ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

লেখায় লেখায় আনন্দ বিলানোর ফেরিওয়ালা

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লেখায় লেখায় আনন্দ বিলানোর ফেরিওয়ালা

শাহ মতিন টিপু : সুকুমার রায়কে বলা হয় বাংলা ভাষায় ননসেন্স এরও প্রবর্তক। অনেক গুণের আধার এই মানুষটি। শিশুসাহিত্যিক, রম্যলেখক, নাট্যকার এবং কার্টুনিস্ট। তার ছড়া পড়েননি এবং পড়ে মজা কুড়াননি, বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো পাঠক পাওয়া যাবেনা। আনন্দ কুড়ানোর উপাদানই ছিল তার লেখার বৈশিষ্ট। বলা যায় তিনি ছিলেন লেখায় লেখায় আনন্দ বিলানোর ফেরিওয়ালা।

সুকুমার রায়ের ৯৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯২৩ সালে ১০ সেপ্টেম্বর তিনি মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে একমাত্র পুত্র সত্যজিৎ এবং স্ত্রীকে রেখে তিনি পরলোকগমন করেন।

নিজের লেখায় কালি-কলমের আঁচড়ে চমৎকার সব কার্টুন ও ড্রয়িং ছিল তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। বলা হয়, সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়ের নাম। তার বাবা জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, আবার তার পুত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। পুত্র সত্যজিৎ রায়ও লেখালেখিতে পিতার অলংকরণের গুণটি পেয়েছিলেন।

সুকুমার রায়ের কয়েকটি ছড়া, যেমন-

রামগরুড়ের ছানা           হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
“হাসব না-না, না-না!”

সদাই মরে ত্রাসে       ওই বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে।

আবার-

চলে হনহন
ছোটে পনপন
ঘোরে বনবন
কাজে ঠনঠন..

আবার-

মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার
সবাই বলে, ”মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!”
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই ”মুখ্য ছেলে”, বলবে আমায় ”গো গর্দভ!”

আবার-

এমন যদি হতো
ইচ্ছে হলে আমি হতাম
প্রজাপতির মতো
নানান রঙের ফুলের পরে
বসে যেতাম চুপটি করে
খেয়াল মতো নানান ফুলের
সুবাস নিতাম কতো ।

আবার-

আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে,
কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।
রোদে জলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে।
ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে।

এই কয়েকটি উপমাতেই স্পষ্ট তার ছড়াগুলো ছিল কতোটা মজার।

সুকুমার রায়ের শিশু সাহিত্যগুলোর মধ্যে কবিতার বই 'আবোল তাবোল', গল্প 'হ-য-ব-র-ল', গল্প সংকলন 'পাগলা দাশু' এবং নাটক 'চলচ্চিত্তচঞ্চরী'  বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা 'ননসেন্স' ধরণের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়। কেবল 'অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড'  ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিকই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর তিরানব্বই বছর পরও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।

সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর, কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে। বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তো বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্বল রত্ন, মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে।

সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যনুরাগী, যা তার মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন ছিলেন একাধারে শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন।

এ ছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় অ্যান্ড সন্স নামে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন সুকুমার রায়।

সুকুমার লেখাপড়ায়ও ছিলেন মেধাবী। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বিএসসি (অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন ।

সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ করা যায়। ‘সন্দেশ’ এর সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তার লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তার বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তার অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তার প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।

১৮৯৫ সালে মাত্র আট বছর বয়সে সুকুমারের প্রথম কবিতা 'নদী' প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’ পত্রিকায়। এরপর ন'বছর বয়সে ‘টিক্ টিক্ টং’ লেখেন ইংরেজি শিশুপাঠ ‘ঐরপশড়ৎু, উরপশড়ৎু, উড়পশ’-এর অনুবাদ হিসাবে। তার একটি ননসেন্স ছড়া এ রকম- ‘মাসী গো মাসী পাচ্ছে হাসি/ নিম গাছেতে হচ্ছে সিম,/ হাতির মাথায় ব্যাঙের বাসা/কাগের বাসায় বগের ডিম।’

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬/টিপু/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়