ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে...

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৩১ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে...

কেমন আছেন? প্রশ্ন করতেই অনেকের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে জবাব দিলেন কৃষ্ণপদ মণ্ডল, ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে...।

মাত্র আড়াই মাস আগে পশ্চিম উপকূলের ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের ইঙ্গিত করে যে তিনটি শব্দ উচ্চারণ করলেন কৃষ্ণপদ, তাতে সকলেই সায় দিলেন। ধানে তখন কেবল দুধ এসেছিল। ঝড়ের ঝাপটায় উঠতি আমন চিটায় পরিণত হয়েছে। কোন কৃষকের পক্ষেই খরচ ওঠানো সম্ভব হয়নি; বরং গুনতে হয়েছে লোকসান।

সরু বাঁধ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সাকবাড়িয়া নদী। ওপারে সুন্দরবন। আর বাঁধের ভেতরে ঝুঁকিতে থাকা বাড়িঘর। গত নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এই এলাকায় আঘাত হেনেছিল। নাজুক বেড়িবাঁধ টিকিয়ে রাখতে এলাকাবাসী নানান উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে পানি ঢুকতে পারেনি ভেতরে। ঘড়িলাল, মাটিয়াভাঙ্গা, কোবাদক, খাসিটানা, চরামুখাসহ অনেক স্থানে বাঁধের যে অবস্থা চোখে পড়ে; তা ধ্বসিয়ে দিতে বড় ধাক্কার প্রয়োজন পড়ে না। জোয়ারের বড় চাপেই ভেঙে যেতে পারে এই বাঁধ। এলাকাবাসী বললেন, ভাগ্যের ওপর ভর করে বেঁচে আছি। ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে; ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনেকের ঘেরের মাছ।’

তখনও ঘুমিয়ে শীতের সকাল। দু’একটি দোকানপাট খুলেছে কেবল। কয়রা থেকে ঘড়িলালের পথে। কাঠকাটা, হরিহরপুর পেরিয়ে কপোতাক্ষের তীর ধরে গন্তব্যে যাত্রা। খুলনা বিভাগীয় সদর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদর কয়রা; আর সেখান থেকে আরও ২৫ কিলোমিটার দূরে ঘড়িলাল। সুন্দরবন লাগোয়া এক গ্রাম। সপ্তাহে দু’দিন সোম ও শুক্রবার বাজার বসে এখানে। ঘড়িলাল বহু বছরের ঐতিহ্যবাহী বাজার। হাটের দিনেও এখানে হাজারো দোকানপাট পসরা সাজায়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গ্রামীণ এ হাটের জৌলুস অনেকটা কমে এসেছে।

মাটিয়াভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণপদ মণ্ডল; বয়স ৬৫ পেরিয়েছে। এলাকায় চিংড়ি চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এখনও কিছু জমিতে আমন আবাদ করেন তিনি। এবার দুই বিঘা জমিতে আমন করেছিলেন। খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু যে ধান কাটা হয়েছে, তাতে ১২ মণ ধানও পাবেন কিনা সন্দেহ। বিক্রি করে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা মিলতে পারে। গুনতে হবে লোকসান। আরেকজন শংকর মণ্ডল; বয়স ৭৫ বছর। আমন করেছিলেন দেড় বিঘা জমিতে। তিনি জানালেন, ধান কেবল ফুলে উঠেছিল। এই সময় ঝড়ের আঘাত আসে। ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। অর্ধেকও উঠবে কিনা জানা নেই।
 


ভর দুপুরে ঝিমিয়ে ঘড়িলাল বাজার। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। পরের দিন হাটবার; তাই অনেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে বিরাম নেই কামরুল ইসলাম সরদারের। হোটেল ব্যবসা তার। দুপুর-রাতের খাবারের জন্য হোটেলে ভিড় লেগেই থাকে। তখনও রান্না শেষ হয়নি। খালি পড়ে আছে চেয়ার-টেবিল। খানিক আলাপ জমাতেই কয়েকজন এসে জড়ো হলেন। এক নম্বর সমস্যা কী? প্রশ্ন ছুড়তেই সকলের একই জবাব: ‘শক্ত এবং উঁচু বেড়িবাঁধ চাই।’ কয়েকজন বললেন, বেড়িবাঁধ হলে এলাকায় চিংড়ির বিদায় হয়ে আবার ধানের আবাদ শুরু হবে। মাঠে মাঠে শুরু হবে হাজারো মানুষের কর্মব্যস্ততা।

ঘড়িলাল বাজার থেকে খানিক দূরে রোজোয়ানুল করিমের বাড়ি। চিংড়ির ঘের এবং ধানের আবাদ দুটোই আছে। তবে চিংড়ি চাষের কারণে ধানের আবাদ কমে গেছে। রেজোয়ানুলও সুর মেলালেন কৃষ্ণপদ মণ্ডলের কথায়। বললেন, কী আর বলবো ভাই! বুলবুলিতে ধান খেয়েছে। এমন বুলবুলি তো বারবার আসে। আমাদের সব কেড়ে নিয়ে যায়। ধানের ক্ষতি, মাছের ক্ষতি। আমরা কোনদিকে যাই?

রেজোয়ানুলের কথার রেশ কাটতে না কাটতে কামরুল সরদার বলেন, শক্ত করে বাঁধ দিলে এলাকার অবস্থা বদলে যাবে। সবুজে ভরে উঠবে। মানুষের অবস্থা বদলে যাবে। প্রথম দিকে চিংড়িতে বেশ লাভ হলেও এখন হচ্ছে না। চিংড়ি চাষীরাও লোকসানে আছে।

এতক্ষণ চুপচাপ বসেই ছিলেন সত্তরোর্ধ শওকাত ঢালী। বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়েছেন। জানাচ্ছিলেন, মাত্র এগারো বছর আগে এই এলাকার ওপর দিয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আইলা আমাদের সুজলা সুফলা গ্রামে ডেকে এনেছে সর্বনাশ। আইলায় লবণ পানি প্রবেশের পর মানুষের আর কোন উপায় থাকলো না। তারা ধান আবাদের বদলে চিংড়ি চাষে এগিয়ে আসে। বাধ্য হয়েই তারা চিংড়ি চাষে নামে। অথচ আইলার আগে এই এলাকার মাঠজুড়ে ছিল ধানের আবাদ। সে সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্ষেতমজুরেরা ছুটে আসতো এখানে। ধান কাটা শেষ হওয়া অবধি বহু মানুষের কাজ থাকতো এলাকায়। মাঠে এখন আর সেই কর্মব্যস্ততা নেই। কেননা, চিংড়ি ঘেরে এত লোকের প্রয়োজন হয় না। এখন বাইরে থেকে লোকজনের কাজে আসা তো দূরের কথা; এই এলাকার মানুষই কাজের সন্ধানে বাইরে যায়। আইলার পর থেকে কাজের সন্ধানে বহু মানুষ বাইরে চলে গেছে। একজন হিসেব কষে বললেন, ১০০০ জনের মধ্যে থেকে ৭০০জনই বাইরে চলে গেছে। এলাকায় কাজ নেই। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবীদের হাতেও কাজ নেই। ফলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়েছে।
 


ঘড়িলাল থেকে মাটিয়াভাঙ্গা, কিংবা মাটিয়াভাঙ্গা থেকে গোলাখালী, আংটিহারা সর্বত্রই নাজুক বেড়িবাঁধের চিত্র চোখে পড়ে। ফসলি মাঠ, চিংড়ির ঘের, বসতি, হাটবাজার, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বাঁধের ধারেই। বর্ষায় প্রবল জোয়ারের চাপে সাকবাড়িয়ার পানি উঠে যায় বাঁধ ছুঁইছুঁই। এ এলাকার মানুষের মাঝে তখন আতঙ্ক ছড়ায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাটিয়াভাঙ্গার দুই কিলোমিটার, মাটিয়াভাঙ্গা থেকে গোলখালী পর্যন্ত চার কিলোমিটার, গোলখালী থেকে খাসিটানা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এবং ঘড়িলাল থেকে চরামুখা পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার বাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

গেল বছর ২০১৯ সালে ঘুর্ণিঝড় ফণী আর বুলবুলের সময় এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে ছিল। অনেকের বাড়িঘরের চালা উড়ে গেছে। অনেকের ঘেরে পানি ঢুকেছে। অনেকের ক্ষতি হয়েছে আমনের। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের পর যে সাহায্য এসেছিল, তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছেনি বহু মানুষের কাছে। এমনই একজন মাটিয়াভাঙ্গা গ্রামের প্রকাশ মণ্ডল। ঘরের পাশে থাকা গাছ পড়ে বসত ঘর মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে ঘরে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো। কিন্তু এই পরিবারে আসেনি কোন সাহায্য।

আলাপ হলো দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবি শামসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সরকারি সাহায্য যা আসে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। কাকে রেখে কাকে দেই। নাজুক বেড়িবাঁধ এ এলাকার প্রধান সমস্যা। ইউনিয়নের সাড়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৫ কিলোমিটার অত্যন্ত নাজুক। এরমধ্যে আবার সাত কিলোমিটার মোটর বাইক চলাচলের অনুপযোগী। তিনি বলেন, বেড়িবাঁধ এভাবে নাজুক অবস্থায় রেখে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়। শক্ত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।

সুন্দরবন লাগোয়া জনপদ দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন। কয়রার অন্য ইউনিয়নগুলোর তূলনায় এ ইউনিয়নটি অনেকটাই পিছিয়ে। তবে বিগত তিন-চার বছরে এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেশ উন্নয়ন ঘটেছে। অনেক কাঁচা রাস্তায় ইট বিছানো হয়েছে। ঘড়িলাল বাজারে বেড়েছে দোকানের সংখ্যা। লবণের তীব্রতা কমে যাওয়ায় এলাকায় চোখে পড়ে কিছু সবুজ; যা তিন-চার বছর আগে দেখা যায়নি। ঘড়িলাল বাজার থেকে বিদ্যুতের খুঁটি চলে গেছে অনেক দূর। এলাকার মানুষজন জানালেন মাস দু’য়েক হলো বিদ্যুতের বিল দিচ্ছেন তারা। বিদ্যুতের আলোয় ঝলমলে বাড়ি-ঘর। কিন্তু এলাকার অস্তিত্ব রক্ষায় বৈদ্যুতিক আলোর চেয়ে বেশি দরকারি শক্ত উঁচু বেড়িবাঁধ। বাঁধ হবে, বাঁধ হচ্ছে- এই আশ্বাস পেতে পেতে এখন প্রায় আশাই ছেড়ে দিয়েছে এলাকাবাসী।



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়