ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আবরারকে হাসপাতালে নেয়ার আকুতি কেউ শোনেনি

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আবরারকে হাসপাতালে নেয়ার আকুতি কেউ শোনেনি

গভীর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হলে আবরার হত্যার ঘটনায় হাসপাতালে না নেওয়ার ব্যর্থতার কথা পুলিশের কাছে জানিয়েছে আবরারের এক বন্ধু মুহতাদি আহনাফ আনসারী।

আবরারকে বাঁচাতে না পারার কারণে নিজেকে বড্ড অপরাধী ভাবছেন মুহতাদি আহনাফ আনসারী। জীবন্ত মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য অবলোকন করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

হত্যার ঘটনার দিন যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া বন্ধুর দেহের ওপর হাত রেখে আঁতকে ওঠে তার মন। চিৎকার করতে চেয়েও ভয়ে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে যান। তবুও বন্ধুকে বাঁচাতে আকুতি-মিনতি করে সহপাঠীদের কাছে। কিন্তু তার সহপাঠীরাও যে তার মত ছোট। যারা সব সময় বড় ভাইদের নির্যাতনের আতঙ্কে থাকেন। আর এই বড় ভাই আতঙ্কেই সেদিন আবরারকে বাঁচাতে পারেননি।

সেদিন যদি একটু সাহস করে নিজে কিংবা অন্যকে দিয়ে বড় ভাইদের বুঝিয়ে সময় মত অ্যাম্বুলেন্স আনতে পারতো তাহলে হয়তো আবরার বেঁচে যেত। কিন্তু কেউ সেই আকুতি কর্ণপাত করেনি। আবরারকে বাঁচাতে না পারার কারণে নিজেকে বড্ড অপরাধী ভাবছেন তিনি।

পুলিশের কাছে দেয়া দেয়া জবানবন্দিতে এমনটাই জানিয়েছে আবরারের বন্ধু মুহতাদি আহনাফ।

মুহতাদি আহনাফ পুলিশকে জানায়, ৬ অক্টোবর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম থেকে হলে আসি। রাত ৯টার দিকে টিউশনি করে হলে ফিরি। এ সময় সাখাওয়াত অভিকে দেখি সে ২০১১ নং রুমে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি। তখন দেখি এহতেশামুল রাব্বি তানিম একটি ক্রিকেট স্ট্যাম্প নিয়ে ওই রুমের দিকে যাচ্ছে। তখন সে অভিকে ডেকে নিয়ে যায়। অভিকে জিজ্ঞাসা করি, ২০১১ রুমে কি হচ্ছে? সে বলে পরে বলবো। আমি এ নিয়ে মাথা ঘামাই না। কারণ এমন ঘটনা হলে প্রায়ই ঘটে। কয়েকদিন আগে ওই রুমে ১৮ ব্যাচের ছাত্র সিয়াম ও তাকিকে ১৭ ব্যাচের তানিম, জেমি, রানা, শামীম বিল্লাহসহ আরো কয়েক জন ছাত্র মারধর করে এবং র‌্যাগ দেয়।

সে জানায়, রাত সাড়ে ৯টার পর সে ঘুমিয়ে পড়ে এবং রাত একটার দিকে পড়ার জন্য ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণ পর গোসলে যায়। গোছল থেকে ফিরে দেখি মোর্শেদ অমর্ত্য রুমে।  তার সাথে কিছুক্ষণ কথা হয়, কিন্তু তাকে একটু উদ্বিগ্ন মনে হলো। তাকে জিজ্ঞাসা করি ২০১১ রুমে কি হচ্ছে। সে কিছু বলতে চায় না। আমিসহ আমার দুই রুমমেট তাজোয়ার ও রাফসান যখন জিজ্ঞেস করি, তখন সে বলে, তেমন কিছু না, একজনকে শিবির সন্দেহে ধরা হয়েছে। নাম জানতে চাইলে সে বলে আবরার ফাহাদ। পরে সে চলে যায়। মোর্শেদ আবার আমার রুমে আসে। তখন মোর্শেদকেও উদ্বিগ্নের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, অনিক, রবিন আবরারকে বেশি মেরেছে। মোর্শেদ আবার রুম থেকে বের হয়ে যায়। রাত আড়াইটার সময় আবার এসে বলে আবরারকে দেখতে চাইলে বের হয়ে দেখ। পানি আনার নাম করে মোর্শেদ আমাকে আবরারকে দেখে আসতে বলে। আমি ফিল্টারের পানি আনতে যাই। তখন দেখি শামীম বিল্লাহ এক বোতল পানি নিয়ে নিচে নামছে। নিচে নামার সময় দেখি নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলার মাঝামাঝি স্থানে একটা তোষকের ওপরে আবরার শোয়া অবস্থায়।

মুহতাদি আহনাফ বলে, সাইফুল ইসলাম, আবু হোরায়রা মোয়াজ ওর হাত-পা মালিশ করছে। শামীম বিল্লাহ আবরারকে পানি খাওয়াচ্ছিল। আবরার তখন বলছিল, আমার খারাপ লাগতেছে। তখন বুঝতে পারি নাই ওর অবস্থা এত খারাপ। এরপর আমি রুমে চলে আসি। পানির বোতল রেখে মোর্শেদকে জিজ্ঞাসা করি, ওর (আবরার) কী অবস্থা? মোর্শেদ বলে ওর অবস্থা ভালো না, হাসপাতালে নিতে হবে। আমি যেতে চাইলে মোর্শেদ বারবার মানা করে এবং বাধা দেয় না যেতে। সে বলে, ওখানে পলিটিক্যাল ছাত্ররা আছে, তোর যাওয়ার দরকার নাই, শুধু শুধু ঝামেলায় পড়বি। তাও কিছুক্ষণ পর সেখানে যাই। আবরারের শরীরে হাত দিয়ে দেখি একদম ঠান্ডা, পালস্ও পাই না। তাও ভাবি সে হয়তো সেন্সলেন্স হয়ে গেছে।

বারবার মোয়াজ আবু হোরায়রাকে বলি, অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে।  কিছুক্ষণ পর নাজমুস সাদাত নিচ থেকে আসলে তাকেও বলি বড় ভাইদের অ্যাম্বুলেন্স ডাকার কথা বলার জন্য।  সে তখন চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আরাফাত রহমান উপর থেকে আসে। সেও আবরারের হাত-পা মালিশ করে। আমি তার বুকে চাপ দিতে থাকি। কিছুক্ষণ পর জিসান এসে আবরারের বুকে পাম্প করে এবং আবরারকে বসিয়ে পাম্প করতে থাকে। ততক্ষণ ডাক্তার চলে আসে। ডাক্তার এসে তার পালস চেক করে এবং বুকের স্টেথোস্কোপ  দিয়ে বুকের বামপাশে চেক করে। তাকে যখন বারবার বলি আবরারকে হাসপাতালে নেয়ার কথা তখন তিনি বলেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে কি হবে, সে তো আর নেই।

তখন নিচের দিকের সিঁড়িতে জিসান, মুজাহিদসহ আরো অনেকে ছিল। ডাক্তার তখন জিজ্ঞেস করেন, ওর এ অবস্থা কে করেছে, তখন সিঁড়িতে থাকা সবাই দৌড়ে নিচে নেমে যায়। আমি তখন কান্নায় ভেঙে পড়ি। তখন আমার রুমমেট ও মোর্শেদ আমাকে রুমে নিয়ে যায়। তারা আমাকে রুম থেকে বের হতে দেয় না। কিছুক্ষণ পর তানভির ইসলাম ও আমি নীচে নামি। তখন ওখানে প্রভোষ্ট, ডিএসডব্লিউ, সহকারী হল প্রভোস্ট ড. ইফতেখার স্যার ছিলেন। আমাদের ব্যাচের প্রায় ১৫/২০ জন ছাত্র জড়ো হয়েছিল।

মেহেদী হাসান রাসেলও ছিল সেখানে। কিছুক্ষণ পর আমরা প্রভোষ্ট স্যারের সাথে ১০১০ রুমে যাই।  আমরা ১৫-২০ জনসহ প্রভোষ্ট, ডিএসডব্লিউ এবং সহকারী প্রভোষ্ট ড. ইফতেখার স্যার ছিলেন। তিনি আমাদের কাছে জানতে চান, কী হয়েছে? একজন বলা শুরু করলে মেহেদী হাসান রাসেল জানালা দিয়ে রুমের দরজার ছিটকিনি খুলে রুমে ঢুকতে চায়। তখন সহকারী প্রভোষ্ট তাকে রুমে ঢুকতে না করে। এ সময় সে ডিএসডব্লিউকে ডেকে নিয়ে যায়। সহকারী প্রভোষ্ট স্যারকে সবকিছু বলার পর আমরা ১০১০ রুম থেকে বের হয়ে যাই।

 

ঢাকা/মামুন খান/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়