বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) আলোচিত ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক (ইডি) আব্দুর রশীদকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএমডিএতে তার মূল পদ অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। তাকে আবার এই পদে ফিরে যেতে হবে। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি ভারপ্রাপ্ত ইডির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে আব্দুর রশীদকে সরিয়ে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) শফিকুল ইসলাম মুকুলকে বিএমডিএর ইডি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তবে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নতুন ইডি যোগদান করেননি।
বিএমডিএর কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ সালে ইডি আব্দুর রশীদের নামে দুদক একটি মামলা করেছিল। দুদক ইডি ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবও তলব করেছিল। পরে মামলাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। এখন আর মাত্র কয়েকমাস চাকরি আছে ইডি আব্দুর রশীদের। এখন তিনি অবৈধপন্থায় টাকা কামানোর নেশায় মত্ত। ইডির দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। বিএমডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগও দিয়েছেন।
জানতে চাইলে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ইডি আব্দুর রশীদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। একটা সভা করে অভিযোগের কপিটি ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতে হয়। সে সভাটি এখনো হয়নি। প্রধান কার্যালয় অভিযোগ অনুসন্ধানের অনুমোদন দিলে সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করা হবে।’
বিএমডিএ সূত্র জানায়, গভীর নলকূপের অপারেটর নিয়োগ, বদলি ও কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ছাড়া অন্য কোনো কাজের ফাইল বিএমডিএর চেয়ারম্যানের কাছে যায় না। সমস্ত কাজই করে থাকেন ইডি। বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগের সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে প্রকৌশলীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন ইডি আব্দুর রশীদ। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হয়েই অনেকে শুরু করেছেন লুটপাট। তখন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে চোখ বন্ধ করে থেকেছেন ইডি। ঠিকাদারদের কাজ দিয়ে ১০ শতাংশ অর্থ বাগিয়ে নেওয়া এবং কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ আছে ইডি আব্দুর রশীদের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি এক নীরিক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে, ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণের জন্য নিম্নমানের পাইপ কেনায় সরকারের ৬ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার ৬৪৪ টাকা ক্ষতি হয়েছে। গোদাগাড়ী উপজেলার সাহাব্দীপুরসহ কয়েকটি এলাকায় গতবছরের জুলাই থেকে আগস্ট মাসে এই পাইপ বসানো হয়। নিম্নমানের এসব ইউপিভিসি পাইপ কয়েকমাসের মধ্যেই ফেটে যায়। অথচ প্রকল্পে লোহার পাইপ বসানোর কথা ছিল। পরে ফেটে যাওয়া এসব পাইপ তুলে বিএমডিএর গোদাগাড়ী জোন-১ এর কার্যালয়ের সামনে স্তূপাকারে রাখা হয়।
একটি কমিটি করে এই অনিয়মের তদন্তও করা হয়। এতে অনিয়মের সত্যতা পাওয়া যায়। গুরুত্বর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ থাকা এই প্রকল্পের পিডি শহীদুর রহমানের কাছে পরে ব্যাখা তলব করা হয়। ব্যাখা সন্তোষজনক না হলেও গত ১ ফেব্রুয়ারি ইডি আব্দুর রশীদ শুধু সতর্ক করে শহীদুর রহমানকে চিঠি দিয়ে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। পিডি শহীদুর রহমান মোট ১০০ কোটি টাকার পাইপ কিনেছেন। তিনি কাজ না করেই ঠিকাদারকে ৪১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বিল দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।
বিএমডিএর তদন্তে অবশ্য কাজ না করে ২৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা বিল দেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। তিনি ১৫ কেজি ওজনের বদলে ১২ কেজির রাইজার ভাল্ব কিনেছেন বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন ইডি আব্দুর রশীদের কাছে জমা পড়ে। তবে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
অভিযোগ আছে, এই পিডি সব সময় ইডিকে খুশি রেখেই কাজ করেন। তাই তার অনিয়ম ধামাচাপা দেন ইডি। কোটেশনে কেনাকাটায় পিডিদের এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি ইডি আব্দুর রশীদ।
সম্প্রতি দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ৩ বছর ধরে ইডি তার আত্মীয়সহ কয়েকজন পছন্দের লোকের কাছ থেকে কোটেশনে নিম্নমানের মালামাল কিনেছেন। কখনো কখনো কাগজে-কলমে কেনাকাটা দেখিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
অভিযোগ মতে, বিএমডিএর চেয়ারম্যান ও ইডিকে আর্থিকভাবে খুশি করে যে যেভাবে পারছেন লুটপাট করছেন। প্রায় এক বছর আগে সাত জনকে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩০ জনকে সহকারী প্রকৌশলী থেকে চলতি দায়িত্বের নির্বাহী প্রকৌশলী করা হয়েছে। ৬০ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অন্য ছোট পদগুলোর কর্মচারীদেরও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রকৌশলীর পদোন্নতির ক্ষেত্রে দেড় থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত এবং কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রায় ৩ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। ইডি রশীদের পক্ষে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের কাজটি করেছেন সহকারী প্রকৌশলী থেকে চলতি দায়িত্বের নির্বাহী প্রকৌশলী হওয়া সানজিদা খানম মলি।
অভিযোগে বলা হয়েছে, খাল খননের প্রকল্পের পরিচালক হাবিবুর রহমান খান, সুমন্ত কুমার বসাক, নূরে আলম ও শরীফুল হক যে সমস্ত কাজ করেছেন সেগুলো ইডি ও পিডিদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। ইডি তার অংশের কাজ ১০ শতাংশ কমিশনে ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করেছেন। এ কারণে তিন বছর ধরে ইডি ও পিডিদের পছন্দের বাইরে সাধারণ ঠিকাদাররা কাজ পান না। আবার পিডি নিয়োগের জন্য নামের সুপারিশ পাঠাতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন ইডি। প্রকল্প অনুমোদনের পর পিডি ও ইডি সরকারী টাকা রাখেন বেসরকারী ব্যাংকে। অথচ প্রকল্পের ২৫ শতাংশের বেশি টাকা বেসরকারী ব্যাংকে রাখার নিয়ম নেই। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা রেখে কমিশন নেন বিভিন্ন ইডি ও পিডিরা।
অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গত বুধবার ইডি আব্দুর রশীদের দপ্তরে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। টানা কয়েকদিন ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। সবশেষ শুক্রবার (৫ জুলাই) সকালে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইডির পক্ষে পদোন্নতির জন্য ঘুষের টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে চলতি দায়িত্বের নির্বাহী প্রকৌশলী সানজিদা খানম মলি বলেন, ‘এগুলো সত্য নয়। কারও কাছে প্রমাণ থাকলে আমার কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে পারে।’
বিএমডিএর-চেয়ারম্যান বেগম আখতার জাহান বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ইডি পদে নতুন কর্মকর্তাকে পদায়ন করেছেন। তবে তিনি এখনও যোগ দেননি। আব্দুর রশীদ এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন কর্মকর্তা যোগ দিলে তাকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে ফিরে যেতে হবে।’
কেন আব্দুর রশীদকে সরানো হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারবো না। মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।’ ইডির অনিয়মের বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।