ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ৩০ ১৪৩১

আসলেই কি এতো ভুল এই শহরের মধ্যবিত্তদের ছিলো

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২২ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
আসলেই কি এতো ভুল এই শহরের মধ্যবিত্তদের ছিলো

‘ভুল এই শহরের মধ্যবিত্তদেরও ছিলো!’ গতকাল একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে এই শিরোনাম দেখে অনেক আগ্রহ নিয়ে লেখাটি পড়লাম। কারণ আমি নিজে এই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করি। বিকেল না গড়াতেই পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই দেখলাম  লেখাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। বোঝা যাচ্ছে লেখকের কথাগুলো অনেকের ভাবনায় নাড়া দিয়েছে। অন্য একটি বহুল প্রচলিত জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত কিছু নিম্নবিত্ত মানুষ তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন এমন ছবি যুক্ত করায় ওই লেখাটি আরো হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। কেউ স্বপ্নের শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে দেখলে আমাদের মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে! লেখক এই ঢাকা ছাড়ার শ্রেণীটিকে মধ্যবিত্ত বলে চিহ্নিত করেছেন এবং এজন্য গোটা মধ্যবিত্ত সমাজকে দায়ী করেছেন। আমার আপত্তির শুরু এখান থেকেই।

লেখাটি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের আগে বুঝতে হবে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী আসলে কারা? সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী হলো উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মাঝামাঝি থাকা এক বিশাল শ্রেণীর মানুষ। এই শ্রেণীকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে বলতে হয়, এরা এমন এক গোষ্ঠী যারা শিক্ষা ও মননশীলতায় সমাজের বিশেষ স্থান দখল করেন। যেমন শিক্ষিত চাকরিজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী, মাঝারি ব্যবসায়ী ইত্যাদি।

কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে আর্থিক সমস্যায় যারা শহর ছাড়ছেন তারা কি আসলেই বর্তমান সময়ের মাথাপিছু আয় আর মূদ্রাস্ফীতির বিচারে মধ্যবিত্তের কাতারে পড়েন? দিনমজুর, অটোরিকশা কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি চালক, গৃহকর্মী শ্রেণীর মানুষদের মধ্যবিত্তের কাতারে ফেলা এক প্রকার প্রহসন। ইংরেজ শাসনের যাতাকলে পিষ্ট এদেশের গ্রামকেন্দ্রীক কৃষি অর্থনীতি ও শিল্পব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে তখন মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে বাস করতে শুরু করে। কিছু মানুষ এসেছে নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে। কিন্তু এরা কখনোই এই শহরকে আপন ভাবেনি, যেমন শহরের স্থায়ী মানুষেরা ভাবেনি তাদের। তাই তারা টাকা জমিয়ে আবার গ্রামে জায়গাজমি কিনেছে। সবসময় স্বপ্ন দেখেছে এই শহর ছেড়ে আবার গ্রামে ফেরার। তাই এই শহরে তাদের শেকড় এতো আলগা ছিলো যা তুলে নিয়ে গ্রামে ফিরতে তাদের কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। যেমন ফিরে যাচ্ছে তেমনি আবার অনুকূল সময়ে ফিরে আসতেও সমস্যা হবে না। এরা নাকি গ্রামের শেকড় ছিন্ন করেছেন- এমনই বলছেন লেখক। তাহলে এরা যাচ্ছে কোথায়? নিশ্চয়ই ঢাকা ছেড়ে তারা অন্য শহরে গিয়ে পুনরায় আবাস গড়ছে না। প্রতি ঈদে যে কোটিখানেক লোক এই শহর ছেড়ে গ্রামে যায় তারা কারা? লেখক যাদের ‘শেকড় ভোলা’ মানুষ বলছেন তারা কি আসলেই শেকড়হীন? আমার মনে হয় না।   

সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সমাজের বাঁকগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে শিখেছি। যদি লেখকের কথা মতো কিছু লেপ-তোষক, সস্তা ফার্নিচার আর ছোট একটা ফ্রিজ নিয়ে মিনি ট্রাকের উপরে বসে গ্রামে ফেরা লোকগুলোকে মধ্যবিত্ত বলে মেনেও নেই, এরপরও প্রশ্ন থেকেই যায়- আসলেই কি এই শহরের মধ্যবিত্তদের এতো ভুল ছিলো? আসলেই কি তারা শো-অফ করে টাকা নষ্ট করেছে? ফাস্টফুড আর সিনেপ্লেক্সে টাকা উড়িয়েছে? অনেকবার ভাবলাম, কিন্তু বাস্তবে এর মিল খুঁজে পেলাম না। এই শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আগে চিনতে হবে। ৩/৪ জন সন্তান নিয়ে বাবা-মা দুই কামরার ভাড়া বাসায় থাকলেও ছেলেমেয়েরা সবাই লেখাপড়া করে। কলেজেপড়ুয়া মধ্যবিত্ত সন্তানেরা টিউশনির টাকা এনে মায়ের হাতে তুলে দেয়। মাসান্তে দু’একবার যে ওরা ফাস্টফুডে যায় না, সিনেমা দেখে না তা বলবো না। তবে সেটা তারুণ্যের জয়গান। আর ঢাকা শহরের ফাস্টফুডগুলোর মধ্যে অল্প কিছু ব্র্যান্ড শপ বাদে বাকি প্রায় নব্বই শতাংশের মালিক-কর্মী ওই মধ্যবিত্তরাই। এরপর এই প্রশ্ন করাই যায়- মধ্যবিত্ত হলেই কি প্রেম করা যাবে না? বিশেষ দিনে ভালোবাসার মানুষের হাতে একটি গোলাপ তুলে দেওয়া কি এতোই অন্যায় হবে?

আবহমান কাল থেকে শিল্প-সাহিত্য আর সংস্কৃতির ধারক মধ্যবিত্ত শ্রেণী সবসময়ই মননশীলতায় সমাজের অন্য দুটো শ্রেণী থেকে এগিয়ে ছিলো। ক্রেডিট কার্ড, পাপাস প্রিন্স, চকলেট ডে, সোস্যাল মিডিয়ার পোস্ট, ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা- সব কিছু মিলিয়ে লেখক আমাকে আসলেই কনফিউজড করে ফেলেছেন!

মানছি যে, কিছু কিছু মধ্যবিত্ত তার গণ্ডি পেড়িয়ে বাচ্চাদের ইংরেজি স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছেন। সামর্থের সবটুকু খরচ করে পরিবার নিয়ে আরেকটু ভালো থাকার চেষ্টা করেছেন। এসব করতে গিয়ে অনেকেই বাড়াবাড়ি করেছেন। নিজের আর্থিক সীমাবদ্ধতা অস্বীকার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে যদি আমরা ভুলও মনে করি তবুও এরা ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না।  এই স্বল্পসংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষকে দিয়ে সামগ্রিক চিত্র অঙ্কন করাও ঠিক হবে না। লেখক গত পাঁচ বছরে এই শহরে মধ্যবিত্ত বলে কিছু দেখেন নি! আসলেই কি তাই? নাকি এই মহামারিতে আয় কমে যাওয়া মধ্যবিত্তের সঞ্চয় খরচ করে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সংগ্রামকে তিনি কটাক্ষ করে গেলেন! পুরো বিষয়টিই বোধগম্য হলো না। আমার এই অজ্ঞতাকে লেখক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন আশাকরি।       


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়