ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বুক রিভিউ

পুরাতাত্ত্বিক উপাত্তে ভরপুর বেড়ানোর নিখাঁদ উচ্ছ্বাস

অঞ্জন আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুরাতাত্ত্বিক উপাত্তে ভরপুর বেড়ানোর নিখাঁদ উচ্ছ্বাস

অঞ্জন আচার্য: দেশ মানে কোনো একটি মানচিত্র নয়, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা ভৌগলিক বিবরণ নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতেই লুকিয়ে থাকে সেই দেশের প্রকৃত রূপ-বৈচিত্র্য। নিরেট পর্যটক ও ভ্রমণকথক মঈনুস সুলতান সেই শেকড়-সন্ধানী কাজটিই করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে বেশ দক্ষ হাতে। তাঁর লেখা বৈশ্বিক পরিব্রাজক-বৃত্তান্তগুলো শংসিত হয়ে আসছে পাঠকসমাজে, সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে বাংলাসাহিত্য। তারই নতুন সংযোজন ‘নিকারাগুয়ার পুরাতাত্ত্বিক নগরী ও নির্জন দ্বীপ’ গ্রন্থটি। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উৎস প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই বইটিই আজকের আলোচ্য। কী আছে এ বইয়ে, সংক্ষেপে না-হয় তাই জানা যাক।

নিকারাগুয়ার এক ক্যাথিড্রালের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় জেরবার হন লেখক। সিনোরিতা আদ্রিয়ানা এখনো এসে পৌঁছেনি, হার্টের সমস্যায় নির্জন এপার্টমেন্টের কাউচে সে কী পেইনকিলারের ঘোরে পড়ে আছে? দেখতে পান- ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার মারফিকে, যার স্ত্রী সম্প্রতি সুইসাইড করেছেন। এই বিপত্নীকের সাথে আদ্রিয়ানার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক লেখককে উদ্বিগ্ন করে। জাদুঘরের আঙিনায় লেখকের সাক্ষাৎ হয় দুই চীনা তরুণীর সঙ্গে যারা নিকারাগুয়ায় এসেছে অপরিশোধিত স্বর্ণের সন্ধানে। অনিশ্চিত যাত্রার পাঠকও তাঁর সাথে শরিক হন সেইলবোটে রোলেট খেলার আমোদে। অতঃপর জনহীন এক দ্বীপে বিরল প্রজাতির কচ্ছপের প্রজনন দেখতে গিয়ে পাঠকও অবগত হন সন্দেহপ্রবণ ক্রিসটেলা ও সেন্টিমেন্টাল বিয়াংকার জীবনের নানাবিধ দ্বন্দ্ব সংঘাতের সঙ্গে। পরিশেষে আগুন-পাহাড় মমোতমবোর কাছাকাছি একটি ক্যাটল রেঞ্চে দিনযাপনের বয়ানে পাঠকও শামিল হন ক্যাম্পফারের, পোষা প্যালিকানের নৃত্যপ্রবণতা, কিংবা পরকীয়ার বিষয়-আশয় তাদের করে তুলে দারুণভাবে কৌতূহলী।

পর্যটনের শেষ পর্বে লেখক ও পাঠক এসে হাজির হন পুরাতাত্ত্বিক একটি নগরীতে, আদিবাসীদের নিপীড়ন তাদের বিষাদগ্রস্ত করে। এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জকে তোয়াক্কা না করে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দম্পতি ফের একাডেমিক উদ্যোগের বিষয়-আশয়ও তাদের মনে যোগায় বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা। নিকারাগুয়ার জাদুময় নিসর্গের প্রেক্ষাপটে লেখক বর্ণনা করেন কিছু মানুষের দিনযাপনের খণ্ডচিত্র। ভ্রমণচিত্রের শুরু হয় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্বপূর্ণ লেওন নগরীতে। শৌখিনভাবে গোল্ড প্যানিং-এর প্রত্যাশায় তিনি ঘুরে বেড়ান জাদুঘর, সমুদ্রসৈকত ও নির্জন দ্বীপে। কিছু সময় কাটে তার মমোতমবো আগ্নেয়গিরির কাছে পুরাতাত্ত্বিক এক সাইটে। ঘুরে বেড়ানোর সময় মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হন মেরিন-গাইড তরুণী, আর্ট কালেক্টার পুরুষ, বিপত্নীক ইনভেস্টার, শিল্পপতি ও ঘরছাড়া জননীর তালাশে নিকারাগুয়ায় আসা পাখিপ্রিয় যুবতী প্রমুখ চমকপ্রদ মানুষজনদের সাথে।

ভূমিকা-অংশে লেখক মঈনুস সুলতান তুলে ধরেন এই বইটি লেখার পেছনের গল্পটি: ‘যেসব দেশে আমার ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে, এগুলোর মধ্যে মাত্র দু-তিনটি দেশ নিয়ে বারবার লিখতে ইচ্ছা হয়, নিকারাগুয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম একটি। কয়েক বছর আগে ‘সামোটা ক্যানিয়নে গাবরিয়েলা’ নামে নিকারাগুয়ার ভ্রমণবিষয়ক আমার একটি বই প্রকাশিত হয়। তার বছরখানেক পর- কেবলই মনে হতে থাকে যে, ওই দেশটিতে আমার সফরের পরিসরে আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে যা নিয়ে মুসাবিদা করা যায় ভ্রমণগল্পের পুরো একটি সিরিজ। ‘সামোটা ক্যানিয়নে গাবরিয়েলা’ পাঠ করে বেশকিছু পাঠক আমাকে তাঁদের পজিটিভ অনুভূতি জানিয়ে ইমেইল করেছিলেন। তাঁদের সংখ্যা বিরাট কিছু ছিল না, তবে উনাদের মন্তব্যের কোয়ালিটি ছিল অসাধারণ, এঁদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে নিকারাগুয়া নিয়ে ফের লেখার অনুরোধ জানিয়ে আমাকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। তাঁদের এ অনুরোধ আমার আগ্রহের সাথে মিলেমিশে আমাকে এ-বইটি রচনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে।’

সেই ভূমিকার সূত্রেই আমরা আরো জানতে পারি: ‘প্রথমদিকে নিকারাগুয়ায় সমাজতান্ত্রিক ধারায় সম্পন্ন হওয়া বিপ্লব ও বাজার অর্থনীতির টানাপোড়েন আমাকে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু দিন কতক ওই দেশে বসবাসের পর সে আগ্রহ ফিকে হয়ে আসে। এবং এ শূন্যস্থান দ্রুত পূরণ করতে শুরু করে দেশটির রঙ্গালয়ের মতো রমরমে একটি নগরী, সমুদ্রসৈকত ও নির্জন দ্বীপ এবং আগুন-পাহাড়ের ছত্রছায়ায় পুরাতাত্ত্বিক উপাত্তে ভরপুর পরিসরে ঘুরে বেড়ানোর নিখাঁদ উচ্ছ্বাস। এসব বিষয়-আশয়ের ব্যক্তিগত খতিয়ান লিখতে গিয়ে ফের সচেতন হই, জনা-কয়েক নারী- যারা পর্যটকমহলে ‘চিকাস নিকারাগুয়েনসেস্ বা নিকা গার্লস্’ নামে নন্দিত, তাদের শুশ্রুষার মতো শোভন উষ্ণতা।’

বইটি মোট ১৪টি পর্বে বিভক্ত : ‘ক্যাথিড্রাল বেসিলিকা দে আসুনসিওন’, ‘ভ্যাগাবন্ড রেস্তোরাঁ’, ‘জাদুঘরের পথে ভিনটেজ মোটরকার’, ‘সেমিটারির সবুজ গোলাপ’, ‘সেইলবোটে রোলেট খেলার বৃত্তান্ত’, ‘সিনিওর জিওবানি ও নিকা গার্ল লিৎসি’, ‘সৈকতের নাম প্লায়া লাস পেনিটাস’, ‘বারকা ডে অরো’, ‘নির্জন দ্বীপের নীলিমায় আগুনপাহাড়ের ছায়া’, ‘ইসলা হুয়ান ডে ভেনাডো’, ‘সৈকতে সবুজ ডিঙি’, ‘জলতলে প্রবালের বাগিচায়’, ‘ক্যাটল রেঞ্চে দিনরাত্রি’, ‘পুরাতাত্ত্বিক নগরী লেওন ভিয়েখো’। প্রতিটি অধ্যায় যেন তথ্যের আকর। ব্যক্তি মানুষ থেকে জনগোষ্ঠীর কথা, তার পেছনের কথা- এককথায় ঘাসের ওপর হাঁটা থেকে পর্বত আরোহণ ও সমুদ্রমন্থন; কত বিচিত্র বিষয়, কত অজানা অধ্যায় এক এক করে খুলে যায় এই ভ্রমণ-সাহিত্যপাঠে। বইটি পড়ে মনে হয় যেন এক পুরাতাত্ত্বিক নগরীর নির্জন দ্বীপে পরিভ্রমণ হলো।

বইটির প্রকাশক: উৎস প্রকাশন; লেখক: মঈনুস সুলতান; প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯; প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর; পৃষ্ঠা : ১৭৬; মূল্য : ৩০০ টাকা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়