ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

জলে নিষেধাজ্ঞা, ডাঙায় করোনা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১৬ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জলে নিষেধাজ্ঞা, ডাঙায় করোনা

‘মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও দিনমজুরি করে চলে যাচ্ছিল। সামান্য সরকারি সাহায্য পাই। তা দিয়ে এ ক’টা দিন পার করতে পারলে, মে’র এক তারিখ থেকে আবার মাছ ধরতে পারবো। কিন্তু হঠাৎ কি যে হলো! কোনো কাজই করতে পারছি না। ঘরে বসে আছি; বলতে পারেন বন্দিজীবন।’ কথাগুলো বলছিলেন চাঁদপুরের চরভৈরবীর জেলে আবুল কাসেম। মোবাইলে কথা বলতে বলতেই তার গলার স্বর বারকয়েক কেঁপে উঠল। ৭ জনের সংসার। কীভাবে চালাবেন?

একই এলাকার শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. স্বপনের খবরও জানা যায় আবুল কাসেমের কাছে। হাতে ও পায়ে সমস্যার কারণে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা করেন স্বপন। নদীতে মাছ ধরতেও যেতে দেখেছি তাকে। বাড়তি রোজগারের জন্য স্বপনের একটা দোকান আছে চরভৈরবী লঞ্চঘাটে। মাছ ধরা আর দোকান তার জীবিকার অবলম্বন। স্বপনও নিরুপায়, রোজগারহীন- জানা গেল সে-কথাও।  

লক্ষ্মীপুরের লুধুয়ার মোখলেসুর রহমান, রামগতির মোকাম্মেল হোসেন, ভোলা সদরের তুলাতলীর শাহ আলম, চরফ্যাসনের ঢালচরের নুরুদ্দিন মাঝি, তৈয়ব মাঝি, পটুয়াখালীর চরকাজলের আবদুর রহমান- কয়জনের কথা বলবো? সকলেরই সর্বনাশ! রোজগার যখন একেবারেই শূন্যে, তখন তাদের জীবন চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। নদীর কাজও নেই। ডাঙার কাজও নেই। অনেকে আবার এটাকে ব্যাখ্যা করলেন এভাবে- ‘এখন আমাদের অবস্থা হইলো জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। না পারি নদীতে যাইতে, না পারি শহরে কাজে যাইতে।’  
 

আবুল কাসেম

 

ইলিশের জাটকা মৌসুমে এখন মাছ ধরা নিষেধ! নদীতে জাল ফেলায় নিষেধাজ্ঞা এক মাসের বেশি সময় ধরে। পহেলা মার্চ থেকে উপকূলের কয়েক লাখ জেলে কর্মহীন। তাদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও তা পৌঁছায় না সকলের কাছে। যে পরিমাণ জেলে আছে, সে পরিমাণ বরাদ্দ নেই। আবার বরাদ্দ বন্টনে অনিয়মের ঘটনা তো আছেই। এসব নানা কারণে উপকূলের জেলেদের একটি বড় অংশ নিষিদ্ধ সময় কর্মহীন থাকে। জীবিকার তাগিদে অনেকে বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত হয়। অনেকে শহরে যায়। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। অনেকে কাজে গিয়েছিলেন, আবার অনেকে কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; এ সময়েই এলো করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক। সেই সঙ্গে সরকারি নিষেধাজ্ঞা।

ঢালচরের নুরুদ্দিন মাঝি বলেন, ‘এই সময়টা আমাদের জন্য খুব খারাপ সময়। আমরা তো মাছ ধরে খাই। মাছ ধরা বন্ধ থাকলে আমাদের খুবই সমস্যা হয়। এখন তো একেবারে গৃহবন্দি হইয়া গেলাম।’ লুধুয়ার মোখলেসুর রহমানেরও একই কথা। বললেন, ‘অন্যান্য বছর এ সময় তাও কোনোমতে পার করেছি। এ বছর কীভাবে কাটবে জানি না।’

করোনা নিষেধাজ্ঞায় সবকিছু বন্ধ থাকলেও প্রাকৃতিক বিপদ উপকূলের মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। চৈত্রের পূর্ণিমার জো’র (জোয়ার) প্রভাবে অনেক এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোতে নদীর পানি বাড়লেই আতঙ্ক বেড়ে যায়। গত ৮ এপ্রিল কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়ায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে জোয়ারের পানি। বরাবরের মতোই সেই বাঁধ ঠিক করে নিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রম। কিন্তু শঙ্কা রয়েই গেছে।
 

মোখলেসুর রহমান

 

স্থানীয় বাসিন্দা বিপ্লব চন্দ্র রায় বলছিলেন, ‘কপোতাক্ষ নদের পানি বাড়লেই আমাদের আতঙ্ক বাড়ে। বর্ষার পুরো সময় আমরা ঝুঁকিতে থাকি। সরু বেড়িবাঁধ। অনেক জায়গা খুবই নাজুক। পানি একটু চাপ দিলেই বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। গ্রামবাসী বহুবার এ বাঁধ নিজেরাই মেরামত করেছে। তারওপর এই করোনা আতঙ্ক।’ সূত্র বলছে, কয়রা উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২১ কিলোমিটার ঝুঁকিতে। এর মধ্যে আবার ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ এই বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লোনা পানি ঢুকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম আব্দুল্যাহ আল মামুন লাভলু। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু না করলে বর্ষায় বিপদ বাড়তে পারে।

এই করোনা সংকটের মাঝেই উপকূলের আরেক বিপদাপন্ন জেলা সাতক্ষীরার আশাশুনির বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকেছে গ্রামে। উপজেলার খোলপেটুয়া নদীর প্রায় দেড়’শ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে উপজেলার প্রতাপনগরের কোলা গ্রামের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়। এখানে স্থানীয় বাসিন্দারা বিপদ থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করেছেন। প্রতিনিয়ত বিপদের মধ্যে থাকা উপকূলের এসব মানুষের কাছে করোনা এসেছে আরেক বড় দুর্যোগ হয়ে।   

করোনার নিষেধাজ্ঞা মানে না উপকূলের নদী ভাঙন। বিভিন্ন এলাকা ক্রমাগত ভেঙে চলেছে। দুর্যোগ মৌসুম আসতে না আসতেই ভাঙনের মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের লুধুয়া গ্রামের বাসিন্দা কামরুল মীর বলছিলেন, মেঘনা বর্ষা আর শুকনা বোঝে না। ক্রমাগত ভাঙতেই থাকে। আমরা নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছি। আর কত! এখন কোথায় যাবো? এর মধ্যে করোনার আতঙ্ক আমাদের মাথায় বাড়তি বোঝা নিয়ে এসেছে। উপকূলের মানুষের সংকটটা সরকারের ভিন্নভাবে ভাবা উচিত।

নদীর ভাঙনের প্রবল গ্রাস ভোলার চরফ্যাসনের ঢালচরে। ভাঙনের গর্জনে সেখানকার মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। সেই ঢালচরের মানুষের এখন কী অবস্থা? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়ি সরিয়ে এপারে আনা অতি জরুরি হওয়া সত্ত্বেও অনেকে আনতে পারছেন না। করোনার কারণে ঢালচর লকডাউন। চলাফেরা বন্ধ। কিন্তু সেখানকার মানুষের যে ঘরবন্দি হয়ে থাকার সুযোগ নেই। কেননা, অনেকের ঘরই নেই। তারা কোথায় ঘরবন্দি থাকবে!

শুধু কর্মহীন সময় বলে কথা নয়, বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে উপকূলের মানুষের হাতে এখন অনেক কাজ। প্রাকৃতিক বিপদ থেকে বাঁচতে ঘরদোর মেরামত করার কাজ তারা এ সময়ই করে। ঘরের চালা বদল করা, বেড়া লাগানো, পানির প্রবাহ ঠেকাতে ঘরের আশপাশে মাটি ফেলা, অনেক কাজ। এই কাজগুলোর সঙ্গে আবার আর্থিক বিষয়টিও জড়িত। ঢালচরের নীরব গাজী এ প্রসঙ্গে বলেন, যেখানে তিনবেলা খাবারের যোগাড় করাই কঠিন, সেখানে দুর্যোগ মৌসুমের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ কোথায়? আমরা কীভাবে আছি সে খোঁজ কি রাখে সরকার?



লক্ষ্মীপুর/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়