ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

অসময়ে অগস্ত্য যাত্রায় সুরের নায়ক

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ৮ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অসময়ে অগস্ত্য যাত্রায় সুরের নায়ক

সুবীর নন্দী। জন্ম : ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩, মৃত্যু: ৭ মে ২০১৯

|| অজয় দাশগুপ্ত ||
তাঁর কণ্ঠ ও গায়কী আলাদা ছিলো বলেই তিনি অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। এই সেদিনও কোনো এক টিভিতে দেখলাম গান গাইছিলেন। এখন কি হয়-এককালের খ্যাতিমান গায়কেরা যারা বয়সে তাঁর চেয়েও ছোট আর গাইতে পারেন না, যন্ত্র দিয়ে কাভার করেন। কেউ কেউ দোহারীর মতো অন্যদের পাশে রাখেন উঁচুতে উঠলে টেনে দেবে বলে। এমনও দেখেছি কেউ কেউ গানের মাঝপথে তা থামিয়ে ওপরের জায়গাটা আবৃত্তির মতো বলে আবার খাদ থেকে গান ধরেন। সুবীর নন্দীর বয়স যাই হোক তা করার দরকার পড়তো না।

তিনি এমন এক সময় আমাদের আধুনিক ও সিনেমার গানে এসেছিলেন যখন মোটামুটি ধরে নেয়া হয়েছিল সব শেষ। একালের বিখ্যাতজনেরা পুরনো গান দিয়ে চলেন, আর নতুনদের গান মানে মিশ্র কোনো কোলাজ। তখনো অবশ্য যন্ত্রের সাহায্যে কণ্ঠ ঠিক করা কিংবা সাউন্ড এফেক্ট দিয়ে গান করার চল আসেনি। আশির দশকে একটি নতুন কণ্ঠ কেন জানি আবেশ ছড়িয়ে দিলো বাঙালির মনে। মনে আছে রাঙামাটি গিয়েছিলাম বেড়াতে। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে। রাতে একটা হোটেল ভাড়া করে থাকা আর সন্ধ্যায় সিনেমা দেখা। তখন না-ছিলো ইন্টারনেট না মোবাইল। বিনোদন মানে রেডিও, টিভির একটা চ্যানেল আর সিনেমা। সেই সিনেমাটি আহামরী কিছু ছিলো না। যেমন হয় গতানুগতিক কাহিনি। ফারুক ছিলেন নায়ক। অতি অভিনয় আর ট্রাক ড্রাইভারের প্রেম। কিন্তু সিনেমা শেষ হলেও গান ফুরালো না। তখন কি সুযোগ ছিলো যে বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই গান শুনে মনে রাখবো? অথচ গানটির কয়েকটি লাইন ঢুকে গিয়েছিল মগজের কোষে। ‘দিন যায় কথা থাকে’ গানটির এক জায়গায় ‘যে ছবি নয়নে আগুন আল্পনা আঁকে’ বলে একটা লাইন আছে- কী অসাধারণ কন্ঠ আর গায়কী! সে মানুষটি হালকা গানেও এমন ভাব আনতে পারতেন কারণ তিনি মাটি ফুঁড়ে উঠেননি। এসেছিলেন মাটি কামড়ে।

ক্লাসিক্যাল চর্চা ছাড়া যারা গাইতে আসেন তাদের গান হিট হোক আর না-হোক একটা সময় তাদের জন্য আপনার মায়া হবেই। হতশ্রী চেহারার মতো ভাঙা গলা আর ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির সেসব গায়কদের মতো ছিলেন না তিনি। আমাদের দেশের প্রথিতযশা শিশুকিশোর সংগঠক কচি কাঁচার আসরের দাদাভাই সিলেট ঘুরে এসে লিখেছিলেন- তাঁকে সারারাস্তা গান শোনানো এই কিশোর মন ভরিয়ে দিয়েছিল তাঁর। তিনি বাজী রেখে বলেছিলেন- এ একদিন বাংলাদেশ জয় করবে। করেছিলেন বৈকি। আড়াই হাজারের বেশি গান আর চারবার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শিল্পী। মরণের আগে আগে পেয়ে গেলেন একুশে পদক। পুরস্কার তাঁকে সম্মানিত করেছে যতটা, পদকও সম্মানিত হয়েছে ততটা। এমন নিভৃতচারী সজ্জন আর ভদ্রলোক এখন বিরল। আমি কথা বলে জেনে বলছি, অল্পে অহঙ্কারী আর আকাশে মাথা তোলা মানুষদের ভিড়ে সুবীরদা ছিলেন ব্যতিক্রম।

তিনি খুব সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। আমরা যে বলি, প্লেইন লিভিং হাই থিংকিং তেমন মানুষ। পোশাকে খাবারে কথায় পরিমিত। আমি কারো নিন্দা করতে শুনিনি। সিডনি বেড়াতে এসে একরাত আড্ডা দেয়ার সুবাদে আমি তাঁর সৌজন্য আর বিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। এ বিষয়গুলো এখন নাই বললেই চলে। এখন শো-আপের যুগ। অথচ এই সাদাসিধে মানুষটিই জয় করেছিলেন আপামর বাঙালির মন। আমার এখনো মনে আছে গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের নামে এখন যে কর্পোরেট বাণিজ্য তেমন একটি শোতে অতিথি ছিলেন হৈমন্তী শুক্লা। তিনি আমাদের দেশের এক প্রতিযোগীকে বেশ ধমকের সুরেই বলেছিলেন, তোমরা সবসময় এসব পল্লীগীতি গান গাইতে চাও কেন? আধুনিক গান গাইতে পারো না? সুবীর নন্দীর গান? এমন কথা তাঁর ব্যাপারেই মানায়। এভাবেই তিনি উভয় বাংলায় তাঁর জায়গা করে নিয়েছিলেন।

আমাদের দেশে ভালো গীতিকারের অভাব। সুরকারও হাতে গোনা। সেখানে এমন করে নিজের একটা বিশেষ স্থান করে নেয়া দুঃসাধ্য। সেটা করার কারণ খুব পরিষ্কার।সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। তাছাড়া গান হচ্ছে সাধনা। আজকাল কি কারো তেমন ধৈর্য বা সময় আছে? সবাই খুব তাড়াতাড়ি নাম করতে চায়।সুবীর নন্দীরা বহু সময় পার করে তারপর গায়ক হয়ে উঠেছেন। আজ এসে কাল সিডি ক্যাসেট বের করে নাম করায় মেতে উঠেননি। নাম করাটা যেখানে মূখ্য সেখানে নামের পরিচয় আকার মুছে যাওয়া ও সময়ের ব্যাপার। দাগ কাটতে হলে দাগের মতো কাজ করে যেতে হয়। ধরুন কোনো গানই থাকলো না, দুটো গান তো বাঙালি কোনোকালেই ভুলতে পারবে না। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরও সমান আধুনিক থাকবে ‘আমার দুটি চোখ পাথর তো নয়’ কিংবা ‘আমি চাইনি হতে কারো নয়নের জল’। এমন ভাবাবেগ এমন সুরেলা যাদু কি ভোলা সহজ না সম্ভব?

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি হেমন্ত, মান্না কিংবা শ্যামল মিত্র আমাদের ছিলো না বটে, গর্ব করে আরো কয়েকজনের সাথে সুবীর নন্দীর নাম আমরা বলতেই পারি। নিরহঙ্কারী সাদামাটা মানুষটি গান দিয়ে বাঙালির মন জয় করে গিয়েছেন। অকালে তো বটেই এমন কোনো বয়স হয়নি যে চলে যাবেন। তারপরও প্রকৃতি অথবা নিয়তি এমনই। তাঁর মৃত্যুর পরদিন আমরা কবি রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করছি। যিনি আমাদের শিখিয়েছেন মৃত্যু জীবনের অমোঘ সত্য। যিনি বলেন: ‘মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই...।’

খুব মনে পড়ছে তাঁর কথা। ভালো মানুষ চমক লাগাতে পারে না বটে কিন্তু কেমন জানি একটা ছাপ রেখে যায়। যে ছাপটা দীর্ঘ সময় ধরে লালন করি আমরা। বাংলা গানের জগত এমনিতেই ভালো নেই। আজকাল কতো হাঙ্গামা! গান গাওয়া শোনা নিয়ে কত নিষেধ কত বারণ। সেকালে এমন একজন মৌলিক ও আধুনিক শিল্পীর চলে যাওয়া বড় ঘটনা। কোনো এক সন্ধ্যায় কিংবা মন খারাপ করা কোনো বিকেলে যুবকের কণ্ঠে নিশ্চয়ই ভেসে আসবে ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ অথবা রাতজাগা চাঁদের দিকে তাকিয়ে গুণগুণ করে কেউ গাইবে ‘এক যে ছিলো সোনার কন্যা...।’

সুবীর নন্দী আপনি আমাদের বেহুলা বাংলার গানের লখিন্দর। আমরা আপনাকে চিরকাল মনে রাখবো।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়