ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

করোনাকালে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের করণীয়

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১৭ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনাকালে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের করণীয়

শিক্ষার্থী বন্ধুরা কী করছ এই সময়? প্রতিদিন ক্লাসের দৌড়াদৌড়ি নেই, কোচিং সেন্টারে যাওয়ার কিংবা শিক্ষকদের বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই, নেই ক্লাস পরীক্ষা, কোচিং-এর পরীক্ষা, ব্যক্তিগত শিক্ষকের পরীক্ষা। আমরা পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যেমন তোমাদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়ে দিয়েছিলাম; তোমাদের সেই বোঝা বহন করার ক্ষমতা নেই জেনেও; তারপরও তোমরা মাথা নিচু করে, মেরুদ- বাঁকা করে হলেও সেগুলো মেনে নিয়েছিলে। ¯্রষ্টা বোধহয় তোমাদের কষ্ট লাঘব করার জন্যই এই ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু তাই বলে এখন কি তোমরা শুধু খাবে আর ঘুমাবে? মানুষ তো আসলে অলসভাবে বসে থাকতে পারে না, থাকতে চায় না। সে কিছু না কিছু করতে চায়। নিশ্চয়ই তোমরাও কিছু একটা করতে চাচ্ছো।

সংসদ টিভিতে কিছু ক্লাস প্রচারিত হচ্ছে। হয়তো তোমাদের বিদ্যালয়ের ক্লাসের সাথে হুবহু মিলবে না, তারপরেও সেগুলো দেখ, অনেকটাই কাজে লাগবে। এতদিন তো শুধু তোমাদের নিজেদের শিক্ষকদের ক্লাস দেখেছ, এবার একটু অন্য স্যারদের ক্লাস দেখ, এটিও এক ধরনের শিক্ষা। কাজে লাগবে বা লাগবে না বলতে এটা মনে করো না যে, এগুলো পরীক্ষায় আসবে না তো দেখে কী লাভ? এখানেই আমার কথা। তোমরা এতো দিন যা পড়েছ তার অধিকাংশই কিংবা পুরোটাই ছিল পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট। পরীক্ষায় যা আসবে তাই পড়ব, যা আসার সম্ভাবনা নেই তা ছুঁেয় দেখব না। এটি হয়ে গিয়েছিল অনেকটা অভ্যাসের মতো। আমি এজন্য অবশ্য তোমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছি না, এটা আমরা সকলে মিলে তৈরি করেছি।

পড়ার ও জানার যে অপার আনন্দ তা ফিকে করে দেয়, মাটি করে দেয় এই পরীক্ষার চিন্তা। পরীক্ষার পড়ার চিন্তা। কাজেই তোমাদের সেই সময় ফিরে এসেছে, ¯্রষ্টাই তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন খাঁটি পড়া পড়তে, মনের আনন্দে পড়তে। এই সময় তোমার পাঠ্য বইগুলো পড়ে ফেল অর্থৎ মূল বইগুলো বারবার করে পড়ার পর দেখবে তোমার মনের মধ্যে অন্য এক ধরনের শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, অন্য এক ধরনের চোখ খুলে গেছে। তোমরা পরিবেশের কারণে অনেকেই পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ ও সময় পাও না। নির্ভর করো বাজারের নোটা, গাইড, শিক্ষকের দেওয়া নোটের ওপর। এতে তোমার যে নিজস্ব শক্তি আছে তা ব্যবহার করার, প্রয়োগ করার সময় ও সুযোগ পাও না। এই ব্যাপারটি ধীরে ধীরে তোমার নিজস্ব সৃজন ক্ষমতাকে ভোতা করে দেয়। আমাদের সময়ে আমার মনে আছে, আমরা মূল বই বারবার পড়তাম। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘প্রবাস বন্ধু’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমি সৈনিক’ রবীন্দ্রনাথে ‘ছুটি’, ‘পোস্টমাষ্টার’ পড়তে পড়তে পুরো গল্পগুলোই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

একইভাবে ইংরেজির ‘থ্রি কোয়েশ্চেনস’ ‘বারবার অফ বাগদাদ’, ‘ফারমার্স ডটার’ ইত্যাদি। মূল বই পড়ার ফলে যেটি হতো, ওই বই থেকে যত ধরনের প্রশ্নই হোক- ব্যাখ্যা, ছোট প্রশ্ন, বড় প্রশ্ন সব উত্তরই করতে পারতাম। আমাদের সময়ও যে নোটবই ছিল না তা নয়। নোট বই ছিল, আমরা দেখতামও কিন্তু হুবহু সেগুলো থেকে লিখতাম না। কারণ পুরো ঘটনা, পুরো বিষয় তো জানা আছে মূল বই পড়ার কারণে। নোট বইয়ে যদি নতুন কিছু পেতাম সেটি নিজের উত্তরের সাথে যোগ করতাম। ভালো নোটবই আমাদের চিন্তাশক্তিতে নতুন এক ধরনের উপাদান যোগ করত, আমরা হুবহু নোটের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না কোনো বিষয়েই। গণিত, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা। বারবার অনুশীলন করতাম গণিত, পড়তাম ও বোঝার চেষ্টা করতাম বিজ্ঞান। তোমাদের সেই সুযোগটি কিন্তু এসেছে, কাজে লাগাও।

এই সময় শুধুই কি ক্লাসের বই পড়বে? না। বাসায় বিভিন্ন লেখকদের যে বইগুলো আছে পড়ে ফেলতে পারো। বাসায় বাবা, চাচা, বড় ভাই, বড় বোনদের কাছে থাকা বইগুলো পড়ে ফেলতে পারো। এই পড়া তোমার অন্য এক ধরনের চোখ খুলে দেবে। তোমার জানার দিগন্ত প্রসারিত করে দেবে। বিভিন্ন চ্যানেলে শিক্ষামূলক বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়, সেগুলো দেখতে পারো। ইংরেজি উচ্চারণ ও লিসেনিং স্কীল বাড়ানোর জন্য বিবিসি ও সিএনএন নিউজ শুনতে থাক। নিউজের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ ও স্থানের ছবি দেখানো হয়, করোনার খবর দেখায় বিস্তারিতভাবে। ছবি দেখা ও ইংরেজি শোনা বিষয় দুটো তোমার দারুণ কাজে লাগবে। ভালো  মুভি দেখতে পারো। যেসব বিষয় দেখছ, চিন্তা করছ, সেগুলো ওপর বাংলা ও ইংরেজি কিছু লিখে ফেলার চেষ্টা করবে। তাতে তোমার লেখার ক্ষমতা বাড়বে, সৃজনশীলতা প্রকাশ পাবে, পরীক্ষার জন্য সবকিছু মুখস্থ করার অভ্যাসটিও কমে যাবে। মনে আনন্দ পাবে। এভাবে তোমার দীর্ঘ গৃহবন্দিত্বের সময়টাও কেটে যাবে।

শিক্ষকদেরও কিন্তু পেশাগত উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু করার আছে এই সময়ে। পেশাগত উন্নয়নের জন্য ফিডব্যাক দেওয়া ও ফিডব্যাক নেওয়া জরুরি। একজন সহকর্মী অন্যান্য সহকর্মীদের সামনে একটি ক্লাস উপস্থাপন করবেন, তার ভুল-ত্রুটিগুলো জানার জন্য, কারণ নিজে নিজেকে পুরোপুরি বিচার করা যায় না। একজন শিক্ষকের ক্লাস কিন্তু অনেকের জন্য, অনেক শিক্ষার্থীর জন্য। তাই, সেখানে পারফেকশন আনতে হলে বারবার ফিডব্যাক নিতে হয়, উপস্থাপন করতে হয়, নিজের আত্মবিশ^াসও তাতে বেড়ে যায়। এ কাজটি শিক্ষক জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হলেও আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর চর্চা নেই দু’চারটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান ছাড়া। এখন সংসদ টিভিতে যে ক্লাসগুলো উপাস্থাপন করা হচ্ছে, শিক্ষকগণ কিন্তু সেগুলো দেখতে পারেন, সেখানে কে কতটা ভালো করছেন আপনি সেগুলো অনুসরণ করতে পারেন। কার কোথায় ত্রুটি রয়ে গেছে আপনি সে জায়গাগুলোতে সংশোধন করে নিজের ক্লাস ভালোভাবে নিতে পারবেন। শিক্ষা সংক্রান্ত বহু ওয়েবসাইট আছে, সেগুলো ব্রাউজ করতে পারেন। পড়তে পারেন অনেক শিক্ষামূলক আর্টিকেলস। ইউটিউবে অনেক ক্লাস দেখা যায়, সেগুলো দেখতে পারেন। বাসায় যেসব বই রেখে দিয়েছিলেন তাকে সাজিয়ে, সময়াভাবে পড়া হয়নি সেগুলো পড়ে ফেলতে পারেন। এগুলো সবই ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও পেশাগত উন্নয়নের জন্য জরুরি।

করোনকালে নিজকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যেসব নির্দেশাবলী দেওয়া হয়েছে সেগুলো মোবাইলে শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের জানাতে পারেন। এটিও শিক্ষাদানের এবং সামাজিক দায়িত্বের অংশ। করোনার উপসর্গগুলো কী কী সেগুলো জানাতে পারেন। কারুর করোনার উপসর্গ দেখা দিলে ৩৩৩ নাম্বার বা ৯৯৯ বা ১৬২৬৩ নাম্বারে ফোন দিতে বলতে পারেন। পাশের বাড়িতে বিদেশ থেকে কেউ এলে ১৪ দিন আলাদা থাকার কথা, কেন থাকতে হবে সেগুলোর কথা বলতে পারেন।

তবে, সংবাদপত্রে একটি সংবাদ দেখে খাারাপ লেগেছে। সেটি হচ্ছে করোনার কারণে আটকে গেছে সাড়ে চার লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওর টাকা। সরকারি ছুটি ও নানা জাটিলতার কারণে আটকে আছে তাদের এই অর্থ। অনেক শিক্ষককে বাড়ি ভাড়া দিতে হয়, সংসার চালাতে হয়, আনুষাঙ্গিক খরচ বহন করতে হয়। তাদের ঘরে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না থাকে, বাজার না থাকে তাহলে তিনি কীভাবে মনোযোগ দেবেন নিজের পেশাগত উন্নয়নের দিকে, শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের দিকে এবং সর্বোপরী সমাজ ও দেশের উন্নয়নের দিকে। তাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিনীত অনুরোধ করছি, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অর্থের ছাড় জরুরি ভিত্তিতে করতে। শিক্ষকদের অর্থনৈতিক টান টানাপড়েনের মধ্যে ফেলে দিয়ে আমরা কিন্তু আমাদের কাাক্সক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না। বিষয়টি স্বাভাবিক সময়ে যেমন প্রয়োজন, এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে আরও বেশি প্রয়োজন।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়