চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তের রহস্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছার নাম। এই হত্যা মামলায় বর্তমানে কারাগারে থাকা সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত সোর্স ছিলেন মুছা। তাকে দিয়েই পুরো হত্যা মিশন সম্পন্ন করা হয় বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করছে। তবে সোমবার (১৭ মে) পর্যন্ত রিমান্ড জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আক্তার গোয়েন্দাদের জেরার মুখে তার বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুৃন: রিমান্ড শেষে কারাগারে বাবুল আক্তার
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই প্রধান ও ডিআইজি প্রকৌশলী বনজ কুমার বলেন, মুছাকেও গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সে মিতুর বাবার দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি। তাকে গ্রেপ্তারে বিভিন্ন সংস্থাও কাজ করছে। তবে পাঁচ বছর ধরে নিখোঁজ থাকায় তাকে খুঁজতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে।
রাইজিংবিডিকে এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রয়োজনে বাবুল আক্তারের কথিত প্রেমিক ও এনজিও কর্মকর্তা গায়ত্রী অমর সিংহকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। বাবুল আক্তার রিমান্ডে এসব তথ্য না দেওয়ায় পুনরায তার রিমান্ডও চাওয়া হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও মিতুর স্বজনেরা সন্দেহ করে আসছেন, কক্সবাজারে বাবুল আক্তার দায়িত্বপালনকালীন সময় ওই নারীর সঙ্গে তার পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন একটি রিসোর্টে বাবুল আক্তার ও গায়ত্রীকে দেখে ফেলেন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার মিতু। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, দ্বন্দ্বও শুরু হয়। এরপরই মূলত মিতুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাবুল আক্তার করেন। তারই অংশ হিসেবে বাবুল তার বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সোর্স মুছাকে হত্যা মিশনের পরিকল্পনার দায়িত্ব দেন। এজন্য তিনি ৩ লাখ টাকাও দেন বলে পুলিশের তদন্তে জানা গেছে। মুছার কাছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা অস্ত্র কেনা বাবদ দেন বাবুল। ২০১৬ সালের ৫ মে’র ঘটনার পরপরই সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে দুজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পেশাদার কিলার আনোয়ার হোসেন ও ওয়াসিমকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সেখানেও মুছার নাম আসে। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ রয়েছেন মুছা। অবশ্য মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, আমার স্বামী যদি অপরাধ করে থাকেন তাহলে কেন তাকে বিচারের মুখোমুখী করা হচ্ছে না। অথচ ঘটনার এক সপ্তাহ পর আমার স্বামীকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে কক্সবাজারের রাঙ্গুনিয়ার বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সম্ভাব্য সব স্থানে যোগাযোগ করা হলেও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি গুম হয়েছেন, না কোথায় আছেন তাও বলতে পারছি না।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন সৌদি আরব থেকে এসে মুছা ২০০৪-৫ সালে রাঙ্গুনিয়া এলাকায় বালুর ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৯ সালের দিকে ওই এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন বাবুল আক্তার। এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেওয়ার সূত্র ধরে বাবুলের সঙ্গে মুছার সম্পর্ক। এক সময় মুছা বাবুলের বিশ্বস্ত বনে যান। এরপরই বাবুলের গোপন ও একান্ত নানা ধরনের কাজগুলো মুছাকে দিয়েই করানো হতো। এ কারণেই মুছাকে এ মামলার অন্যতম আসামি হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রথম থেকেই বলে আসছি অর্থাৎ ওই নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। মিতু ঘটনাটি জেনে যাওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝগড়াঝাটি ও মনোমালিন্য হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তদন্ত আর সে দিকে যায়নি। এ বিষয় নিয়ে তদন্তে আগে বাড়লে এতদিনে হয়তো ঘটনার প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসতো।
জানা গেছে, গায়ত্রী বর্তমানে নেদারল্যান্ডে অবস্থান করছেন। তদন্তের স্বার্থে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সেভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের সম্ভাব্য স্থানেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
ঈদের কদিন আগে বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রামে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এক পর্যায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত মিতুর ছেলের কাছ সেদিন কি ঘটেছিল তা জানার চেষ্টা করা হবে। বাবুল আক্তার মামলায় মোহাম্মদপুর বাসার যে ঠিকানা, স্থান উল্লেখ করেছেন সেখানে গিয়ে মিতুর দুই সন্তানকে পাওয়া যায়নি। তারা কোথায় থাকতে পারে এজন্য খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এ ঘটনা কার পরিকল্পনায় হয়েছে, কারা কারা জড়িত, কারা খুনে অংশগ্রহণ করেছে সবকিছুর ধুম্রজাল পরিষ্কার হয়ে যাবে। সহসাই তদন্ত শেষে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ মে সকালে ছেলেকে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ের বাসে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মিতু। এ সময় খুনিরা এসে তাকে মুহূর্তের মধ্যে খুন করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে যায়। এ নিয়ে ওই সময় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বলা হচ্ছিল জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন সাবেক পুলিশের এ কর্মকর্তার স্ত্রী।