ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

তারানায় রেখে গেছেন সুরের তাড়না

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ২৭ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তারানায় রেখে গেছেন সুরের তাড়না

বিদুষী গিরিজা দেবী

খান মো. শাহনেওয়াজ : স্বতন্ত্র একটি তারানা, যার গ্রহ বা ধরতি বোল- না দের দের তুম দের দের তুম দের দের তা না দ্রিম দ্রিম তা না না দে রে তাদিয়ানা রে...। কেদার রাগে সম্পূর্ণ এই তারানার গৎ যখন বিদুষী গিরিজা দেবীর কণ্ঠে খেলে গেছে তখন পিনপতন নিরবতায় শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে গেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম দিকপাল ড. গিরিজা দেবীর কণ্ঠে এমন তারানা কিংবা ঠুমরি, টপ্পা ও খেয়াল মঞ্চের সামনে বসে সরাসরি আর শোনা যাবে না। তিনি চলে গেছেন সংগীতের বিশাল অঙ্গন ছেড়ে, চিরতরে।

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে বেড়ে উঠেছেন গিরিজা দেবী। ১৯২৯ সালের ৮ মে ঐতিহ্যবাহী এক হিন্দু ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারে তার জন্ম। দুবছর বয়সে বাবা-মায়ের সাথে তিনি আসেন বারানসি শহরে। তাকে নিয়ে তার বাবা-মা এই শহরেই বসবাস শুরু করেন। উত্তর প্রদেশের অত্যন্ত পুরোনো শহর বারানসি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে অতি পরিচিত। বারানসি শহর কাশি এমনকি বেনারস নামেও পরিচিত। গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত বারানসি সংগীত ও শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত। গিরিজা দেবীর বাবা-মা দুজনেই ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী। বাবা রামদেও রাই ছিলেন উঁচু মাপের একজন কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রী। তিনি ছিলেন সঙ্গীতের শিক্ষক এবং একজন দক্ষ হারমোনিয়াম বাদক। গিরিজা দেবীর সংগীতে হাতে খড়ি হয় একেবারে শিশু বয়সে বাবার কাছে।

সংগীত শিক্ষক বাবা শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন গিরিজার সংগীত মেধার বিষয়টি। তিনি গিরিজার সংগীত চর্চার প্রতি যত্ন নিতে শুরু করেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়েই তাকে ওস্তাদের তত্বাবধানে দেন। বাবার হাত ধরে শিশু বয়সেই গিরিজা তার গুরুর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম পান। ধীরে ধীরে তিনি বেড়ে ওঠেন বেনারস ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীতকে ধারণ করে।

গিরিজা দেবীর বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সে বারানসির এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারে। তার ব্যবসায়ী স্বামী শ্রী মধুসুদন জৈন নিজেও ছিলেন সংগীত প্রেমী ও কাব্য রসিক। তিনি গিরিজাকে সংগীত চর্চা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেন। স্বামীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় গিরিজা শাস্ত্রীয় সংগীতের পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন।  

গিরিজা দেবী খেয়াল, ঠুমরি ও টপ্পা গায়নে তালিম নিয়েছেন তৎকালীন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সারেঙ্গীবাদক পণ্ডিত সরজু প্রসাদ মিশ্রের কাছে। বেনারস ঘরানার সংগীতঙ্গ সরজু প্রসাদ মিশ্রের সুযোগ্য শিষ্যা হিসেবে সুর শিক্ষা লাভ করেছেন গিরিজা দেবী। সুর প্রবাহের ওপর তার কান ও কণ্ঠ পোক্তভাবেই তৈরি হয়ে যায় এই ওস্তাদের কাছে। ওস্তাদজীর মৃত্যুর পর তিনি ওস্তাদ শ্রীচাঁদ মিশ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার কাছে তালিম নেন। ওস্তাদ শ্রীচাঁদ মিশ্রের কাছে তার গায়কী আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। এখানে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারা ও বহু বিন্যাসের পরিচয় পান। ওস্তাদ শ্রীচাঁদ মিশ্র ছিলেন মিয়া তানসেনের গায়কীর উত্তরাধিকার সেনিয়া ঘরানার সংগীতঙ্গ যার সুরের ধারায় ছিলো জয়পুরী অনুশাসন। গিরিজা দেবী বেনারস ঘরানার গায়কীতে সমৃদ্ধ হলেও তার মাঝে প্রবাহমান ছিলো জয়পুরী সেনিয়া ঘরানার গায়কী।

তিনি খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা, সাদরা, তারানা ছাড়াও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারার সুরের চলন ও বলন রপ্ত করেছেন। ভজন, পাঞ্জাবী টপ্পা, মীরাবাঈয়ের ভজন, সুরদাসের ভজন এমনকি বেনারস ঘরানার সনাতন ও ঐতিহ্যবাহী গীত ঝুলা বা হিন্দোলাও কণ্ঠে ধারণ করেছেন।

বারানসি হিন্দু তীর্থস্থান হওয়ায় প্রাচীন কাল থেকেই সংগীত সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা ছিলো বহমান। উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আঞ্চলিক সংগীতের প্রায় সবই বেনারস ঘরানার শাস্ত্রীয় প্রলেপযুক্ত (সেমি ক্লাসিক্যাল)। গিরিজা দেবী তার গায়নে নিজের শেকড়ের সন্ধান করেছেন, উত্তর প্রদেশে রাজ্যের আঞ্চলিক সংগীতকে আরো সমৃদ্ধ করে নিজের মাঝে ধারণ করেছেন, যা তাকে সংগীত জগতে অমরত্ব এনে দিয়েছে।

হরি, চৈতী, কাজরি ও বারমাস (বারাহমাসা) নামে উত্তর প্রদেশের আঞ্চলিক রাগাশ্রয়ী গান ছাড়াও কিছু লোকগান ধ্রুপদী আঙ্গিকে রূপায়ন ও পরিবেশন করে সংগীতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তিনি যেখানেই গেছেন সেখানেই স্থানীয় কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীদের সহচর্য পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের কাছে অপরিচিত বা বিরল শাস্ত্রীয় গীত সন্ধান করেছেন এবং তা পেলে সংগ্রহে নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে সেগুলো খুব যত্ন সহকারে পরিবেশনও করেছেন। বিভিন্ন রাগাশ্রয়ী অপরিচিত গীত তার ঝুলিতে থাকায় তিনি সবসময় সংশ্লিষ্ট সকলের মনোযোগের কেন্দ্রে অবস্থান করতেন।

শাস্ত্রীয় সংগীতের সব ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট ও উচ্চ দখল থাকলেও ঠুমরি গায়নে তার বিশেষত্ব ছিলো অসাধারণ। তাকে বলা হয় ঠুমরির রানী। দাদরা, টপ্পা ও ঝুলায় (হিন্দোলা) তার গায়কী ছিলো স্বচ্ছ, দরাজ। তারানায় ছিলো স্বতন্ত্র গতকারি। তারানা পরিবেশনে তিনি সুনিয়ন্ত্রিত ও ললিত সুরপ্রবাহে হালকা মেজাজ ধরে সপাট বা শুদ্ধ তান, মিশ্র তান, বোল ও গমক এমনকি কূট তান করে যেতেন। তারানায় তিনি রেখে গেছেন সুরের তাড়না।

সংগীতে অসাধারণ অবদানের জন্য এই কণ্ঠশিল্পী ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়াও পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফরমিং আর্ট ফ্যাকাল্টিতে সংগীত বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। কলকাতায় আইটিসি মিউজিক রিসার্চ একাডেমির ফেকাল্টি মেম্বার ছিলেন। শাস্ত্রীয় সংগীতের অনেক গুণী শিল্পীই তার শিষ্য। তার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক।

২০১৫ সালের আগস্টে ভারতের মুম্বাইয়ে নেহরু সেন্টারে আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সংঙ্গীতের এক অনুষ্ঠানে বিদুষী গিরিজা দেবী, নৃত্যপটু পণ্ডিত বিরজু মহারাজ ও কণ্ঠশিল্পী বিদুষী অনুরাধা পাল এক অসাধারণ ত্রিগালবন্দী পরিবেশন করেন। মধ্য লয়ের কাহারবা তালে গিরিজা দেবী ও অনুরাধা পাল কণ্ঠে ছড়ান ঠুমরি। এই দুজনের গীতের সাথে নাচের মূদ্রা যোগ করেন বিরজু মহারাজ। মজার ব্যাপার যে, বিরজু মহারাজ স্টেজে এই দুই কণ্ঠশিল্পীর পাশে বসে থেকে নৃত্যমূদ্রা পরিবেশন করেছেন। এই ত্রিগালবন্দীর বন্দনায় ছিলেন গিরিজা দেবী।

বাংলাদেশে তার অনেক ভক্ত রয়েছে। তিনি ঢাকায় শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবে তিন বার যোগ দিয়েছেন এবং সংগীত পরিবেশন করে আসরে উপস্থিত সুর পিপাসুদের মন ভরিয়ে দিয়ে গেছেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে ঢাকায় আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে যোগ দেয়ার পর তিনি সংগীত থেকে অবসর নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বয়স ৮৮ বছর হলেও সংগীত তাকে অবসর দেয়নি। দিল্লির কামানি অডিটরিয়ামে ২৫ অক্টোবর ২০১৭ তরিখে শুরু হওয়া পাঁচ দিনব্যাপী উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবে তার কণ্ঠ পরিবেশনা নির্ধারিত ছিলো। কিন্তু সেই নির্ধারিত তারিখের তিন দিন আগে ২৪ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

আজ তিনি নেই; চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। কিন্তু যে সুর তিনি ছড়িয়ে রেখে গেছেন তা শাস্ত্রীয় সংগীতকে দিনে দিনে আরো সমৃদ্ধ করবে।


বিদুষী গিরিজা দেবীর কণ্ঠে কেদার রাগে তারানা




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ অক্টোবর ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়