ঢাকা     বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১১ ১৪৩১

করোনা পরবর্তী বিশ্ব

হৃদয় আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০২, ১৫ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৩:০৩, ১৫ অক্টোবর ২০২০
করোনা পরবর্তী বিশ্ব

করোনায় বদলেছে অনেক সমীকরণ। বিস্তর পরিবর্তন এসেছে সমাজব্যবস্থায়। আগে যে শিশুরা মাঠে খেলে বেড়াতো এখন তারাই কম্পিউটার বা মোবাইলের মতো ডিভাইস নিয়ে ঘরে আটকা। পড়াশোনা, ব্যবসাসহ জীবন যাপনের নানান ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। করোনা কেটে গেলেও সব কিছু দ্রুত স্বাভাবিক হবে না বলে মত বিশেষজ্ঞদের। বিশ্বের সামাজিক অর্থনীতি খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে মহামারি করোনা।

চলতি বছরের শুরুর দিকের পৃথিবী আর বছরের শেষের পৃথিবীর যে পরিবর্তন হলো, তা আর কখনো একসঙ্গে মেলানো যাবে না। ১৯৪৫ সালের মে মাসের আগে ঠিক একইভাবে পৃথিবীর দৃশ্যপট এভাবে বদলে গিয়েছিল। বদলে গিয়েছিল চেনা বিশ্ব। সেই অর্থে বিবেচনা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ঘটনা করোনা মহামারি।

একটা সময় মানুষের মহামারি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। তারা জানতেন না মহামারি কী, কেন ছড়ায় বা প্রতিকার কী? সে সময়টাতে মানুষ মহামারির জন্য কোনো অদৃশ্য শক্তি বা অতৃপ্ত দেবতাকে দায়ী করতেন। এবং দলবদ্ধভাবে প্রার্থনা করতেন। এর ফলে মহামারি আরো সহজেই গোত্রের সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ত। ১৮ শতকে ব্ল্যাক ডেথের কারণে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার চারভাগের একভাগই মারা গিয়েছিল। পরবর্তীতে ১৬ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ অধিবাসী মারা গিয়েছিল গুটিবসন্তের কারণে। এ বিবেচনায় করোনার মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় বিজ্ঞানীরা একে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন এবং তাৎক্ষণিক প্রতিকারের মাধ্যমে রোগীকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ তার বন্ধু দেশগুলোকে চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে শুরু করে অন্যান্য দ্রব্যাদি দিয়ে সহায়তার করেছে। কিন্তু আমেরিকা, ইউরোপের মতো দেশগুলো মহামারি মোকাবিলায় তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। বিশ্বে তুলনামূলক নিরাপদখ্যাত অঞ্চলগুলোর অস্তিত্বের সংকটও দেখা দিয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

আরো পড়ুন:

অন্যদিকে চীনসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশ মহামারি মোকাবিলা করে দ্রুত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। পরবর্তী বিশ্ব নেতৃত্বে এর বেশ বড় প্রভাব পড়বে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। ভাইরাস হানা দেওয়ার পর কোনো ধরনের মতবিনিয়ম ছাড়া ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে দেখা গেছে আমেরিকাকে। এ পরিস্থিতি অনেকটাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন স্প্যানিশ ফ্লু’র কথা স্মরণ করিয়ে দেয় বিশ্বকে। সে সময় উত্থান ঘটেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আর শক্তিমত্তায় পিছিয়ে পড়েছিল অন্যতম শক্তিধর অস্ট্রিয়া, জার্মানি।

করোনা মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী করোনার কারণে মানবজাতি অন্তত এটি উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, একাংশের লোককে সুবিধাবঞ্চিত রেখে অন্য অংশকে সুস্বাস্থ্যের স্বর্গ বানানো চলবে না। ভালো থাকতে হলে সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

অনলাইন কেনাকাটায় ঝুঁকছে মানুষ

করোনায় অনেক ধনী লোক টাকা থাকার পরেও পণ্য কিনতে পারেনি। অনেকে আবার দিনের পর দিন ঘরবন্দি। এ সুযোগে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে অনলাইন ব্যবসা। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পণ্য কিনছে অনলাইনে। গত কয়েকবছরে অনলাইনে কেনাকাটার ধরন অনেক বদলেছে। শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় নয়, বিক্রেতারা নানা ধরনের পণ্য সম্ভার নিয়ে এসেছে অনলাইনে, যা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে এবং ইন্টারনেটে কেনাকাটায় উদ্বুদ্ধ করেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এ বেচা-বিক্রি চালু থাকবে এবং কিছু সময় পর মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়বে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালের মে মাসে অনলাইনে যত মানুষ কেনাকাটা করতেন, এবছর মে মাসে তা ৩১ শতাংশ বেড়েছে। অনলাইনে পণ্য অর্ডার করলে ঘরে বসে নির্ধারিত সময়েই তা বুঝে পাচ্ছেন ক্রেতারা। গ্রোসারি বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো এ তালিকায় অন্যতম। মানুষের নতুন এ মানসিকতা, আচরণ ই-বাণিজ্যের হাতকে আরো শক্ত করছে।

করোনায় ধর্মচর্চায় পরিবর্তন এসেছে

করোনায় ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে কাঠামোগত বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। প্রায় সব ধর্মেই জমায়েত নিষিদ্ধ করে বাড়ি থেকে প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে আগের মতো প্রার্থনা চালু হলেও বিপুল স্বাস্থ্যসতর্কতা ধর্মচর্চার আগের রূপ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। স্বাভাবিক সময়ে এর প্রভাব পড়বে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

অনলাইন শিক্ষা গতি পেয়েছে

করোনার বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের অন্তত ৭৫টি দেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়। অনেক দেশ স্কুল খুলে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণের আশঙ্কায় তা পুনরায় বন্ধ করেছে। করোনা পরবর্তী সময়েও এ ধরনের অনলাইন কার্যক্রম বেশ জোরেশোরে চলমান থাকবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন আগের তুলনায় অনেক শিক্ষার্থী এখন অনলাইনে ক্লাস করে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও অনলাইনে ক্লাস করতে চাইবেন। বাংলাদেশেও করোনা পরবর্তী সময়ে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি।

জাতীয়তাবাদের কাল শুরু করছে করোনা

করোনা পরবর্তী বিশ্বে কর্তৃত্বের কাঠামোগত ওলট-পালট হওয়ার কথা বলছেন অনেকেই। তাদের মতে শীঘ্রই আঞ্চলিক মেরুকরণ বাড়বে। খোদ ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ করোনাকালে এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বরং দেখা গেছে ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। যা এরইমধ্যে ‘করোনা-জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। করোনায় ইতালি, ইইউ সদস্য দেশগুলো থেকে তেমন সহায়তা পায়নি। তাছাড়া সহায়তা না পেয়ে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিস ইউরোপিয় ঐক্যের ধারণাকে একটা ‘রূপকথা’ বলে অভিহিত করেছেন। যা বিশ্বব্যাপী বেশ শোরগোল ফেলেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক মেরুকরণ বাড়বে। ফলে নিজ নিজ দেশে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রবণতা বাড়বে। অনেক দেশই অন্য দেশের নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে। যার ফলে আন্তঃদেশীয় খোলামেলা সীমান্তগুলো আর পূর্বের মতো থাকবে না।

বেকারত্ব বাড়বে ব্যাপকহারে

করোনার কারণে বিশ্ব এতো বড় ধাক্কা খেয়েছে যা জীবদ্দশায় কেউ দেখিনি। আমেরিকার প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তার কর্ম ঘণ্টা হারিয়েছেন। অন্যান্য দেশগুলোতে বেকারে সংখ্যা শুধু বাড়ছেই। ধনী-গরিবের ব্যবধান তুলনামূলক আগের চেয়ে বেড়েছে।

করোনার কারণে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ আর গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, শহরাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ কর্মহীন হয়েছে ঢাকায়। এখানে ৭৪ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। ঢাকা বিভাগের গ্রামাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন। গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এখানে কর্মহীন হয়ে পড়েছে ৪৭ শতাংশ মানুষ।

আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারিতে ৬৮ দশমিক ৩৯ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। ওই সময়ে ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ পরিবার সহায়তা বা ত্রাণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৯৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ সরকারি সহায়তা নিয়েছে।

করোনা পরবর্তী স্বাস্থ্যবিধি

বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক, অর্থাৎ প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ করোনার ভয়ে তাদের ঘরে বসে সময় কাটিয়েছেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এত বেশি সংখ্যাক মানুষ একই সময়ে, একটানা, এত দীর্ঘকাল ঘরে বন্দি থাকার নজির আর নেই। এই মহামারির পর পাল্টে যাবে আমাদের কাজ, প্রতিদিনের জীবন, ভ্রমণ-বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-সমাজ সব কিছু।

করোনার দুর্যোগ পেরিয়ে আবার কবে মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে পারবে, কবে মুখোশ খুলে খোলা বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে তা এখনো কেউ বলতে পারে না। এটা হতে পারে কয়েক মাস বা বছর পর। তবে, এটা নিশ্চিত যে মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। নতুন করে শিশুরা মাঠে খেলবে।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়