ডেরেক ওয়ালকট ও তার কবিতা
ডেরেক ওয়ালকট (১৯৩০-২০১৭)
|| মুম রহমান ||
সেন্ট লুসিয়া, ছোট্ট একটি দ্বীপ। ক্যারেবিয় দ্বীপপুঞ্জের ভিড়ে একে আলাদা করে খোঁজাও মুশকিল। ডেরেক ওয়ালকট না-জন্মালে মানচিত্রে কেউ এই দ্বীপ খুঁজতো কি-না সন্দেহ করাই যায়। প্রায় গুরুত্বহীন ব্রিটিশ উপনিবেশের অধিনস্ত এই দ্বীপ আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এলেন ডেরেক ওয়ালকট ১৯৯২ সালে। সে বছর তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী নতুন করে তাকালো অচেনা এই দ্বীপের দিকে। আর বিশ্ববাসী নতুন করে আবিষ্কার করলো বিশ্ব কবিতার এক নতুন সম্রাটকে। একই সঙ্গে চিত্রকর, নাট্যকার এবং সর্বোপরি কবি ডেরেক ওয়ালকট তার প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে ক্যারেবীয় অঞ্চল, ঔপনিবেশিক যন্ত্রণা, কৃষাঙ্গের প্রতিবাদ তুলে ধরলেন নতুন ভাষা আর ভঙ্গিতে।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্থানীয় খবরের কাগজে তার প্রথম কবিতা ‘১৯৪৪’ ছাপা হয়। ৪৪ লাইনে মুক্তছন্দে লেখা এই কবিতা। ১৯ বছর বয়সে নিজেই প্রকাশ করেন ‘২৫টি কবিতা’ শিরোনামে বই। ২০০ ডলার খরচ করে ছাপা এই বই তিনি রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করতেন। জ্যামাইকার ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করে তিনি ত্রিনিদাদ চলে যান। সেখানে ‘ত্রিনিদাদ থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। নাট্য ও চিত্র সমালোচক হিসাবে কাজের পাশাপাশি তার কবিতা লেখা চলতে থাকে। তবে সাফল্য আসে আরো পরে, ৩২ বছর বয়সে। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘ইন আ গ্রিন নাইট: পোয়েমস’। বইটি তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এখানে ক্যারিবিয়ান ইতিহাস, ঐতিহ্যের পাশাপাশি ঔপনিবেশিকতার ক্ষত উঠে আসে।
কবিতার পাশাপাশি তিনি ত্রিনিদাদ থিয়েটারের জন্য প্রায় ২৫টি নাটক রচনা করেছেন। ছবিও এঁকে গেছেন অকাতরে। তার ‘ওমেরোস’ (১৯৯০) মহাকাব্য হোমার দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও ক্যারেবিয় সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক। এই বই তার অন্যতম সেরা একটি কাজ। বছরের সেরা বইয়ের স্বীকৃতি ছাড়াও আধুনিক মহাকাব্যের ইতিহাসে বইটি তাকে ঠাঁই করে দেয়। ২০১১ সালে তিনি ‘হুয়াইট ইগ্রেটস’ কাব্যগ্রন্থের জন্য টিএস এলিয়ট পুরস্কার পান। গত ১৭ মার্চ, ২০১৭ তারিখে তিনি সেন্ট লুসিয়া দ্বীপে নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করেন।
টোবাগো, মধ্যগ্রীষ্ম
বিস্তীর্ণ সূর্যস্তব্ধ সৈকত
সাদা উত্তাপ
একটি সবুজ নদী
একটি সেতু,
দগ্ধ হলুদ পামগুলি
গ্রীষ্ম-ঘুমের বাড়ি থেকে
আগস্টে নিদ্রাতুর।
আমার যে ছিলো,
আমার যে দিন হারিয়ে গেলো,
বেড়ে ওঠে দিনগুলি, কন্যার মতো
আমার প্রসারিত হাত।
প্রেমের পরে প্রেম
সময়টি আসবে
যখন, উল্লাসে
তুমি নিজের আগমনকেই অভিবাদন জানাবে
তোমার নিজেরই দরজায়, তোমার নিজেরই আয়নায়
আর প্রত্যেকেই হাসবে একে অন্যকে স্বাগত জানিয়ে,
আর বলবে, বসো এখানে, খাও।
তুমি আবার সেই অচেনাকে ভালবাসবে যে-ছিলো তোমারই সত্তা।
দাও সুরা। দাও রুটি। ফিরিয়ে দাও তোমার হৃদয়
তার কাছেই, সেই অচেনাকে যে তোমাকে ভালবেসেছিলো
তোমার সারাটা জীবন, যাকে তুমি উপেক্ষা করেছো
অন্য কারো জন্য, যে তোমাকে হৃদয় দিয়ে জানতো
বইয়ের তাক থেকে সেই সব প্রেমের চিঠি নামাও,
সেই সব ছবি, সেই সব বেপরোয়া চিরকুট
তোমার নিজের ছবি আয়না থেকে ছিঁড়ে ফেলো।
বসো। উপভোগ করো তোমার জীবন।
আফ্রিকা থেকে সুদূর পরাহত কান্না
একটা বাতাস এলেমেলো করে দেয় তামাটে পশুকে
আফ্রিকার, কিকুয়া, মাছির মতো দ্রুত ধাবমান
রক্তপ্রবাহের উপর ভেসে যায় তৃণভূমি।
শবদেহগুলো ছড়িয়ে আছে স্বর্গের চারিধারে।
একমাত্র পোকা, সেনাপতির গলিত মাংস, কাঁদে;
‘এই সব পৃথক মৃত্যুর জন্য কোন সমবেদনা খরচ করো না!’
পরিসংখ্যান ন্যায্য করে আর জ্ঞানীরা আয়ত্ব করে
এই বিক্ষিপ্ত ভূখণ্ডের ঔপনিবেশিক নীতি।
বিছানায় ক্ষত-বিক্ষত শিশুটির কী মানে?
অসভ্যের কাছে, ইহুদির মতো খরচ করে ফেলা?
আঘাতে আঘাতে ছিন্ন করে ফেলা, দীর্ঘ পলায়নে বিরতি
শ্বেত ধুলায় মাখা সারসের কান্না
আটকে যায় চাকায় সভ্যতার সেই উষালগ্ন থেকে
দগ্ধ নদীতে কিংবা পরিপূর্ণ-পশুর সমতলে।
পশুর উপর পশুর সহিংসতা রক্তিম
ঠিক প্রাকৃতিক নিয়মের মতো, কিন্তু উঁচুতলার মানুষ
বেদনা আরোপ করে নিজের দেবত্ব খোঁজে।
এইসব শঙ্কিত পশুর মতো বিকারগ্রস্ত, তার যুদ্ধ
আটোসাটো পশুর চামরার ড্রামের তালে নাচে,
যখন সে সাহসকে আহ্বান করে স্থানীয় শঙ্কায়
মৃতদের দ্বারা চুক্তি করা শ্বেত শান্তির।
আবার পাশবিক প্রয়োজনীয় নিজের হাত মোছে
কোন নোংরা কারণের ন্যাকড়ায়, আবার
আমাদের সমবেদনার অপচয়,
যেনবা স্পেনীয়দের সাথে,
গরিলা কুস্তি করে সুপারম্যানের সাখে।
আমি যে কিনা উভয় রক্ত দ্বারা দূষিত,
আমি কোন দিকে যাবো, নিজের ধমনীকে আলাদা করবো?
আমি অভিশাপ দিয়ে যাই
ব্রিটিশ রাজের মাতাল অফিসার,
কীভাবে বেছে নেবো
আফ্রিকা আর ইংরেজির মাঝে আমার ভালবাসার ভাষা?
তাদের দুজনকেই প্রতারিত করবো, নাকি যা তারা দিয়েছে তা ফিরিয়ে দেবো?
কী করে আমি এই হত্যাযজ্ঞের মুখোমুখি হবো এবং শান্ত থাকবো?
কী করে আমি আফ্রিকা থেকে মুখ ঘুরাবো এবং বেঁচে থাকবো?
অনুবাদকের কথা : ডেরেকে ওয়ালকটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘আ ফার ক্রাই ফ্রম আফ্রিকা’ ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়। তখন তার দেশে নৃগোষ্ঠীদের ভয়াবহ সংঘাত চলছে। পঞ্চাশের দশকে ককুয়া নৃগোষ্ঠীর একটি প্রতিবাদী দল মাউ মাউ-এর সাথে ইউরোপীয় ও শেতাঙ্গ অধিবাসীদের রক্ত সংঘাতময় সংহিসতার চিত্র উঠে এসেছে এ কবিতায়। বিশ শতকের গোড়া থেকে শ্বেতাঙ্গরা চেষ্টা করছিলো কিকুয়াদের তাদের স্বভূমি থেকে উৎখাতের। এই কিকুয়ারাই পরবর্তীতে স্বাধীন কেনিয়ার জন্ম দেয়। কবি এই চলমান সংঘাতের সাথে নিজের ব্যক্তি সংঘাতকে মিশিয়েছেন। ওয়ালকটের রক্তে আফ্রিকা ও ইউরোপের ধারা প্রবাহমান। তার পিতামহ শেতাঙ্গ আর মাতামহ কৃষাঙ্গ ছিলেন। অন্যদিকে কবির জন্মস্থান সেন্ট লুসিয়া তখন ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ। তিনি একদিকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে, শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে কিকুয়া নৃগোষ্ঠীর মাউ মাউ দলের নৃশংসতারও বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রথম দুই স্তবকে কেনিয়ানদের সংঘাত উঠে এসেছে অন্যদিকে পরের দুই স্তবকে যুদ্ধটা তার নিজে মধ্যেও দেখা গেছে। উদার মানবতাবাদী ডেরেক ওয়ালকট, অন্যদিকে যুদ্ধ-রক্তপাত বিরোধী, আবার নিজের আত্ম পরিচয় ও ভাষার সংকট- সব মিলিয়ে এই কবিতা যেন আফ্রিকার ভাষা, রাজনীতি, কৃষাঙ্গ-শেতাঙ্গ সম্পর্কের এক জটিল সমীকরণ।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মার্চ ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন