ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মৃত্যুতে মুক্তি মিললো শিশু আলামিনের

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৪ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মৃত্যুতে মুক্তি মিললো শিশু আলামিনের

যে বয়সে বই-খাতা হাতে সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সেই আলামিনকে বেছে নিতে হয়েছিলো অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ।

মা-বাবা, ভাই-বোনকে ছেড়ে ঢাকায় থাকতে খুব কষ্ট হতো তার। কিন্তু কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। সে যে অবুঝ শিশু, বয়স মাত্র ১২। যে বাসায় কাজে দেয়া হয়েছিল সে বাসার গৃহকর্ত্রী তার সাথে নির্মম-নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করে। কথায় কথায় মারপিট, বকাঝকা সইতে হতো তাকে।

বন্দিদের মতই আটকে রাখতো তাকে। ঠিকমত খেতেও দিতো না। রাতে বাথরুমে দরজা আটকে রেখে দেয়া হতো। এতে মশার কামড় এবং দুর্গন্ধে তার শরীরে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। ক্রমেই আলামিন দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্বল শরীর নিয়ে তো আর কর্ত্রীর নির্দেশ মত সব কাজ করা সম্ভব হতো না। মাঝে-মধ্যে হাত ফসকে পড়ে যেত জিনিসপত্র। আর এসব কারণে নির্যাতনের নির্মমতা কয়েকগুণ বেড়ে যেতো। দুর্বল শরীর সে নির্যাতন সইতে পারেনি। অবশেষে মৃত্যুই অসহ্য  যন্ত্রণা  থেকে মুক্তি দিলো তাকে।

রাজধানীর আদাবরের শেখেরটেকে অমানুষিক নির্যাতনে গৃহকর্মী আল আমিন নিহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির বিচার আড়াই বছরেও শেষ হয়নি। মামলাটি ঢাকার ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মাকছুদা পারভীনের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন কোন সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এজন্য আদালত আগামী ১৫ মে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেন।

মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, ‘মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলাটির বিচার শেষ হচ্ছে না। সাক্ষীদের আদালতে হাজির হতে সমন পাঠানো হয়। পুলিশের দায়িত্ব সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা। কিন্তু পুলিশ সাক্ষী হাজির করতে পারছে না। সাক্ষীরা নিয়মিত আসলে মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।’

সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, ‘মামলাটি একটি অমানবিক ঘটনা কেন্দ্রিক। বাচ্চাটা আসামিদের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতো। ছোট মানুষ, সব সময় সব কাজ নাও করতে পারে বা ভুলও হতে পারে। এ কারণে তাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করতে হবে। আমারও সন্তান আছে। সেও কি সব কাজ করতে পারে বা ভুলও করে। এজন্য কি তাকে আমি মারধর করবো। আর আমাদের বুঝতে হবে একজন মানুষ কত দুঃখের পর অন্যের বাসায় কাজ করতে আসে। তাদের সাজা হওয়া উচিত। দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার কিছুটা হলেও কমবে। মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করতে রাষ্ট্রপক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে। আর আশা করছি, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।’

আলামিনের চাচা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আলামিনের বাবার তিন ছেলে, তিন মেয়ে। অভাবের সংসার, তাই তো ছেলেকে পাঠিয়েছিলো অন্যের বাসায় কাজ করতে, সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। কিন্তু ছেলেটাকে নির্মম অত্যাচার করতো। না খাইয়ে ছেলেটাকে মেরেই ফেলেছে। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই, ফাঁসি চাই।’ গরীব মানুষ, বিচার পাবে কি না এ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

আসামিপক্ষের আইনজীবীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোনটি ধরেননি।

আলামিনের মৃত্যুর ঘটনায় তার চাচা হারুন অর রশিদ ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আদাবর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, জোবায়ের আলম ও তার স্ত্রী সাইয়েদা রহমান, জোবায়েরের শাশুড়ি আনজু আরা পারভীন ও শ্যালক শাকিব আহমেদ বিভিন্ন সময় আলামিনকে বিভিন্ন বিষয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ ডিসেম্বর রাত ১০ টা থেকে ২৪ ডিসেম্বর ৯ টার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আলামিনকে নির্মমভাবে মারধর করে তাকে মেরে ফেলে।

মামলাটি তদন্ত করে আদাবর থানার এসআই মনিরুজ্জামান মনির শেখ জোবায়ের আলম ও তার স্ত্রী সাইয়েদা রহমানকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। জোবায়েরের শাশুড়ি আনজু আরা পারভীন ও শ্যালক শাকিব আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা তাদের অব্যাহতি দেয়।

এদিকে চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৭ সালের জুন মাসে আলামিনকে তার চাচা মানিক মিয়া কাজের জন্য জোবায়ের আলমের বাসায় এনে দেয়। আগস্ট মাসে আলামিনের পায়খানা/পেট খারাপ হওয়ায় সে বাসার বিভিন্ন জায়গায় পায়খানা করে নষ্ট করে দেয়। এরপর থেকে জোবায়ের ও তার স্ত্রী আলামিনকে বাসার দুই বাথরুমের যে কোন একটিতে থাকতে দেয়। সাইয়েদা আলামিনকে দিয়ে অমানুষিক কাজ করাতো এবং ঠিকমত খাবার খেতে দিতো না। আলামিন কোন কাজ ভুল করলে তাকে সাইয়েদা কাঠের লাঠি, রুটি বানানো কাঠের বেলুন, কাঠের চামচ, স্টিলের স্কেল দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারপিট করে শারীরিক নির্যাতন করতো এবং সারাদিন কাজ শেষে রাতে তাকে বাথরুমে থাকতে ও খেতে দিতো। কোন প্রকার বিছানা ছাড়া আলামিনকে ভেজা মেঝেতে ঘুমোতে দিত এবং সকালে সাইয়েদা তাকে গোসল করে পরিস্কার হয়ে কাজ করার জন্য বাথরুম থেকে বের হওয়ার নির্দেশ দিত। গোছল করে পরিস্কার হয়ে আলামিন বাসার কাজ করতো। আলামিন খাবার চুরি করে খেতে পারে এমন সন্দেহে বাইরে থেকে বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে রাখতো। আলামিনকে ঠিকমত খাবার না দেয়ায় এবং বাথরুমে থাকায় সে ঠিকমত ঘুমোতে পারতো না। এজন্য দিনে দিনে আলামিন দুর্বল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আলামিন ঠিকমত কাজ করতে না পারলে সাইয়েদা তাকে অমানুষিক নির্যাতন চালাতো।’

চার্জশিটে বলা হয়, স্ত্রীর মন রক্ষায় জোবায়েরও আলামিনকে মাঝে মাঝে মারপিট করতো। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ ডিসেম্বর জোবায়ের বাজার করে আনলে সাইয়েদা আলামিনকে রান্নাঘরে কাজ করতে বলে। দীর্ঘদিনের অনাহারে, অনিদ্রায়, অসুস্থ আলামিন ঠিকমত কাজ করতে পারে না। এজন্য সাইয়েদা কাঠের চামচ দিয়ে খুব মারপিট করে। আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আলামিন ভয়ে কাজ করতে থাকা অবস্থায় রাত সাড়ে ৮টার দিকে রান্নাঘরের থালা-বাসন ধোয়ার সময় পাতিল ও বাচ্চার দুধের ফিডার পড়ে যায়। এজন্য সাইয়েদা আবারও আলামিনকে কাঠের রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে মারপিট করে। তখন সাইয়েদার মা আনজু আরা তার হাত থেকে বেলুনটি কেড়ে নেয় এবং আলামিনকে মারপিট করতে নিষেধ করে। তখন ড্রয়িং রুমে বসে থাকা জোবায়ের রেগে রান্নাঘরে গিয়ে আলামিনকে উপরে তুলে একটা আছাড় মারে। আলামিন রান্নাঘরের ঝুড়ির ওপর আছড়ে পরলে তার শরীরের পুরনো ক্ষত গুলো ফেটে রক্ত বের হয় এবং ঝুড়িতে থাকা ময়লা তার শরীরে লেগে যায়।  জোবায়ের তখন আলামিনকে বাথরুমে নিয়ে ঝরণা ছেড়ে দিয়ে রক্ত ও ময়লা পরিস্কার করতে বলে। ৩০ মিনিট পর জোবায়ের ঝরণা বন্ধ করে। গামছা দিয়ে শরীর মুছতে বলে এবং আলামিনকে বাথরুমে এক প্লেট খাবার দিয়ে খেতে বলে। আঘাতে ক্ষত বিক্ষত ভিকটিমের দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে এবং মাঝে মাঝে খাবারের দিকে তাকিয়ে আবার পড়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে পরদিন আলামিন বাসায় মারা যায়।’

মামলাটিতে  ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই জোবায়ের আলম ও তার স্ত্রী সাইয়েদা রহমানের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। মামলাটিতে এখন পর্যন্ত ৩৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। দুই আসামি বর্তমানে কারাগারে আছে।


ঢাকা/মামুন খান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ