ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু আর একটিও নয়

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু আর একটিও নয়

রুহুল আমিন : গত বৃহস্পতিবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বেশির ভাগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে। আর দু’একটি আছে এ প্লাস না পেয়ে।

স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া শিক্ষার্থীরা হলো শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার শামীম খান, পিরোজপুরের পরী আক্তার, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের শামীম মণ্ডল ও সুমনা আক্তার, ফেনীর ফুলগাজীর দক্ষিণ বরইয়া গ্রামের তাহমিনা আক্তার ও একই জেলার সোনাগাজী উপজেলার সুলাখালী গ্রামের জেসি আক্তার, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার শারমিন আক্তার, চট্টগ্রাম নগরীর বাটালী রোডের সোহরাব হোসেন,  রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মো. দীপু, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার আরিফা বেগম ও একই জেলার সদর উপজেলার হৃদয় বিশ্বাস। এদিকে জামালপুরে নিহত শিক্ষার্থী শারমিন আক্তারকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তার এক অন্তঃসত্ত্বা খালা। এ ছাড়া রাজশাহীর বাঘায় বৃষ্টি খাতুন নামের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর চেষ্টা চালায়। পরিবারের তৎপরতায় মৃত্যুর হাত থেকে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়।

পরীক্ষায় ফেল করে স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা প্রতিবছরই ঘটছে। ফল প্রকাশের পর প্রত্যাশানুযায়ী ফল না পাওয়ায় এবং অকৃতকার্য হয়ে এই স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ফল প্রকাশের পর আশানুরূপ ফল না পেয়ে রাগে, ক্ষোভে ও লজ্জায় এই ধরনের আত্মঘাতী কাজ করে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের দুর্ব্যবহার, মানসিক দুর্বলতা ও হতাশা শিক্ষার্থীদেরকে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় । তবে সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে পরিবারের অসহযোগিতামূলক আচরণ। একজন শিক্ষার্থী যখন পরীক্ষায় ফেল করে স্বভাবতই সে লজ্জায় তার বন্ধু-বান্ধব বা সহপাঠীদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। অল্প সময়ের জন্য হলেও সহপাঠীদের সঙ্গে একটু দূরত্ব তৈরি হয়। এমনকি পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়।

ঠিক এই সময়টাতেই তাদের পাশে এসে পরিবারের সদস্যদের দাঁড়ানো জরুরি হয়ে পড়ে। পরিবারের পক্ষ থেকে বকাঝকা না করে সান্ত্বনা দেয়াটা হতে পারে সবচেয়ে সহায়ক। অন্ততপক্ষে ফল প্রকাশের দু’একদিনের মধ্যে শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক করতে সময় দেওয়া জরুরি। পরিবারের সদস্য বিশেষ করে বাবা মা-ই পারেন সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিতে। কোনো বাবা-মার কাছেই নিশ্চয় সন্তানের জীবনের চেয়ে তার পরীক্ষার ফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। কোনো বাবা-মা চাইবেনও না তার সন্তান স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিক।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছে। বছরে স্বেচ্ছায় আট লাখ মানুষ মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে। আর স্বেচ্ছা মৃত্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১০ম।

বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার যে প্রেক্ষাপট তা অনেকক্ষেত্রেই স্বেচ্ছামৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হতাশ হওয়ার মতো অনেক উপাদান আছে এখানে। আছে প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব। তারপরও যখন পরীক্ষায় ফেলের মতো একটা বিষয়ে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেয় তখন উদ্বিগ্ন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

শিক্ষকরা আমাদের শিক্ষার্থীদের কি পড়ান। বাবা মা-ই বা শিক্ষার ব্যাপারে কোন ধরনের বক্তব্য রাখেন। কি মনোভাব পোষণ করেন। কেবল কি শিক্ষার্থীদের বলা হয় পরীক্ষা পাসই একমাত্র পথ। মানে শিক্ষার্থী হিসেবে দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই। হ্যাঁ, পড়াশোনা করলে বাবা মা এমনকি শিক্ষার্থী নিজেও তো ভাল ফলের প্রত্যাশা করে। তবে শিক্ষক অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি, সন্তানদের, শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে পরীক্ষা পাস করার চেষ্টা করতে হবে। ক্যারিয়ারের জন্য তার দরকার আছে। তবে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। লক্ষ্য অর্জন নাও হতে পারে। পাস করাই শেষ কথা না। জীবনের চেয়ে বড় মূলবান কিছুই নেই পৃথিবীতে। ফেল করেও অনেকে ভাল কিছু করেছে।

মোট কথা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে বাবা-মা ও শিক্ষকদের ভূমিকাটা শক্তিশালী হওয়া দরকার। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে, ফলাফলের ক্ষেত্রেই হোক, জীবনের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেই হোক। শিক্ষা হতে হবে জীবন ঘনিষ্ঠ। পরীক্ষায় পাস এবং ফেল দুটি ব্যাপারই ঘটতে পারে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থীর পাস করা নিয়ে শিক্ষকদের সংশয় থাকে সেসব শিক্ষার্থী প্রসঙ্গে অভিভাবকদের আগে থেকেই সতর্ক করা যেতে পারে। মানসিক প্রস্তুতি থাকলে নিজেরাও কম ধাক্কা খাবেন। সন্তানদেরও বড় ধাক্কা থেকে বাঁচাতে পারবেন।

পরীক্ষায় ফেল করে শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছামৃত্যুর বিষয়ে গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা নেওয়া উচিত। গত বৃহস্পতিবার থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষার্থীর স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রায় সবগুলো সংবাদ আমি পড়ার চেষ্টা করেছি। সংবাদমাধ্যম স্বেচ্ছামৃত্যুর খবর কেন যে এতো বিস্তারিত লিখে আমি ঠিক জানি না। এর আগেও স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে লিখেছি। আত্মহত্যা শব্দটি যেকোনোভাবে পরিহার করে বিকল্প শব্দ ব্যবহারের কথা বলেছি। কারণ, আত্মহত্যা শব্দটিই আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয় ক্ষেত্র বিশেষে।

সমাজের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা এড়িয়ে যাচ্ছে গণমাধ্যম এবং কেবল নিজেদের আর্থিক স্বার্থে। অন্তত স্বেচ্ছমৃত্যুর সংবাদগুলো দেখে এমনই  মনে হয়। বরং স্বেচ্ছামৃত্যুর সংবাদগুলো একেবারে এড়িয়ে যেতে না পারলেও ছোট করে দেওয়া যেতে পারে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর বিষয়টি প্রতিবেদনের ভেতরে থাকতে পারে। তবে তা কোনোভাবেই শিরোনামে আসতে পারে না।

আর সবচেয়ে জরুরি হলো সংবাদ মাধ্যমকে পরীক্ষায় ফেল করে স্বেচ্ছামৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। অভিভাবকদের করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করা। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করা। মোট কথা জীবনের চেয়ে পরীক্ষার ফল বেশি কিছু নয় তা শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৭/রুহুল/এনএ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়