ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

কার্ল মার্ক্স : অমর এক বিপ্লবী

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কার্ল মার্ক্স : অমর এক বিপ্লবী

রুহুল আমিন : মানুষ এক সঙ্গে নিজেকে এবং 'অন্যকে' ধারণ করবে৷ নিজের অস্তিত্ব একই সঙ্গে তার নিজের জন্য ও অন্যের জন্য হয়ে উঠবে৷ কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এমন একটা মানবিক সমন্বয় ঘটানোর চিন্তাই ছিল মার্ক্সের দর্শন।

আজ বিপ্লবী কার্ল মার্ক্সের জন্ম দিবস। ১৮১৮ সালের ৫ মে (প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চল ) ত্রিয়ের শহরে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কার্ল মার্ক্স। তার বাবা পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। আর্থিকভাবে কার্ল মার্ক্সের পরিবার স্বচ্ছল ও সংস্কৃতিবান ছিল। তবে বিপ্লবী ছিল না। কিন্তু কার্ল মার্ক্স নিজস্ব চিন্তা ও দর্শনের জন্য  পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন।

কার্ল মার্ক্স ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন। ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে তিনি স্নাতক করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়ার। কিন্তু তার বাবা-মা তাতে রাজি ছিল না। কিছুদিন পর তার বাবা তাকে বার্লিনের Humboldt-Universität এ বদলি করিয়ে দেন।

বার্লিনে থাকার সময় মার্ক্স জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন। তার কবিতা ও প্রবন্ধের ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক ভাষা। এ সময়ই তরুণ হেগেলিয়ানদের নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন মার্ক্স।

১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন মার্ক্স। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল "The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature" । মজার ব্যাপর হলো, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেননি। তিনি অভিসন্দর্ভটি ইউনিভার্সিটি অব জেনা-তে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান র‌্যাডিকেল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভালো ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপক হওয়ার বাসনায় মার্ক্স চলে গেলেন বন শহরে। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির কারণে একাডেমিক জীবনযাপনের ভাবনা ত্যাগ করতে হয় মার্ক্সের।

এ সময় বাম-হেগেলদের সংস্পর্শে আসারা জার্মানির কলোন শহরে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘রাইনিশ গ্যাজেট’ নামে সরকারবিরোধী এক পত্রিকা। পত্রিকাটি ১৮৪২ সালের ১ জানুয়ারি তাদের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত করে। মার্ক্সকে এই পত্রিকার লেখক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে তিনি এর প্রধান লেখকদের একজন হন। আর ১৮৪২ সালের অক্টোবরে মার্ক্স পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই সময় তিনি বন শহর থেকে কলোনে চলে আসেন।

মার্ক্সের সম্পাদনায় পত্রিকাটির বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক প্রবণতা উত্তরোত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। বাড়তে থাকে সরকারের নজরদারি। সরকার পত্রিকাটির ওপর প্রথমে দুই ও তিন দফা সেন্সরশিপ আরোপ করে। আর ১৮৪৩ সালের মার্চে পত্রিকাটির প্রকাশনা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগে সম্পাদকীয় দায়িত্ব থেকে মার্ক্স পদত্যাগ করে পত্রিকাটি বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

মার্ক্সের সাংবাদিকতার কর্মকাণ্ডই তার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে যে, তিনি রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত না। তাই তিনি রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র পড়তে লাগলেন। ১৮৪৩ সালে ক্রয়েজনাখ শহরে জেনিফন ওয়েস্ট ফালেনের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জেনিফান বাল্যকালের বন্ধু ছিল তার। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাদের বিয়ের কথা ছিল।

মার্ক্স প্যারিসে যান পত্রিকা প্রকাশের জন্য। যদিও তিনি ‘দৎসে-ফ্রানজ্শিশেইয়ার বুখার’ নামের পত্রিকার মাত্র একটি সংখ্যাই বের করেছিলেন। ১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস কয়েক দিনের জন্য প্যারিসে আসেন। এই সময় থেকেই  হয়ে এঙ্গেলস হয়ে ওঠেন মার্ক্সের  ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। প্যারিস তখন জার্মান, ব্রিটিশ, পোলিশ ও ইতালীয় বিপ্লবীদের সদর দপ্তর হয়ে উঠেছিল। প্যারিসের বিপ্লবী গ্রুপগুলোর তৎকালীন উত্তেজনায় ভরপুর জীবনে মার্ক্স এঙ্গেলস সর্বাপেক্ষা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তারা পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন মতবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সংগ্রাম চালিয়ে গড়ে তোলেন বৈপ্লবিক সর্বহারা সমাজতন্ত্রের বা সাম্যবাদের (মার্ক্সবাদের) তত্ত্ব ও রণকৌশল ।

১৮৪৫ সালে প্রুশীয় সরকারের পুনঃপুনঃ অনুরোধের মুখে বিপজ্জনক বিপ্লবী বলে প্যারিস থেকে বের করে দেওয়া হয় মার্ক্সকে। তখন তিনি চলে যান ব্রাসেলসে। ১৮৪৭ সালের বসন্তকালে কমিউনিস্টলীগ নামে অভিহিত এক গুপ্ত প্রচার সমিতিতে মার্ক্স ও এঙ্গেলস যোগ দেন।

১৮৪৭ নভেম্বরে লন্ডনে লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে তারা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এই কংগ্রেসের অনুরোধেই তারা রচনা করেন সুবিখ্যাত ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা প্রকাশিত হয় ।

কমিউনিস্ট ইশতেহারে উপস্থাপিত হয় এক নতুন বিশ্ববীক্ষা, সঙ্গতিপূর্ণ বস্তুবাদ, যা সমাজ জীবনের পরিমণ্ডলকেও অঙ্গীভূত করে; উপস্থাপিত হয় বিকাশের সর্বাপেক্ষা সহজবোধ্য ও সুগভীর মতবাদ হিসেবে দ্বন্দ্বতত্ত্ব; আর উপস্থাপিত হয় শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্ব, নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা–সর্বহারা শ্রেণির বিশ্ব-ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক ভূমিকার তত্ত্ব।

১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হওয়ায় বেলজিয়াম থেকে মার্ক্স নির্বাসিত হন। ফিরে আসেন প্যারিসে। সেখানে বিপ্লবের পর তিনি চলে আসেন জার্মানির কলোন শহরে। ১৮৪৮ সালের ১ জুন থেকে ১৮৪৯ সালের ১৯ মে পর্যন্ত ‘নয়া রাইনিশ গেজেট’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। মার্ক্স ছিলেন পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক।

আবার তিনি জার্মানি থেকে নির্বাসিত হন। প্রথমে যান প্যারিসে। ১৮৪৯ সালের ১৩ জুনের বিক্ষোভ শোভাযাত্রার ঘটনার পর সেখান থেকেও নির্বাসিত হন তিনি। তারপর চলে আসেন লন্ডনে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই তিনি বসবাস করেন।

নির্বাসিত হিসেবে তার জীবন ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। দারিদ্রের বোঝা মার্ক্স ও তার পরিবারকে কঠোরভাবে বহন করতে হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষ ও ষাটের দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনে মার্ক্স ফিরে আসেন রাজনৈতিক সক্রিয়তায়। ১৮৬৪ সালে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে। মার্ক্স ছিলেন এই সংগঠনের প্রাণ। এই সংগঠনে প্রচুর সময় ও  কঠিন পরিশ্রমের কারণে মার্ক্সের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। এ সময় তিনি কাজ করে চললেন রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে এবং পুঁজি গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণ করার জন্য। কিন্তু ভগ্ন-স্বাস্থ্য বাধ সাধলো পুঁজি গ্রন্থটি সমাপ্ত করতে।

১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর তার স্ত্রী মৃত্যু হয়। আর ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ লন্ডনে অবস্থানকালে নিজের আরামকেদারায় শান্তভাবে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কার্ল মার্ক্স। লন্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে স্ত্রীর কবরের পাশেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। মার্ক্স ও জেনি দম্পতির ছয় সন্তান ছিল। সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ লন্ডনে মারা যায়, যখন চরম দারিদ্রের মধ্যে পরিবারটি বসবাস করছিল।

মার্ক্স ও এঙ্গেলসের যৌথ সংগৃহীত রচনাবলির সংখ্যা মোট ৫০। মার্ক্সীয় বস্তুবাদ শেখায় যে একমাত্র বস্তুজগতেরই অস্তিত্ব আছে এবং আমাদের চেতনাও বস্তুজাত। তাই মন বা ভাবের অস্তিত্ব বস্তু ছাড়া সম্ভব নয়। এই বস্তু সদাই গতিশীল (এর ফলে বস্তুজাত জ্ঞানও গতিশীল)। পরবর্তীকালে এঙ্গেলস দেখান যে শুধু সমাজবিজ্ঞানেই নয়, মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বমূলক মতবাদ প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

মার্ক্স দেখিয়েছেন, মানব ইতিহাসের বিকাশে লুকিয়ে রাখা হয়েছে চরম এক সত্য। আর তা হলো বিজ্ঞান, কলা ধর্ম ইত্যাদির আগে মানুষের প্রথম প্রয়োজন খাদ্য, আশ্রয় ও পরিচ্ছদ। তবে মার্ক্সবাদের মধ্যে নৈতিকতার অবস্থান নিয়ে বিশ্লেষকরা প্রধানত দ্বিধাবিভক্ত৷ এক পক্ষ মনে করেন মার্ক্সবাদের মধ্যে কোনো নৈতিক অবস্থান নেই৷ অপরপক্ষ মনে করেন মার্ক্সবাদের অবশ্যই একটা নৈতিক ভিত্তি রয়েছে৷



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ মে ২০১৭/রুহুল/শামীম

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়