কারুশিল্পী ডাকো সাধুর গল্প
ইয়াছিন মোহাম্মমদ সিথুন, নীলফামারী : নীলফামারী সদর উপজেলার পলাশবাড়ি ইউনিয়নের খালিশাপচাগড় এলাকার ধনঞ্জয় রায় (৭৩) দা হাতে বাঁশের কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে।
বাবা রমানাথ রায়ের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য অভাবি সংসারে ১৩ বছর বয়সেই মা ও একমাত্র বোনের ভার তার ওপর পড়ে।
ধনঞ্জয় ঘরের বাঁশের তৈরি ছাদে খুব সুন্দর নকশা তুলতে পারতেন। এজন্য অন্য মজুরের চেয়ে তার কদর একটু বেশিই ছিল। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাঁশ দিয়ে মানুষ, পশুপাখিসহ বিভিন্ন শৈল্পিক জিনিসপত্র শখের বশে তৈরি করতেন।
এভাবে ধনঞ্জয়ের স্ত্রী, তিন ছেলে ও নাতি-নাতনি নিয়ে অভাবি সংসার ভালোই কাটছিল। হঠাৎ একদিন বাবার আধ্যাত্মিক মোহ জেগে ওঠে তার মনেও। এতে একদিন পরিবারের কাউকে না বলে সমাজ সংসারের দায়বদ্ধতা ভুলে নিরুদ্দেশ হয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যান তিনি। বিভিন্ন মন্দির, মসজিদসহ বন-জঙ্গলে কাটান দীর্ঘ আট বছর।
কিন্তু কি মনে করে আবার একদিন নতুন পরিচয় ‘ডাকো সাধু’ নামে স্ত্রী সন্তানের মায়ায় ফিরে আসেন সংসার জীবনে। পুনরায় শুরু করেন বাঁশের কাজ। তবে দীর্ঘদিন না থাকায় এবং সাধু হওয়ায় মানুষ তাকে কাজে ডাকতেন না। অফুরন্ত অবসর সময়ে ডাকো সাধু বাঁশ দিয়ে আগের সেই শখ বিভিন্ন শৈল্পিক জিনিসপত্র তৈরি শুরু করেন। তার ওই সব শৈল্পিক কারুকার্য দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়ে তাকে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করতে বলেন। কেউ সামান্য টাকা দিয়ে তা কিনে নেন। আবার অনেকে তৈরি করতে বলেও আর কিনে নেন না।
এভাবেই তার বাড়ি ভরে যায় জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য, মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, নৌকা, মাঝি, গাঁয়ের বধূ, মৎস্যকন্যা, বাঘ, হরিণ, কুমির ও পাখিসহ বিভিন্ন কারুকার্যময় জিনিসপত্রে। ভাঙা বাড়িতেই যত্রতত্র পড়ে থাকে এসব শৈল্পিক কাজ।
তার তৈরি এসব শিল্পকর্ম দেখতে এসে এলাকার জনপ্রতিনিধি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, এমপি, মন্ত্রীসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা তার বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন আশ্বাস দিলেও তা পূরণ করেনি কেউ কোনোদিন। তাই তো ডাকো সাধুর নিজের ঘরের বাঁশের বেড়া ঠিক করতে পারেননি কোনোদিন। ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি তার।
ডাকো সাধু বলেন, সেই ছোটবেলা থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বাঁশের কাজ করে যাচ্ছি। আমার তৈরি অনেক শিল্পকর্ম দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। কিন্তু আমার অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। পরিবারের কারো জন্য কিছু করতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, অনেক বড় বড় লোক আমার বাড়িতে এসে অনেক কিছু দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি, কেউ কিছু দেননি।
ডাকো সাধু বলেন, অর্থের অভাবে এখন নতুন কোনো জিনিস তৈরি করতে পারি না। কিছু আর্থিক সহায়তা পেলে আমি আরো অনেক কিছু তৈরি করতে পারতাম।
পলাশবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মমতাজ আলী প্রামানিক বলেন, ডাকো সাধুর হাতে তৈরি বাঁশের কারুকার্য আমি যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। তার তৈরি কারুকার্যময় জিনিসপত্র ঢাকায় অথবা বিদেশে প্রদর্শনী করলে ভালো দামে বিক্রি করা যাবে।
চেয়ারম্যান মমতাজ বলেন, কিছু আর্থিক সহায়তা ও সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ডাকো সাধু আরো অনেক কিছু তৈরি করতে পারবেন।
রাইজিংবিডি/নীলফামারী/৩ এপ্রিল ২০১৭/ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন/রিশিত
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন