ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হুরমত, নিয়ামত ও জাগ্রত চৌরঙ্গী || তাপস রায়

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২২, ১৯ মার্চ ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হুরমত, নিয়ামত ও জাগ্রত চৌরঙ্গী || তাপস রায়

জাগ্রত চৌরঙ্গী

আমি যেদিন প্রথম গাজীপুর জেলা শহরে যাই সেদিন বিভ্রান্ত হই জয়দেবপুর  নামটি না দেখে। ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি, একাত্তরের ১৯ মার্চ এই জয়দেবপুরেই পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংঘটিত হয়েছিল। আমি সেই জয়দেবপুর খুঁজে পাইনি। গাজীপুরের আড়ালে জয়দেবপুর অনেক আগেই চাপা পড়ে গিয়েছে।

চান্দনা চৌরাস্তা পাওয়ার আগে বেশ দূর থেকেই ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ ভাস্কর্য চোখে পড়ল। এটিই আসলে ‘জয়দেবপুর চৌরাস্তা’। চৌরাস্তার ঠিক মাঝখানে সড়কদ্বীপে অবস্থিত ভাস্কর্যটি পথচারী, আগন্তুককে স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার মানুষের অসম সাহসী ভূমিকার কথা। ভাস্কর্যটি একটি যুবকের। যার শির উন্নত, ডান হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ গ্রেনেড, বাম হাতে রাইফেল। যুবকের উদাম গা, পরনে প্যান্ট নয়-লুঙ্গি। খালি পা। অর্থাৎ ভাস্কর্যটিতে আমরা এ দেশের হাটে-মাঠে-ঘাটের তরতাজা, পেশিবহুল সাহসী এক যুবককে দেখতে পাই। সে যেন সদ্য মাঠ থেকে উঠে আসা কৃষক, নদীর ঘাটের মাঝি, কলের শ্রমিকের প্রতিনিধি।

জাগ্রত চৌরঙ্গী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম ভাস্কর্য। ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক এটি নির্মাণ করেন ১৯৭৩ সালে। ইতিহাস বলছে, ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে গাজীপুরের স্থানীয় জনগণের একটি প্রতিরোধ যুদ্ধে ২০ জন শহীদ হন। যদিও সরকারি বিবৃতিতে তিন জন মারা যাওয়ার কথা সেদিন স্বীকার করা হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধে এই শহীদদের অবদান ও আত্মত্যাগ জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে এই স্থাপত্যকর্মটি নির্মাণ করা হয়। বেদিসহ জাগ্রত চৌরঙ্গীর উচ্চতা প্রায় ৪২ ফুট। কংক্রিট, সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে নির্মিত এ ভাস্কর্যটিতে ৩ এবং ১১ নম্বর সেক্টরের শহীদ সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় জয়দেবপুরের নাম লেখা হয় গৌরবের কালিতে। মুক্তির আকুলতা নিয়ে অকুতোভয়দের সেই মিছিলে জয়দেবপুরের মানুষও সেদিন শামিল হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মিছিলের অগ্রভাগেই ছিল তাদের নাম। জাগ্রত চৌরঙ্গী এ কথার সাক্ষ্য দেয়। তৎকালীন জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ি ছিল ১৭ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তর এবং ব্যারাক। এই ব্যারাকে বাঙালি সৈন্য বেশি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সেই উত্তাল দিনগুলোয় ঢাকা থেকে আসা নির্দেশ অনুযায়ী দেশের অন্য জায়গাগুলোর মতো জয়দেবপুরেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছিল। হানাদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মিছিলে-মিছিলে, স্লোগানে-স্লোগানে মুখরিত ছিল জয়দেবপুর। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তখন এ এলাকায় গঠিত হয় ‘ভাওয়াল স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ’। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। এর সদস্য ছিলেন হারুন উর রশীদ, শহীদুল্লাহ বাচ্চু, হজরত আলী, জিন্নাহ পাঠান, মো. আবু সাত্তার মিয়া ও নজরুল ইসলাম। হাইকমান্ডের সদস্য ছিলেন মো. হাবীবুল্লাহ, এম এ মোত্তালিব ও ডা. মনীন্দ্রনাথ গোস্বামী।

উল্লিখিতদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত। তাদের অপ্রতিরোধ্য মনোবলে বিক্ষোভ ফুঁসে উঠেছিল। সর্বস্তরের সব পেশার মানুষ শামিল হয়েছিল সেই বিক্ষোভে। এরই মধ্যে ১৭ মার্চ লুট হলো সমরাস্ত্র কারখানার অস্ত্রভাণ্ডার। টনক নড়ল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার। ১৯ মার্চ ঢাকা থেকে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা পাঠানো হলো জয়দেবপুর সেনানিবাসের দিকে। কারণ স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষ যেভাবে ফুঁসে উঠেছিল, তাদের সঙ্গে সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকেরা যোগ দিয়ে যাতে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে সে জন্য আগেই বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করে অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের কবজায় নিয়ে নেওয়া।

কিন্তু বিধিবাম! এ খবর বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তেই একত্রিত হলো সাধারণ মানুষ। তাদের কণ্ঠে স্লোগান, হৃদয়ে শপথ যেভাবেই হোক রুখে দিতে হবে পাকিস্তানি সেনাদের। অস্ত্র নিয়ে তাদের ফিরে যেতে দেওয়া হবে না। দিনটি ছিল শুক্রবার। হাটের দিন। ব্যবসা ফেলে ছুটে এল হাটের ব্যবসায়ী। কারখানা বন্ধ করে এল শ্রমিক। মাঠে লাঙল ফেলে কাস্তে হাতে এল কৃষক। সাধারণ মানুষ যে যা পেল, তাই নিয়ে এগিয়ে এল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশ নিতে। তাদের কারো হাতে ইট-পাথর। কারো হাতে বাঁশের লাঠি, লগি। কেউ বিভিন্ন ভবনের ছাদে উঠে গেল শখের একনালা বন্দুক নিয়ে। উদ্দেশ্য সবারই এক- যে করেই হোক হটিয়ে দিতে হবে পাকিস্তানি সেনাদের।

রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেওয়া হলো। পাকিস্তানি সেনারা বাধাপ্রাপ্ত হতেই গুলি ছুড়তে শুরু করল। গুলিতে নিহত হলো হুরমত, নিয়ামত, মনু খলিফাসহ আরো অনেকে। ব্যারিকেড ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে যেতে থাকল জয়দেবপুর চৌরাস্তার দিকে। এখানেও শত শত মানুষের প্রতিরোধের মুখে পড়ল সেনারা। চলল গুলি। তারা অমানবিক অত্যাচার চালাল বিক্ষোভকারীদের ওপর। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবলীলা। তারপর তারা ফিরে গেল ঢাকার দিকে। জয়দেবপুরে ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই ঘটনার রেশ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। এরপর `জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো` স্লোগানে-স্লোগানে মুখরিত হলো দেশ। দেশের মানুষ জানল এভাবেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। ১৯ মার্চ সেই পথই যেন দেখাল জয়দেবপুরবাসী।
 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৫/তারা
 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়