‘মাঝে মাঝে সিনেমার মতো কিক দরকার হয়। কোনো একভাবে সেই কিকটা আমি পেয়েছি, আসছে। কিভাবে, তা বলব না। সেটা আড়ালেই থাকুক। কোনো একভাবে সেটা এসেছে, সেটাই আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এমন নয় যে খুব বড় কিছু কিন্তু একটা কিক তো এসেছেই।’
এক গাল হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। অতি পরিচিত বক্তব্য। নিশ্চয়ই চরিত্রটা ধরতে পেরেছেন। পেরেছেন বলেই ইতিহাসে জড়ানো ৬০৬ রান ও ১১ উইকেটের সাফল্যগাথার গল্পটা জানা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান ২০১৯ বিশ্বকাপে ভালো করবেন তা অনেকটা ঘোষণা দিয়েই গিয়েছিলেন। ২২ গজে করেও দেখিয়েছিলেন। অথচ চার বছরের ব্যবধানে সেই একই মহাতারকার বক্তব্যে আকাশপাতাল তফাৎ। সময় বুঝি এমনই!
‘ও রকম কোনো কিক নেই। শুধু চেষ্টা করছি যতটা ফিট থাকা যায়। যেহেতু সামনে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট বা সিরিজ আছে। প্রচুর খেলা আছে, ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি। ’
চার বছরে পালাবদল হয়েছে অনেক কিছুর। সাকিব সহ অধিনায়ক থেকে এখন পূর্ণ অধিনায়ক। তাতেই কি পাল্টে গেলেন! না সাকিব পাল্টাননি। তবে লম্বা সময়ে ভাবনার বদল নিশ্চিতভাবেই হয়েছে। মাঠের ক্রিকেট, তার ফিটনেস, পারিপার্শ্বিক কাজ সেসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
২০১৯ বিশ্বকাপের জন্য তার যে প্রস্তুতি ছিল তা এবার নেই। সেবার আইপিএল খেলতে গিয়েছিলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে। ওখানে ম্যাচ খেলার সুযোগ কম পেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিয়ে নেন লম্বা সময় ধরে। দেশ থেকে কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে ডেকে নেন। কাজ করেন স্কিল ট্রেনিং নিয়ে। সঙ্গে ফিটনেস ও ডায়েটে নজর দিয়ে ৬ কেজি ওজন কমিয়ে হন ঝরঝরে। নিজেকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেই ৮-১০ বছর আগের চেহারায়।
যা তাকে ২২ গজে আরো প্রাণবন্ত, সতেজ করে তুলেছিল। পারফরম্যান্সের সূচক উর্ধ্বমুখী করতে ওই তাড়না ছিল সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। এবার তেমন কিছুই চোখে ধরা পড়েনি। ইনফিল্ড-অফ ফিল্ড সাকিব নিজেকে নিয়ে কাজ করেছেন সামান্য। মাঠের পারফরম্যান্সে সেই ধার ধরে রাখার চেষ্টা আপ্রাণ করে গেলেও সময়ের সেরা সাকিবকে ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে নিজের ছায়া হয়ে থাকতে হচ্ছে অনেকটা সময়। যা বলার অপেক্ষা রাখে না ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে ওয়ানডেতে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডারকে।
তবে ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপের শেষ ম্যাচে যেভাবে ব্যাট-বল হাতে ছিলেন তাতে মনে হয়েছে ঠিক বিশ্বকাপের আগে পুরোনো কিক সাকিব পেয়ে গেছেন। ব্যাটিংয়ে অনবদ্য। বোলিংয়ে নিখুঁত। আর ফিল্ডিংয়ে আঁটসাঁট। সঙ্গে নেতৃত্বগুণে অনন্য। সব মিলিয়ে পারফেক্ট অলরাউন্ডের চিত্র যদি প্রেমাদাসার ক্যানভাসে আঁকা হয় তাহলে চিত্রকর সাকিবকেই বেছে নিয়েছিলেন।
রেকর্ড, দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তো অনেক ক্রিকেটারই করে থাকেন; কিন্তু বলে কয়ে টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলাটা কেবলমাত্র সাকিবের দ্বারাই সম্ভব। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে সাকিব দেখিয়েছিলেন তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। ৮ ম্যাচে ব্যাট হাতে ৮৬.৫৭ গড়ে ৬০৬ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নেন ১১ উইকেট। বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে কমপক্ষে ৫০০ রান ও অন্তত ১০ উইকেট নেওয়ার বিশ্বরেকর্ড গড়েন। কেবল নিজের দলকে সেমিফাইনালে নিয়ে যেতে পারেননি। নয়তো বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের খেতাব নিশ্চিতভাবেই উঠে যেত বাংলাদেশের সুপারস্টারের হাতেই।
অভাবনীয় পারফরম্যান্সে সাকিব নিজের স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছেন। সেখান পৌঁছতে হলে সাকিবকে নিজের খোলসই ভাঙতে হবে। যে কাজটা করেছিলেন গত বিপিএলে। তাকে পাওয়া গিয়েছিল ভিন্ন চেহারায়। বরিশালের হয়ে খেলার সময় ভারত থেকে উড়িয়ে এনেছিলেন অ্যাসালিস্ট লক্ষ্মীনারায়ণকে। যিনি মাহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংসে কাজ করেছেন নয় বছর।
চট্টগ্রামে রাইজিংবিডিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেই এ ভারতীয় জানিয়েছিলেন, ‘ব্যাটিং-বোলিংয়ের থেকেও সাকিব নিজের ক্রিকেটীয় মেধার পরিচর্যা করে। যেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চলার পথ মসৃণ করে দেয়। নিজের বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করে। সফল হবে কি হবে না সেসব ভেবে নিজের লক্ষ্য স্থির করে না।’
সাকিবের ভাবনায় যে পরিবর্তন এসেছে তা বলতে দ্বিধা নেই। পুরোনো সেই তাড়না আছে কিনা তা নিয়েও জল্পনার শেষ নেই। তবে তার ইচ্ছে বা বড় কিছু পাওয়ার জেদ একদম কমে গেছে তেমনটাও নয়। এক সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাও বলেছিলেন, ‘কোনো নম্বর নেই, যেটা আমি চাই। তবে বিশ্বকাপ এলে অবশ্যই চাই বড় বড় নম্বর যেন হয়।’
চাইলে সাকিব সব পারেন সেই প্রমাণ দিয়েছেন অতীতে। অনুশীলন না করে, নিজের কোনো প্রস্তুতি না নিয়ে, কেবল দৃঢ় মনোবল আর নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে গিয়েছেন। পারফর্ম করেছেন, দলকেও আনন্দে ভাসিয়েছেন। এমন একজন সব্যসাচীকেই এবার বিশ্বকাপে দরকার বাংলাদেশের। এই দলের প্রত্যেকেরই বিশ্বাস, ‘সাকিব ম্যাচে উজাড় করে দিলে অনেকটা কাজ হয়ে যায়। তখন বোঝাও যায় সাকিব জিততে কতটা ক্ষুধার্ত। ’ সেই সাকিবকেই পেতে গোটা দল মরিয়া। নিশ্চিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলও সেই সাকিবকেই দেখতে চায় ভারতের মাটিতে।
সাকিবের একডজন অতিমানবীয় কীর্তির গল্প সাজানো আছে। সবকিছুই টাইমফ্রেমে আবদ্ধ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবাক রাজপুত্তুর তিনি। বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ। নাসের হুসেইন সেই কথাটা নিশ্চয়ই মনে আছে, ‘হি ইজ দ্য সুপারস্টার অব বাংলাদেশ ক্রিকেট। এন্ড হি প্লেইড লাইক এ সুপারস্টার, টুডে।’ জ্বলে উঠুক বাংলাদেশের সুপারস্টার। উড়ুক লাল সবুজের পতাকা। সাকিব হাসলেই, হাসবে বাংলাদেশ।