ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বেআইনিভাবে আল-কারীম ফাউন্ডেশনের ১০ কোটি টাকা আমানাত সংগ্রহ

এম.শাহীন গোলদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ৯ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেআইনিভাবে আল-কারীম ফাউন্ডেশনের ১০ কোটি টাকা আমানাত সংগ্রহ

আইন-কানুন না মেনে কোটি কোটি টাকা আমানাত সংগ্রহ করছে আল-কারীম ফাউন্ডেশন। রাজনৈতিকদল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে নাম ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন মসজিদের ঈমাম-মুয়াজ্জিনকে সামনে রেখে এই বিপুল অংকের অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সাতক্ষীরা শহরের নবারুন স্কুলের সামনে থেকে সংগঠনের পাঁচ কর্মকর্তাকে আটক করে।

আটককৃতরা হলেন, শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের আব্দুল গফুরের ছেলে ফাউন্ডেশনের জেলা কর্মকর্তা রহমতউল্লাহ, সহকারী হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা আব্দুল খালেক, সদর উপজেলা জামে মসজিদের ইমাম ইহসানুর রহমানসহ পাঁচজন। সদর উপজেলা জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেন পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সটকে পড়ে। পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি আমানত সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবায় অধিদপ্তর, এমনকি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমতি নেয়নি। এখন যে কোনো সময় তারা আমানতের মোটা অংকের টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন বলে অনেক গ্রাহক আশঙ্কা করেছেন।

একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৮ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর বিপরীতে গ্রাহক সন্তুষ্টির জন্য কিছু ঋণ দিয়েছে। 

কয়েকজন গ্রাহক জানান, ২০০৬ সালে সাতক্ষীরায় নবারুন স্কুলের সামনে আল-কারীম ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তির সহযোগিতায়। এর মূল দায়িত্বে রয়েছেন যশোরের আলহাজ্ব সাজ্জাদ হোসেন। প্রথমদিকে তেমন সাড়া না পেলেও সাতটি উপজেলায় ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মাঠকর্মী নিয়োগ দিয়ে গ্রাহককে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে স্থায়ী এবং অস্থায়ী আমানাত সংগ্রহ শুরু করে। ঈমাম মুয়াজ্জিনদের দেখে সাধারণ মানুষ সহজে বিশ্বাস করে টাকা আমানত করতে থাকে। সাতটি উপজেলায় ৫০ জন মাঠকর্মীর মধ্যে অধিকাংশই ঈমাম ও মুয়াজ্জিন।

সেখানে কর্মরত কর্মকর্তারা জানান, আল-কারীম ফাউন্ডেশনের নামে সাতক্ষীরায় ব্যাংক হিসাব নেই। আছে চেয়ারম্যানের নামে, যশোরে। প্রতিদিন যে টাকা আদায় হয়, তা চেয়ারম্যানের একাউন্টে পাঠাতে হয়। কোনো গ্রাহক সঞ্চয়ের টাকা বা ঋণ চাইলে চেয়ারম্যান যশোর থেকে তার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজারের ব্যক্তিগত একাউন্টে চাহিদার অর্ধেক টাকা পাঠান।

সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি টাকা সংগ্রহ করেছেন সদর উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেন। তিনি একাই সংগ্রহ করেছেন প্রায় আড়াই কোটি টাকা।

গ্রাহক শ্যামনগর উপজেলার দাউদ গাজীর ছেলে আইয়ুব গাজী জানান, তিনি প্রায় আড়াই লাখ টাকা ফাউন্ডেশনে সঞ্চয় করেছেন। এর বিপরীতে ৫০ হাজার টাকা লোন নেন।

‘‘বাকি টাকা চাইতে গেলে বেলাল হোসেন বলেন- ‘আপনি ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন, বাকি টাকা পরিশোধ করুন; তা না হলে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।’’

এভাবে তাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করে আসছে বলে জানান গ্রাহকরা।

আল-কারীম ফাউন্ডেশনের জেলা কর্মকর্তা রহমত উল্লাহ বলেন, ২০০৬ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি সাতক্ষীরায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ৮ হাজার। এর মধ্যে ১ লাখ টাকায় ১ বছর মেয়াদে ৭০০ টাকা; ৩ বছর মেয়াদে ৯০০ টাকা ও ৫ বছর মেয়াদে ১০০০ টাকা মুনাফা দেয়া হয় গ্রাহকদের।

কীভাবে এত বিপুল অংকের টাকা লেনদেন করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাস বই ও মানি রিসিটের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কীভাবে টাকা সংগ্রহ করলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যশোরের সাজ্জাদ সাহেব যা করেন, তাই হয়। আমরা এখানে সামান্য বেতনে চাকরি করি।’’

আল-কারীম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সাজ্জাদ হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘‘আমি ইসলামী আন্দোলনের একজন সদস্য। আমি যখন শুরু করি, তখন এত আইন-কানুন দেখা হয়নি। এখন সরকার না চাইলে আমি ২০২০ সালের মধ্যে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেব।’’

এতদিন কীভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে এত টাকা সংগ্রহ করলেন এবং তা নিজের একাউন্টে রাখলেন- এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

এ ব্যাপারে জেলা সমবায় কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ বলেন, এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালানো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনোভাবে বৈধ নয়। তাদের দপ্তর থেকেও নিবন্ধন নেয়নি আল-কারীম ফাউন্ডেশন।

সাতক্ষীরা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক দেবাশীষ সরদার জানান, সপ্তাহখানেক আগে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তারা (আল-কারীম) একটি নিবন্ধন নিয়েছে। এই নিবন্ধনের আলোকে আর্থিক লেনদেন করা যাবে না। তারা আগে থেকে মোটা অংকের টাকা আমানত সংগ্রহ করছেন; যা বেআইনি।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আয়ূব আলী নামে এক গ্রাহক আমানতের টাকা ফেরত না পাওয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। গ্রাহকরা যাতে তাদের টাকা ফেরত পায়, সেজন্য পুলিশ সার্বিক সহযোগিতা করবে বলে জানান তিনি। 

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালানো বেআইনি।


ঢাকা/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়