ঠিক চূড়ায় উঠার আগ মুহূর্তে। তখন শরীরে আর শক্তি ছিলো না বলা চলে। মনের শক্তিতে যাচ্ছিলাম। আদমের পায়ের চিহ্ন দেখার চেয়ে নিজের পা কখন ওখানে ফেলব সেই চিন্তায় বিভোর। আর মাত্র ১০/১২ গজ পথ পেরোলেই আদম পাহাড়ের চূড়ায় উদয় হাকিম! শুভ আরোহন। হ্যাপি সামিট!

মনটা অগ্রিম খুশিতে ভরে উঠছিলো! ঠিক তখনই ফিরোজ আলম বললো, এতো কষ্ট করে উঠলেন; কিন্তু ব্যাড লাক!

**




শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়