খেলাধুলা

জয়ের তীব্র ক্ষুধা বনাম ক্রিকেটীয় চেতনার ‘ফাঁকা বুলি’

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের স্লোগানটার মানে বোঝেন না অনেকেই! উইন অর উইন। জয় কিংবা জয়। বিপিএলের তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ও সফলতম দল কুমিল্লা জয় কিংবা জয় দিয়ে যা-ই বোঝাতে চান না কেন, বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ওই স্লোগান হুবুহ যেন মিলে যায়।

জয়-ই শেষ কথা। অন্তত দিল্লিতে গতকাল সাকিব যা দেখালেন, ক্রিকেটের ১৪৬ বছরের ইতিহাসে কেউ পারেননি। ক্রিজে দেরি করে গার্ড নেওয়ায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে টাইমড আউট করে পাঠালেন ড্রেসিংরুমে। কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কি হলো? শোনা যায়, গ্যালারিতে কেউ কেউ মনে করছিল, শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যান অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ ভুলে করে নেমে পড়েছিলেন! কেনই বা মনে করবে না? মাঠের গ্যালারি কিংবা টিভির সামনে বসা সমর্থক বা মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ বুলানো দর্শক প্রথমবার এমন অদ্ভুত টাইমড আউট দেখলেন।

সামারাবিক্রমা আউট হওয়ার পর ক্রিজে গার্ড নিতে ২ মিনিটের বেশি সময় নিয়েছিলেন ম্যাথুজ, দাবি আম্পায়ারদের। যদিও তার হেলমেটের স্ট্রাপে সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু তা আমলে নেননি আম্পায়াররা। তাদের দাবি, হেলমেটের সমস্যা দেখা দেওয়ার আগেই ২ মিনিট পেরিয়ে যায়। কিন্তু প্রোডাকশন থেকে যে টাইমফ্রেম দেওয়া হয় তাতে দেখা যায়, ম্যাথুজ মাঠে ঢুকে ক্রিজে যান ১ মিনিট ৫২ সেকেন্ডে। চার সেকেন্ড পর তার হেলমেটের স্ট্রিপ ছিঁড়ে যায়। ড্রেসিংরুম থেকে আরেকটি হেলমেট এনে মাথায় দেওয়ার আগেই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার জানতে পারেন, তিনি টাইমড আউট।

এমন আউটের পর ম্যাথুজ নিজেও অবাক। চোখ ছানাবড়া। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ২০০৬ সাল থেকে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে তার ও সাকিবের একসঙ্গে পথচলা। পুরোনো সম্পর্কের কারণেই বাংলাদেশের অধিনায়কের কাছে আবেদন ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন ম্যাথুজ। কিন্তু জিততে মরিয়া যা সুযোগ হাতছাড়া করবেন না কিছুতেই। তাইতো ফিরিয়ে দেন সাবেক লঙ্কান অধিনায়ককে।

সাকিব বলেছেন, ‘ও আমাকে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি আবেদন তুলে নেব কিনা? আমি জানিয়েছি, ‘‘আমি তোমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছি। এটা আনফরচুনেট। কিন্তু আমি চাই না।’ শুধু ম্যাথুজ নয়, আম্পায়ার মারিয়াস ইরাসমাস সাকিবের থেকে নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই ম্যাথুজকে আউট দেন, ‘আম্পায়ার বলেন, ও যদি আউট হয়ে যায় তুমি কি তাকে ফেরাবে নাকি। যদি ফেরাও তাহলে ভালো দেখাবে না। আমি জানাই, ব্যাক করাবো না।’

বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ জয়ের পর টানা ছয় হার। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল সাকিবের। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির টিকিট নিশ্চিতে শ্রীলঙ্কাকে হারানো প্রয়োজন ছিল। ৩ উইকেটে জয়ে নিজেদের কাজ এগিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সেটাও জিততে মুখিয়ে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। সাকিব সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। তাইতো শ্রীলঙ্কা ও ম্যাথুজকে ফেরানোর সুযোগ হাতছাড়া করেননি। অন্য সময় হলে কিংবা দ্বিপক্ষীয় সিরিজের সাধারণ ম্যাচ হলে সাকিব বা বাংলাদেশ টাইমড আউট নিতেন কিনা সেই প্রশ্নও উঠছে।

সাকিবের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘করতাম কিনা জানি না। তবে আজকের (গতকালের) ম্যাচে আমাদের জেতা দরকার ছিল। আমরা যদি যুদ্ধে নামি। আপনি যদি যুদ্ধে নামেন তাহলে আপনার দলকে, আপনার দেশকে জেতানোর জন্য সবকিছু করা উচিত বলে মনে করি। সেটাই আমি করেছি।’

আইনও সাকিবের পক্ষে। এমসিসির মতে, ‘উইকেটের পতন বা একজন ব্যাটসম্যান রিটায়ার্ড হওয়ার পর, নতুন ব্যাটসম্যানকে, সময় না বলা পর্যন্ত, বল খেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বা অন্য ব্যাটসম্যানকে আউট হওয়ার ২ মিনিটের মধ্যে পরবর্তী বল গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ না হলে, নতুন ব্যাটসম্যান আউট হবেন, টাইমড আউট।’

ব্যাস। সাকিবকে আর পায় কে? বারবার তার কণ্ঠে উঠে এলো এই আইনের কথাই, ‘নিয়মে আছে ব্যাটসম্যানদের ২ মিনিটের ভেতরে ক্রিজে আসতে হবে। ওই সময়ের মধ্যে। কিন্তু সে আসেনি। তাই সে আউট। এজন্য আমার কোনো দুঃখ প্রকাশও নেই।’

বাংলাদেশে যে কোনো ঘটনাতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন সাকিব। এবার বিশ্ব ক্রিকেটেও সাকিব হট কেক। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে আসা ম্যাথুজকে সতর্ক করে সুযোগ দেওয়া যেত কিনা সেই প্রশ্নও উঠছে। সঙ্গে ক্রিকেটীয় চেতনার কথাও বলা হচ্ছে। সেসব নিয়ে সাকিবের উত্তর এক কথায় প্রকাশের মতোই, ‘আইসিসির উচিত আইনটা দেখা এবং নিয়ম পরিবর্তন করা (হাসি)।’

যে ক্রিকেটীয় চেতনা, ভদ্রতার কথা সাকিবকে নিয়ে বলা হচ্ছে তা ম্যাথুজকে নিয়ে হচ্ছে না। অথচ মাঠের ভিতরে ও বাইরে যে প্রতিক্রিয়া ম্যাথুজ দেখিয়েছেন তা নিশ্চিতভাবেই বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। ম্যাচের পর শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাননি। ম্যাথুজ সংবাদ সম্মেলনে এসে, সাকিব ও বাংলাদেশ দলকে এই ঘটনার জন্য কড়া সমালোচনা করেছেন।

‘আমার (হেলমেট) সরঞ্জামে সমস্যা হয়েছিল। আমি জানি না কাণ্ডজ্ঞান কোথায় হারালো। অবশ্যই সাকিব ও বাংলাদেশের জন্য এটা লজ্জাজনক। যদি ওরা এভাবেই খেলতে চায় এবং এত নিচে নামে, আমার মনে হয় ওদের কোথাও একটা বড়সড় ঝামেলা আছে।’

সঙ্গে যোগও করে দিলেন, ‘হ্যাঁ, যারা আমাদের সম্মান করবে, তাদেরকে সম্মান দিতে হবে। এর মানে এই না—তাদেরকে (তো) খেলাটিকেই সম্মান দিতে হবে। মানে, আম্পায়াররাসহ আমরা সবাই এই সুন্দর খেলাটির প্রতিনিধি। ফলে আপনি যদি সম্মান না করেন, কাণ্ডজ্ঞান না ব্যবহার করেন, তাহলে আর কী চাইছেন?’

ম্যাচ শেষে ম্যাথুজ নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করলেও মাঠে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন। সাকিব মাঠে ঢোকার পর থেকেই চলতে থাকে স্লেজিং। সাকিবকে আউট করার পর হাতঘড়ি দেখিয়ে সময় দেখার কথা বলতে থাকেন ম্যাথুজ। ম্যাচের পরের ঘটনা জানাতে গিয়ে সাকিব বলেছেন, ‘খেলা শেষে কোনো কথা হয়নি আমাদের (দুই দলের)। আমরা হাত মিলাইনি… ওরা চলে গেছে।’

অতীতে মানকাড নিয়েও নানা ঘটনা ঘটেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। পরবর্তীতে আইসিসি মানকাডকে শুধু বৈধতাই দেয়নি, বরং স্বাভাবিক আউট হিসেবে আইনে পাশ করিয়েছে। এই মানকাড আউট নিয়েও তীব্র সমালোচনা চলে। কিন্তু ম্যাথুজ নিজেও তো এই আউট করেছেন। তার অধিনায়কত্বে শ্রীলঙ্কা ইংল্যান্ড সফরে গেলে জস বাটলারকে মানকাড করা হয়। ম্যাথুজ সেই সিদ্ধান্ত ঠিকই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এবার আইনে থাকার পরও ক্রিকেটীয় চেতনার ফাকা বুলি ছুঁড়লেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষে।

খ্যাতিমান ক্রিকেট লেখক ও দার্শনিক সিএলআর জেমসের একটি কথায় চাইলে সারাংশ টানতে পারেন, ক্রিকেটকে যারা কেবল খেলা হিসেবে দেখে, ওরা আসলে ক্রিকেট বোঝে না। সঙ্গে ম্যাথুজের পুরো বক্তব্যকে সাম্প্রতিক সময়ের ভাইরাল হওয়া আরেকটি উক্তির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন, ‘আমার আবেগ কাজ করেছে, বিবেক কাজ করেনি!’

দিল্লির লড়াইয়ে  সাকিব কেবল দলকে জেতাননি, রান রেটে এগিয়ে শ্রীলঙ্কাকে টপকে গিয়েছে। অধিনায়ক হিসেবে সাকিব এই ম্যাচ থেকে ফুল মার্কস পেয়েছেন। ম্যাথুজ নামের পাশেও যেমন শূন্য। বাকি কাজেও তাই।