ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ইতিবাচক ইমেজে আশার সঞ্চার

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ইতিবাচক ইমেজে আশার সঞ্চার

দুর্নীতি প্রতিরোধকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে অভিযানের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ২০১৯ সালে বেড়েছে মামলা ও অনুসন্ধানের সংখ্যা। বিশেষ করে ক্যাসিনোকাণ্ড, ফরিদপুর পর্দাকাণ্ডসহ হাসপাতালের দুর্নীতি কিংবা রূপপুর বালিশকাণ্ডসহ আলোচিত বিষয়গুলোর অনুসন্ধান ও মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ইমেজে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।

জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে অভিযান জোরদার করা, দুর্নীতির উৎস বন্ধে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশ বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগ  ও ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরাসহ প্রতিরোধের বিভিন্ন কাজে সারা বছরই অধিক মনোযোগী ছিল সংস্থাটি। তবে মুক্তি মেলেনি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হয়রানি করার অভিযোগ থেকে।

২০১৬ সালের ১৪ মার্চ কমিশনের পঞ্চম চেয়ারম্যান হিসেবে ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব নিয়ে পার করেছেন সাড়ে তিন বছরের বেশি সময়। বছরব্যাপী দুদকের কার্যক্রম প্রসঙ্গে রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আমি এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়েছি সাড়ে তিন বছর। এ সময়ে   দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আমাদের একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতা লাগবে। আমার মূল্যায়ন হচ্ছে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও সার্বিকভাবে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি।’

ক্যাসিনোসহ অবৈধকাণ্ডে অভিযান:

ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের সাড়াশি অভিযান বছরজুড়ে ছিল আলোচিত। যুবলীগ দক্ষিণের  বহিস্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ বর্তমান জাতীয় সংসদের চার সদস্য, গণপূর্তের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত ১৮৭ জনের তালিকা নিয়ে চলছে সংস্থাটির অনুসন্ধান। গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর অভিযানের ধারাবাহিকতায় ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনোর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৮টি মামলা দায়ের করে দুদক। যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তারা হলেন- ঠিকাদার জি কে শামীম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূইয়া, কলাবাগান ক্লাবে সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন, কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমি রহমান। সর্বশেষ যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনের স্ত্রী আয়েশা আক্তার সুমা ওরফে সোমা, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র শাখা প্রধান মুমিতুর রহমান ও এক ব্যবসায়ী সাহেদুল হকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবালের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি টিম অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

পর্দাকাণ্ড ও বালিশকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন:

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ফরিদপুর  হাসপাতালের পর্দাকাণ্ড ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশকাণ্ড। এরই মধ্যে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আলোচিত পর্দাসহ ১৬৬ চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি। কক্সবাজার, ফরিদপুর, সাতক্ষিরা ও রংপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও ওষুধক্রয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাটে এ পর্যন্ত ৯টি মামলা দায়ের হয়। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফার্নিচারসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী কেনাকাটায়  লুটপাটের ঘটনায় গণপূর্তের ১১ প্রকৌশলী ও ২ ঠিকাদারসহ ১৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে। আসছে আরো মামলা।

অভিযানে সক্রিয় সারা বছর:

যেখানে প্রতারণা, জালিয়াতি, সরকারি সম্পদ আত্মসাতসহ বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনা সেখানেই অভিযান- এ লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে কমিশন এনফোর্সমেন্ট সেলের কার্যক্রম শুরু হয়। গঠিত হয় আলাদা এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিদিন চলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক।

কর্মদিন কিংবা সরকারি ছুটির দিন সব সময় চলে অভিযান। বিআরটিএ, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, বিদ্যুৎভবন, পল্লী বিদ্যুৎ, বিমানবন্দর, জেলখানা, সিভিল সার্জন, ওয়াসা, হজ এজেন্সি, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), শিক্ষা ভবন, বিভিন্ন হাসপাতাল, সিএজি, বিএসটিআই, ‍ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলেছে কয়েকশত অভিযান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সংস্থাটি ৯৮০টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে গ্রেপ্তার হয় ৭৬ জন। অভিযানের পর অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ১০৩টি অনুসন্ধান শুরু হয়। এর মধ্যে ইতোমধ্যে ৬টি মামলা দায়ের হয়।

হটলাইনে যত প্রত্যাশা:

যখনই দুর্নীতির ঘটনা, তখনই অভিযোগ এমন স্লোগানে ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে দুদক হটলাইন-১০৬। টোল ফ্রি এ অভিযোগকেন্দ্র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর অভিযোগকারীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। নভেম্বর পর্যন্ত ৩৩ লাখের বেশি ফোনকলে এসেছে বিভিন্ন অভিযোগ। আর ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ফোনকলের সংখ্যা ৯৬ হাজার ৩১৪টি। যেখান থেকে ১০৩টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়, আর ৮২৫টি অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে সংস্থা।

বেড়েছে অভিযোগ, অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিট:

২০১৮ সালের তুলনায় এ বছর অভিযোগ, মামলা ও চার্জশিটের সংখ্যা তুলনামূলক বেড়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ৮৭৬টি। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ২২ হাজার ১০৩টির মতো অভিযোগ জমা হয়। ২০১৮ সালের একই সময়ে অভিযোগ জমা হয়েছিল ১২ হাজার ২২৭টি। অন্যদিকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুদকে মামলা ও আদালতে চার্জশিট দাখিল হয় যথাক্রমে ৩১৯টি ও ২৯৮টি। যেখানে ২০১৮ সালের মামলা ও চার্জশিট দাখিল হয় ২১৬টি ও ২৩৬টি। অর্থাৎ মামলা ও চার্জশিট বেড়েছে যথাক্রমে ১০৩টি ও ৬২টি। একই সাথে কমেছে চলতি বছরে কমেছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল (এফআরটি) বা আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া মামলার সংখ্যা কমেছে। নভেম্বর পর‌্যন্ত এফআরটির সংখ্যা ৮৪টি। যেখানে ২০১৮ সালে ১৩৭টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। দুদকের দাবি অনুযায়ী কমেছে পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তির সংখ্যা। ২০১৮ সালের ৩২৭টি অনুসন্ধান পরিসমাপ্তি করা হয়।

বাড়ছে ফাঁদ মামলা ও গ্রেপ্তার:

২০১৮ সালে ফাঁদের মাধ্যমে ঘুষখোর আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা কমলেও ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বেড়েছে। চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর পর‌্যন্ত ফাঁদের মাধ্যমে ঘুষসহ গ্রেপ্তার হয় ২২ জন। যেখানে ২০১৮ সালে ফাঁদ পেতে ১৫ জন ও ২০১৭ সালে ২৪ জন সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা পর্যায়ের ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে সংস্থাটির বিভিন্ন টিম। এছাড়া বছর জুড়ে চলেছে কম-বেশি দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমনে শুদ্ধি অভিযান।

নিজ দপ্তরে মামলার সুযোগ:

এতদিন দুর্নীতির যেকোনো মামলা থানায় দায়ের করতো সংস্থাটি। চলতি বছরের ২৩ জুনের পর থেকে নিজ দপ্তরে মামলা দায়ের, সরাসরি বিশেষ জজ আদালতে চার্জশিট দাখিল এবং ব্যাংক হিসাব ও কর নথি সংগ্রহে বাড়তি ক্ষমতাসহ বেশ কয়েকটি নতুন বিধানে দুদকের কার্যক্রমে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে। রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে সংশোধিত বিধিমালায় স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেব দুদককে আরো শক্তিশালী করেছে।

অটুট সাজার হার:

২০১৯ সালে কমিশনে ও ব্যুরো আমলের সকল মামলায় সাজার হার দাঁড়িয়েছে ৬৩ শতাংশ। যেখানে ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৬৩ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ। সাজার হার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে বলে দুদক দাবি করেছে। যদিও দুদকের তথ্যানুসারে ২০১৭ সালে কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজার হার ছিল ৬৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে সেই হার ৫৪ এবং ২০১৫ সালে ৩৭ শতাংশ।

এছাড়া কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পৃথক গোয়েন্দা ইউনিট গঠন, গবেষণা সেল, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠনসহ দুদকের আওতা বৃদ্ধি করতে ১০৭৩ জন নতুন জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়াসহ বেশকিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়াকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

ঢাকা/এম এ রহমান/সাইফ/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়