ফাঁসিতে হাসি ফুটবে তো?
হৃদয় আলম || রাইজিংবিডি.কম
বাংলাদেশে এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশে আগে থেকেই ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই যদি বলি- দেশটিতে রোজই ঘটে চলছে ধর্ষণের ঘটনা। মৃত্যুদণ্ড দিয়েই মানুষের মনের কদর্যতার অন্ধকার রোধ করা যায় না। তাহলে যেসব দেশে আগে থেকেই ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছিল সেসব দেশে আর এ ধরনের ঘটনা ঘটত না।
অনুভূতিশূন্য মানুষের অপরাধের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না। অন্ধচিন্তার মানুষ অনেক সময় ভাবেন, তারা যা করছেন তা তেমন কিছু না। যে কারণে আমি মনে করি, কঠিন শাস্তির বিধান রেখে ধর্ষণের মতো সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়। তবে, এতে সাময়িক ভীতি তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু তারপরও মানুষ ঝুঁকি নিয়ে অপরাধ করছে। যৌন হেনস্তা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণের মূল কারণ যদি খুঁজে বের করে উপরে ফেলা না যায় তাহলে আমার আশঙ্কা ধর্ষণ চলতেই থাকবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশে যত ধর্ষণ হয় তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই হয় নিন্মবিত্ত, অশিক্ষিত সমাজে। কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। উচ্চবিত্তরা আইনের ভয়ে হোক বা সন্মানের ভয়ে এ ধরনের ঘটনায় জড়ায় কম। জড়ালেও প্রকাশ হয় আরো কম। উচ্চবিত্ত সমাজে পুরুষ শরীরের খোরাক জোগানোর সুযোগ পান অর্থ খরচ করেও। কিন্তু নিন্মবিত্ত সমাজে নারীদের সম্পর্কে ধারণা কম। এর মধ্যে স্মার্টফোনের কারণে পর্নো দেখে উশৃঙ্খল হচ্ছে একটি শ্রেণি। এমন একটা শ্রেণি আছে যাদের কাছে নারীর বয়স কোনো ব্যাপার নয়। তারা নারীদের ভাবেন শুধু ভোগের পণ্য!
দেশে ধর্ষণের জন্য এক শ্রেণির লোকেরা আবার নারীদের পোষাককে দায়ী করেন। তাদের ভাষ্য, নারীদের পোষাক কথিত পুরুষ মনে কাম ভাব বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আপনি যদি সম্প্রতি সময়ের আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে যান, কোনো ঘটনাতেই নারীর পোষাকের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাবেন না। এ শুধু দৃষ্টিভঙ্গীর সমস্যা ছাড়া আর কিছুই না।
পতিতালয়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে কেন?
দেশের পতিতালয়ের প্রয়োজন বোঝার জন্য বই পড়া বা গবেষণার দরকার নাই। চলমান পরিস্থিতি দেখে যে কেউ সহজেই এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারবেন। সৌদি আরব ও পাকিস্তানসহ যে দেশগুলোতে পতিতালয় বেআইনি, সে দেশগুলো ধর্ষণের তালিকায় এগিয়ে। পক্ষান্তরে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, জাপানের মতো যেসব দেশ ‘সেইফ কান্ট্রি উইমেন’ হিসেবে পরিচিত সেখানে পতিতালয় মোটেও বেআইনি নয়।
যৌনবৃত্তির জন্য সমাজ বা সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা ভেবে দেখেছেন? পতিতালয় বন্ধ করে লাভ কতোটা? এখন পুরো শহরে ভাসমান যৌনকর্মীদের আনাগোনা। নেই তাদের কোনো ঠিকানা। পুরুষ গ্রাহকদেরও অবস্থা তথৈবচ। গ্রামে পরিবার রেখে শহরে কাজ ও বাস করা পুরুষের সংখ্যা বেশিই বলা যায়।
থাইল্যান্ডে দশমিক ৯৫ শতাংশ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। অথচ এই শহরই ‘পতিতালয়ের রাজধানী’ খ্যাতি লাভ করেছে। ভারত বিশ্বের অন্যতম দেশ যেখানে ধর্ষণ রেট সবচেয়ে বেশি। ২০১৮ সালে প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আরও অনেক ধর্ষণ লিপিবদ্ধই করা হয়নি।
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের লাইসেন্স দেওয়া হয়। আমার মতে, দেশের ঘুষখোর, মাদক ব্যবসায়ী, অসৎ লোকেদের চেয়ে এসব নারী যৌনকর্মীরা অনেক বেশি সম্মানিত। তারা চুরি করেন না। মিথ্যা বলেন না, এমনকি অবৈধ উপার্জনও করেন না। দেশের ধর্ষণ কমাতে অনেক বড় অবদান রাখে এসব যৌনকর্মীরা। তাই বলতেই পারি পতিতালয়গুলো সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সংস্কৃতির মান নিন্মগামী হচ্ছে
আমাদের সংস্কৃতির মানও অনেক ক্ষেত্রেই নিন্মগামী হচ্ছে। আগে যেখানে চলচ্চিত্র, নাটক, টিভিতে নানান শিক্ষামূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসতো এখন সেখানে রুচিশীল কন্টেন্ট আর শ্রীহীন অঙ্গভঙ্গি করে রাতারাতি তারকা বনে যাচ্ছেন অনেকেই। শিশু-কিশোররা এসব দেখে ভুল বার্তা পাচ্ছে, সমাজে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা।
অধঃপতিত সাংস্কৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে এখন আর আমাদের উদাসীন থাকার সুযোগ নেই। শুধু ফাঁসি বা কঠোর শাস্তিতেই অপরাধী দমবে তাও ভাবার সুযোগ নেই। নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা, নান্দনিক বোধ, সুরুচির সৃষ্টি করতে হবে মনে-মনে, জনে-জনে।
ঢাকা/তারা