ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মধুসূদনের কলমে বাংলা পেয়েছিল পরিস্রুত ভাষারূপ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধুসূদনের কলমে বাংলা পেয়েছিল পরিস্রুত ভাষারূপ

হাসান মাহামুদ: প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ ‘মাইকেল মধুসূদন: প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা’ শীর্ষক বইতে লিখেছেন: ‘মধুসূদন দত্তের সার্থকতা আকস্মিক বিস্ফোরণে, চারপাশে হঠাৎ তীব্র আলোকে ভরে দেয়ায়। তাঁর সংস্কারমুক্তি, বিশ্বপরিব্রাজকতা, অতৃপ্তি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল হঠাৎ সফল হয়ে বিনাশের অভিমুখে ধাবিত হবার।...তাঁর সংস্কারমুক্তি ঈর্ষা জাগায় আমাদের।’

সত্যি বলতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত শুধু বাংলা কাব্যসাহিত্য সমৃদ্ধই করেননি, বাংলা ভাষার সংস্কারও করেছেন। মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। এর বাইরেও মধূসূদনের একটি বিষয় খুব কমই আলোচনায় এসেছে, তা হলো- তিনি বাংলা ভাষার উৎকর্ষে অভাবনীয় অবদান রেখেছিলেন। এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু, বাংলা ভাষার বিকাশে মধূসূদনের অবদান সর্ম্পকে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা।

বাংলার নিজস্ব ভাণ্ডারের দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত রত্ন ভাণ্ডার আবিষ্কার করেছিলন মধুসূদন। চুপিসারে যেসব রত্ন পড়ে ছিল অনাদর এবং অবহেলায়। যেন লুকিয়ে ছিল ঘরের কোণে। যেসব শব্দ আর উপমা গায়ে মেখে ছিল অযত্নের কাদামাটি। পরম যত্নে তিনি সেগুলোকে তুলে নিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা শব্দ, বাক্য, অব্যয় আর উপমায়। ভাষাকে পরিস্রুত করেছেন আপন প্রতিভায়। ভাষা ব্যবহারের সময় শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় করতে পারা মধুসূদনই বলতে গেলে আমাদের দেখিয়ে গেছেন।

বিশেষ করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহাকাব্য মেঘনাদবধকাব্য লেখেন তখন বাংলা ছিল একটি অবিকশিত ও অনেকটাই দুর্বল ভাষা। বাংলা সাহিত্যের অনেক মনীষী স্বীকার করেছেন, তখন বাংলা ছিল ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষা। মহত্তম ভাবপ্রকাশের জন্য অপর্যাপ্ত এবং অপরিস্রুত এবং অনাদরণীয়। আর ব্রিটিশ এবং ইংরেজি ভাষা চর্চাকারীদের কাছে তখন বাংলা ছিল ‘সমাজের চাষাভূষা মানুষের অবহেলিত ভাষা’। উঁচুমহলে তখন এর  ঠাঁই ছিল না।

এরকম একটি অবিকশিত এবং হতদরিদ্র ভাষায় মেঘনাদবধকাব্য লেখা ছিল দুঃসাধ্যেরই নামান্তর। মাইকেল মধুসূদন সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে সত্যিকারের মহাকাব্য রচনার অসম্ভব কল্পনা হাতের মুঠোয় নিয়ে বাস্তবতায় পরিণত করেছিলেন অপরিমেয় প্রতিভার প্রখর ঝলকানিতে। মজার বিষয় হচ্ছে, মধুসূদন যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে ‘মাইকেল মধুসূদন’ নাম গ্রহণ করেন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। বাংলা কবিতা তখন পড়ে ছিল মধ্যযুগে। তখন রাজত্ব চলছিল কল্পনারহিত পদ্যকারদের।  জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন মাতৃভাষার প্রতি। এই সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করতে শুরু করেন। তিনিই একক প্রচেষ্টায় প্রবল ধাক্কায় বাংলা কবিতাকে মধ্যযুগীয় পদ্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এনে ফেলে দেন আধুনিকতার আঙ্গিনায়।

এই বিপুল পরাক্রম দেখানোর জন্য অবশ্য বাইরে থেকে তাকে ঋণ করতে হয়েছে প্রচুর। বিশ্বের রত্ন ভাণ্ডার খুলে খুলে দেখেছেন তিনি, আর বাংলাকে করেছেন সমৃদ্ধ। অনেকেই তাই তার লেখায় ইংরেজ কবি মিলটন কিংবা লর্ড বায়রনের ছায়া দেখতে পেয়েছেন, বাল্মীকির থেকে ইংবেঙ্গলের প্রভাব দেখেছেন।  কিন্তু মধুসূদন কখনো ‘ছায়ালেখা’র অপবাদে দুষ্ট হননি।

এসবের জন্য অবশ্য তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল নিজস্ব ভাষা ও ছন্দ। সাগরতলে লুকায়িত বাংলার রত্ন ভাণ্ডার থেকে রত্ন আহরণের জন্য দক্ষ ডুবুরির মতো ডুব দিয়েছেন তিনি। ছেঁকে ছেঁকে তুলে এনেছেন সব মণি-মাণিক্য। হানা দিয়েছেন সমৃদ্ধশালী প্রতিবেশী সংস্কৃতের রত্ন ভাণ্ডারে। সেসব লুণ্ঠিত রত্নরাজি মিশিয়েছেন চলতির সাথে সুদক্ষ কারিগরের সুনিপুণ কৌশলে। আবার নিজেও তৈরি করে নিয়েছেন নতুন নতুন সব প্রয়োজনীয় শব্দ। যেন হতচ্ছিন্ন মলিন গ্রাম্য পোশাক পালটিয়ে এর গায়ে জড়িয়েছেন আধুনিকতার উজ্জ্বল উত্তরীয়।

মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য নিয়েই তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ সালে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ সালে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন, ‘একেই কি বলে সভ্য’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী’ নাটক। এই নাটকে তিনিই প্রথম অমৃতাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।

আহমদ শরীফ, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও স্বীকার করে গেছেন মাইকেল মধুসূদনের কাব্য প্রতিভা আর শব্দশৈলীর ব্যবহারের গুণ। তার মতো বাংলা ভাষায় এতো শব্দ যোগ আর কেউ করেছিলেন বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে তুলনায় আনা যেতে পারে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।

মধুসুদনের কাব্যে ব্যবহৃত শব্দসমূহ অনেক জটিল এবং অবোধ্য মনে হতে পারে নবীন লেখকদের কাছে। এমনকি বর্তমান সময়ে এসে চিন্তা করলে মনে হতে পারে- ওসব অভিধানের পাতায় পাতায় শুয়ে থাকা বিপুল ওজনাকৃতির অব্যবহৃত শব্দ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এগুলোর সুদক্ষ এবং সুনিপুণ ব্যবহার করেই একদিন তিনি বাংলার মতো অবহেলিত অনুজ্জ্বল ভাষাকে দীপ্তিময় করেছিলেন। যেসব শব্দ পরবর্তীতে অনুসরণ করে গেছেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন চন্দ্র সেনদের মতো মধ্যযুগীয় কবিরা।

একজন মধুসুদন শুধু মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সেতুবন্ধনই করেননি, তিনি নিজেও ছিলেন আপাদমস্তক আধুনিক। বরং বলা চলে এখনকার অনেক আধুনিক কবির চেয়েও তিনি ছিলেন অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি প্রতিভাবান। অনেক বেশি ঝড়ো হাওয়া। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূচনা করেছেন তিনি। আরো বিস্ময়কর হচ্ছে, দেড়শ বছর পাড়ি দিয়েও তিনিই রয়ে গেছেন আধুনিক কবি।

তিনি মহাকাব্য লিখেছেন, সনেট লিখেছেন, বিয়োগান্ত নাটক লিখেছেন, লিখেছেন প্রহসন। এসবের কোনোটা তাঁর আগে আর কোনো বাঙালি লেখেন নি। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন মাত্র ছয় বছর। অথচ এই স্বল্পকাল বিশালত্ব এবং বৈচিত্র্যমুখিতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। মধুসূদনের আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিল ছন্দমিলের ছন্দে। কিন্তু বাংলায় যে এরকম অভূতপূর্ব ছন্দ হতে পারে এবং সেই ছন্দে যে চিরস্থায়ী কাব্য রচনা করা যায় তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তাঁর অমিত প্রতিভা দিয়ে।

আজ এই মহাকবির ১৯৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৮২৪ সালের আজকের দিনে (২৫ জানুয়ারি) তিনি ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে জন্ম নিয়েছিলেন। এই মহাকবির ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৭/হাসান মাহামুদ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়